ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আল নাহিয়ান

আন্তর্জাতিক কার্টুন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের নাসিফ

প্রকাশিত: ১২:১৪, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

আন্তর্জাতিক কার্টুন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের নাসিফ

শিল্প জগতের নানা শাখা-প্রশাখার অন্যতম একটি হলো চিত্রকলা, যার অন্তর্ভুক্ত একটি অতি জনপ্রিয় ধারা কার্টুন। মধ্যযুগে অর্থাৎ ১৪ থেকে ১৭ শতকে ইতালিতে দেয়াল সজ্জিতকরণে চিত্রকরদের দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার সময় আলাদা কাগজে স্কেচের মাধ্যমে নির্দেশনা দেয়া হতো। এই স্কেচগুলো পরিচিত ছিল কার্টোনি নামে, যা থেকে কার্টুন শব্দের উৎপত্তি। ১৮৪০ এর দশক থেকেই এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইংরেজী সাময়িকী পাঞ্চ প্রথমবারের মতো ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে তুলে ধরা হয় দালান-কোঠার মজাদার চিত্র। এরপর ঊনবিংশ শতকে এসে সাময়িকী ও সংবাদপত্রে এর বহুল ব্যবহার শুরু। ১৮৭২ সালে অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ব্যঙ্গচিত্র বিবেচিত হয় প্রথম বাংলা কার্টুন হিসেবে। ব্রিটিশ শাসনে এক সাহেবের অধীনে শৃঙ্খলবদ্ধ এক আমলাকে চিত্রায়ন করা হয়েছিল সেই ব্যঙ্গচিত্রে। বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষে কার্টুনের উন্নয়ন ও প্রসার বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে কার্টুনিস্ট অর্জন করেছেন বিশ্বজোড়া খ্যাতি। এই কার্টুনিস্ট পরিবারেরই এক কনিষ্ঠ সদস্য নাসিফ আহমেদ। জন্ম সৈয়দপুরে। বাবা মোঃ জালালউদ্দিন আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা। মা তাজরিনা আক্তার, গৃহিণী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে মৃৎশিল্পে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। সম্প্রতি তিনি একটি আন্তর্জাতিক ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন, যা ‘ফার্স্ট ওয়েল্ট হেইমেট ইন্টারন্যাশনাল কার্টুন কনটেস্ট ২০১৯’ নামে জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিম অঙ্গরাজ্য বেডেন-উটেমবার্গে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রদর্শনীর আয়োজক জার্মানি ও তুরস্ক। বিষয়বস্ত ছিল ‘যুদ্ধ ও মানবতা’। এই শিরোনামে যুদ্ধ, গণহত্যা, শরণার্থী, যুদ্ধে শিশু, মানবতাবিরোধী অপরাধ এমন অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আয়োজকদের পক্ষ থেকে বিশ্বের কার্টুনিস্টদের কাটর্ৃুনের মাধ্যমে মানবতার পক্ষে সাড়া দেবার আহ্বান জানানো হয়। নির্বাচিত কার্টুনগুলো প্রদর্শিত হবে জার্মানি ও তুরস্কের বিভিন্ন ইভেন্টে। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে নাসিফ জানান, আয়োজকরা অনলাইনে তাদের প্রদর্শনীতে সারাবিশ্বের কার্টুনিস্টদের কাছে কার্টুন পাঠানোর আহ্বান জানান। সেখান থেকেই এই প্রতিযোগিতা সম্পর্কে জানতে পারেন তিনি। অতঃপর যথারীতি কর্তৃপক্ষের নির্দেশিত প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি অনুসরণ করে তিনি তার কার্টুন প্রেরণ করেন। নাসিফ তার কার্টুনের শিরোনাম দেন ‘চ্যারিটি’। বিষয়বস্তু ছিল ‘লোক দেখানো দয়াদাক্ষিণ্য’। বিষয় নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভিন্ন সময়ে ও প্রেক্ষাপটে দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা নানা বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। পরবর্তীতে তাদের অনেকেই পেয়ে থাকেন নিছক সান্ত¦না ও লোকদেখানো দয়াদাক্ষিণ্য। বিষয়টি তার কাছে দৃষ্টিকটু। তাই বিষয়টিকে এরূপ নামকরণের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন তিনি। ৮২টি দেশ থেকে পাঠানো কার্টুনের মধ্য থেকে নির্বাচকরা ১৫০টি নির্বাচন করেন, যার মধ্যে তার কার্টুনটিও স্থান পায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন একটি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করতে পেরে এবং তার কার্টুনটি নির্বাচিত কার্টুনের তালিকায় স্থান পাওয়ায় নাসিফ বেশ উৎফুল্ল। অবশ্য এক্ষেত্রে একটি বিষয় তার মনে দাগ কেটেছে। তা হলো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী অনেকেই কপি করা বা নিজের পুরনো কার্টুন পুনরায় জমা দেয়ার জন্য নিন্দিত হয়েছেন এবং প্রদর্শনী থেকে বাদ পড়েছেন। এহেন কর্মকা-ে কার্টুনের স্বকীয়তা হারানোর শঙ্কা দেখা দিতে পারে বলে তার ধারণা। যদিও বিষয়টি এখনও ততটা গুরুতর পর্যায়ে যায়নি। কার্টুনের মৌলিকত্ব ক্ষুণœœ হওয়ার এই অপপ্রচেষ্টার কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, মানুষ যখন নিজের কাজের প্রতি সম্মান হারিয়ে ফেলে, ঠিকমতো অনুশীলন না করেই অল্প সময়ে ও সহজে খ্যাতি অর্জনের লোভ করে তখনই এমনটি ঘটে। তবে এমন কার্টুনিস্টের সংখ্যা বেশি নয়। তবে প্রতিষ্ঠিতরা যখন এমন করেন তখন বিষয়টি নতুনদের জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। সমাজে কার্টুনিস্টদের ভূমিকা সম্পর্কে নাসিফ সেই প্রবাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেন যে, ‘এক হাজার শব্দ দিয়ে যা বোঝানো যায় না একটি ছবিতে তা সহজেই বোঝানো সম্ভব।’ সমাজের নানা অসঙ্গতি যা আলোচনার মাধ্যমে বোঝানো কঠিন, তা একটি ব্যঙ্গাত্মক ছবির মধ্য দিয়ে মানুষ সহজেই বুঝতে পারে। বর্তমানে অনেক সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করা হয়। ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যাবলী বিশেষত রাজনীতিবিদদের ভাবমূর্তিকে বিচিত্রভঙ্গিমায় ব্যঙ্গাত্মক করে তুলে ধরা হয়। বিশ্বে রাজনীতি, যুদ্ধবিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামাজিক বৈষম্য প্রভৃতি বিষয়ে কার্টুনের সরব উপস্থিতি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। কাজেই দুর্বোধ্য কোন বিষয়কে সাবলীলভাবে সর্বসাধারণ্যে উপস্থাপনে কার্টুনের ভূমিকা অপরিসীম। তরুণ প্রজন্মের কাছে কার্টুনের আবেদন সবসময়ই রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। কেননা, নতুন প্রজন্ম টিভিতে এনিমেটেড কার্টুন দেখে, কমিক্স বই পড়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইমোজি স্টিকার ব্যবহার করে থাকে। কম্পিউটার ও এ্যান্ড্রয়েড ফোনেও কার্টুনিস্টিক গেম খেলতে অনেকেই পছন্দ করে। এই বিষয়গুলো তাদের কার্টুনপ্রীতির বহির্প্রকাশ। একজন কার্টুনিস্ট হিসেবে তার ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে নাসিফ জানান, সবক্ষেত্রে আমি আমার জীবনকে সহজ করে তোলার চেষ্টা করি। কঠিন ও রসকসহীন কোন বিষয়বস্তুকে সহজ ও হাস্যরসাত্মক করে তোলার চেষ্টা করি। আমি আমার কর্মের মাধ্যমে নিজে আনন্দ উপভোগ করি এবং অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে চেষ্টা করি। আমাদের দেশে কার্টুন যেন আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই লক্ষ্যে তিনি কাজ করে যেতে চান নিরন্তর।
×