ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভাষা আন্দোলনে নারী

প্রকাশিত: ০৯:১২, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ভাষা আন্দোলনে নারী

ভাষা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ বাঙালী জাতি ও বাংলা ভাষার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। তবে আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি সংগ্রামের সাধারণ ইতিহাসে উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান পায়নি। অথচ পুরুষদের সহযোদ্ধা হয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবি নিয়ে নারীরা ছিলেন মিছিলের সামনের সারিতে। ভাষা আন্দোলনের সব ধরনের মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশে নারীরা অংশ নিয়েছে। আন্দোলনের পোস্টার, ব্যানার, কার্টুন লেখায় নারীদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভাষাপ্রশ্নে নারীদের তৎপরতা সারাদেশে শুরু থেকেই অব্যাহত ছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালে সিলেটের নারীরা তৎকালীন মন্ত্রী আবদুর রব নিশতারের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন। নারীদের এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন জোবেদা খাতুন চৌধুরী, শাহেরা বানু, লুৎফুন্নেসা খাতুন, নজিবুন্নেসা খাতুনসহ স্থানীয় অনেক নারী। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা ভাষা আন্দোলনে দুঃসাহসিক অবদান রেখেছে। ১৯৫১ সালে ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ছাত্রীরাই বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ভাষা আন্দোলনে গৌরবময় ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিম উদ্দিন পল্টন ময়দানে জিন্নাহ্র সুরে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। ২৯ জানুয়ারি থেকে এ বক্তৃতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হয়। ৩১ জানুয়ারি আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ৪০ জন প্রতিনিধি নিয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটিতে নারীদের মধ্যে নাদেরা চৌধুরী, লিলি খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সংগ্রাম কমিটির লিফলেট বিলি, নারী জমায়েত, প্রণোদনা দান প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত হন কামরুন্নাহার লাইলী, হামিদা খাতুন, নূরজাহান মুরশিদ, আফসারী খানম, নিবেদিতা নাগ, রানু মুখার্জি, প্রতিভা মুৎসুদি, রওশন হক প্রমুখ নেতা-কর্মী। ৪ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ৮ ফেব্রুয়ারির একটি সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ববাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট উপলক্ষে নাদেরা বেগম ও সাফিয়া খাতুনকে পরিষদ পোস্টার লেখার দায়িত্ব প্রদান করে। তাঁরা দুজন অন্য মেয়েদের সহযোগিতায় সে দায়িত্ব পালন করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হলে ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের জন্য ৯৪, নবাবপুর রোডের আওয়ামী লীগ অফিসে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সংগ্রাম কমিটির জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নারীদের মধ্যে এ সভায় উপস্থিত ছিলেন বেগম আনোয়ারা খাতুন এমএলএ। ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরে গাজীউল হক, মহম্মদ সুলতান, এসএ বারী দুজন-দুজন করে বিশ^বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠাতে থাকেন। সকাল ৯টার মধ্যে বিপুলসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর সমাবেশ ঘটে আমতলায়। সাফিয়া খাতুন, শামসুন্নাহার আহসান, নাদেরা বেগম, সোফিয়া খান ছাত্রীদের সংগঠিত করার কাজটি করেন। তারা মেয়েদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে বিভিন্ন স্কুলে পাঠান। মেয়েরা হেঁটে বাংলাবাজার গার্লস স্কুল ও কামরুন্নেসা স্কুলে গিয়ে আমতলার সভায় যোগ দেয়ার জন্য ছাত্রীদের সংগঠিত করেন। এসব তৎপরতার কারণে ২১ ফেব্রুয়ারির সমাবেশে বিপুলসংখ্যক মেয়ে উপস্থিত হতে পেরেছিল। আমতলার সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। সমাবেশ শেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ছাত্রদের দুই-তিনটি দল বেরিয়ে যাওয়ার পরই ছাত্রীদের দল বেরিয়ে পড়ে। সেদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সাফিয়া খাতুন, সুফিয়া আহমেদ, রওশন আরা বাচ্চু ও শামসুন্নাহার আহসানের নেতৃত্বে কয়েকটি দল রাস্তায় নামে। নারীদের প্রথম দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন সাফিয়া খাতুন। এসব দলে ছিলেন সারা তৈফুর, সোফিয়া করিম, সুফিয়া আহমেদ, হালিমা খাতুন, চেমনআরা, মনোয়ারা ইসলাম, আমেনা আহমেদ, জুলেখা, নুরী, সুরাইয়া প্রমুখ। ছেলেদের গ্রুপ বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাদের গেট থেকে ট্রাকে তুলে নিচ্ছিল, ফলে তারা ব্যারিকেড ভাঙতে পারেনি। ব্যারিকেড ভাঙার কাজটি করেন ছাত্রীরাই। সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলে অনেক ছাত্রী আহত হন। আমতলা থেকে মেডিক্যাল কলেজের গেট পর্যন্ত যেতে রওশন আরা বাচ্চু পুলিশের লাঠির আঘাতে এবং সুফিয়া ইব্রাহিম, সারা তৈফুরসহ ৮ জন মেয়ে পুলিশ কর্তৃক ছোড়া ইটের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। অনেক মেয়েকে গ্রেফতার করে পুলিশভ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়। একপর্যায়ে পুলিশ নির্বিচারে ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র সালাউদ্দিন, আব্দুল জব্বার, আবুল বরকত ও বাদামতলির কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের পুত্র রফিক উদ্দিন শহীদ হন এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত ও বহুসংখ্যক গ্রেফতার হন। ২১ ফেব্রুয়ারির এই বর্বরতার খবর দ্রুত গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়লে ঢাকাসহ সারাদেশ পরদিন থেকে বিক্ষোভ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠে। ঢাকার অভয় দাস লেনে অনুষ্ঠিত এক সভায় বেগম সুফিয়া কামাল, নূরজাহান মুরশিদ, দৌলতুন্নেসা খাতুন প্রমুখের নেতৃত্বে অসংখ্য নারী ছাত্রদের মিছিলের ওপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং নিন্দা প্রস্তাব আনেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি বেগম নূরজাহান মুরশিদ ও লায়লা সামাদের নেতৃত্বে আহূত এক সভায় মিছিলে গুলি চালানোর প্রতিবাদে নিন্দা প্রস্তাব আনা হয়। নারায়ণগঞ্জের মর্গান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠিত করেন। ২৯ ফেব্রুয়ারি তাঁকে গ্রেফতার করে কোর্টে আনা হলে সর্বস্তরের জনগণ কোর্ট প্রাঙ্গণে সমবেত হয় এবং বিনাশর্তে তাঁর মুক্তি দাবি করে। তখন তাঁকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করতে চাইলে জনতা চাষাঢ়ার কাছে রাস্তায় গাছ ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। পুলিশ কোনভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে ঢাকা থেকে আরও বাহিনী নারায়ণগঞ্জে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত চেষ্টা করেও কোনভাবেই তাঁকে আনতে না পেরে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে পুলিশ তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। কারাবন্দী অবস্থায় বন্ড দিয়ে কারাগার থেকে মুক্তি লাভে অস্বীকৃতি জানালে মমতাজ বেগমের স্বামী তাঁকে তালাক দেন। শুধু রাস্তায় নয়, অন্দরমহলে নারীর অবদান কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অধ্যাপক আবুল কাশেমের স্ত্রী রাহেলা খাতুন, বোন রাহিমা খাতুন এবং রোকেয়া বেগম (আত্মীয়) আন্দোলনকারীদের আজিমপুরের বাসায় দীর্ঘদিন রান্না করে খাওয়ান। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত ৪টার দিকে আবুল কাশেমের বাসা ঘিরে ফেলে পুলিশ। ভেতরে তখন আবুল কাশেম, আব্দুল গফুরসহ অন্যরা ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র ‘সৈনিক’ পত্রিকা প্রকাশের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। পুলিশ দরজায় কড়া নাড়লে রাহেলা খাতুন পুলিশের সঙ্গে ফ্যামিলি বাসায় এত রাতে কড়া নাড়ার বিষয়ে তর্ক জুড়ে দিয়ে আবুল কাশেমসহ অন্যদের পেছনের দেয়াল টপকে পালাতে সহায়তা করেন। এছাড়া ভাষা আন্দোলনের জন্য চাঁদা তুলতে গেলে অনেক নারীই তাদের স্বর্ণের গহনা খুলে দিয়েছেন। সিলেটের কুলাউড়ার সালেহা বেগমকে ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস স্কুলে থাকাকালীন ভাষাশহীদদের স্মরণে স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলনের অপরাধে তিন বছরের জন্য স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তী সময়ে তার পক্ষে আর লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়। এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ছাত্রীমিছিল বের করলে কামরুন্নাহার লাইলী, ফরিদা বারী, জহরত আরা, মিলি চৌধুরী, ফিরোজা বেগমসহ অনেককে গ্রেফতার করা হয়। সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সব ধরনের সামাজিক, ধর্মীয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় বাধা অতিক্রম করে ভাষার দাবিতে নারীদের রাজপথে নেমে আসা ছিল অনেক বড় ব্যাপার। ভাষা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ কোন ব্যতিক্রম বিষয় ছিল না। নারীদের এই সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল একটি সচেতন প্রয়াস। তাই ভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন প্রয়োজন। লেখক : প্রভাষক, বাংলাদেশ এ্যান্ড লিবারেশন ওয়্যার স্টাডিজ বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়
×