ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তারুণ্যের বইমেলা

প্রকাশিত: ১২:১৩, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

তারুণ্যের বইমেলা

রবিন জামান খান থ্রিলার লেখক একজন তরুণ লেখক হিসেবে গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে সম্প্রতি বাংলা সাহিত্যে নবযুগের সূচনা হতে চলেছে। নবযুগ বলছি, কারণ গত কয়েক বছর ধরে অনেক খ্যাতিমান প্রবীণ লেখকদের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় অনেক নবীন লেখক তৈরি হয়েছে। একদিকে এই নবীন লেখকেরা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা নিয়ে কাজ করছে, যে ধারাগুলো নিয়ে এর আগে বাংলা ভাষায় সেভাবে চর্চা হয়নি। অন্যদিকে নবীন লেখকদের এই নতুন ধরনের লেখাগুলো প্রায় সব ধরনের ও সব বয়সের পাঠকরা খুবই আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করে নিচ্ছে। এর ফলে খ্যাতিমান প্রবীণ লেখক ও বয়োজ্যেষ্ঠ পাঠকদের পাশাপাশি বর্তমানে বাংলা ভাষায় তৈরি হচ্ছে নতুন লেখক ও নতুন পাঠক, সেই সঙ্গে বিকশিত হয়ে চলেছে সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা। আর যেহেতু বাংলাদেশে লেখক-পাঠক মেলবন্ধনের সবচেয়ে বড় একটি ক্ষেত্র পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে চলা বইমেলা, সে হিসেবে সাহিত্যের এই নবজোয়ারের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। (বই : ২৫শে মার্চ, সপ্তরিপু, ব্ল্যাক বুদ্ধা) রাসয়াত রহমান জিকো তরুণ লেখক ৩২টি বই নিয়ে ৪৭ বছর আগে যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রাণের মেলা বইমেলার যা আজ অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামে পরিচিত। প্রতিবছরের মতো এবারো মেলায় প্রচুর প্রকাশনা সংস্থার বৃহত্তর পরিসরে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মেলায় প্রতিদিন আসছে বৈচিত্র্যে ভরা নতুন বই, সমাগম ঘটছে প্রচুর পাঠকের। বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য লেখকদেরর উপস্থিতিও লক্ষ্য করার মতো। মেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রশংসনীয়। মেলায় ‘লেখক বলছি মঞ্চ’ সম্ভবত এবারই প্রথম যেখানে নবীন লেখকদের কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। মেলায় শিশুদের জন্য আলাদা শিশু চত্বর প্রশংসার দাবি রাখে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে বইমুখী করার জন্য মেলায় শিশুদের অগ্রাধিকার দেয়ার কোন বিকল্প নেই। টিএসসি থেকে মেলায় প্রবেশের সুবিধার্থে বয়স্ক মানুষদের জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থাও প্রশংসনীয়, তবে মেলার ভেতরে তাদের বিশ্রাম নেয়ার জায়গা রাখা যেতে পারত হয়ত। ক্রেডিট কার্ড এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বই কেনার সুযোগটাও বেশ ভাল। তবে লেখকরা তাদের লেখার মাধ্যমে পাঠকদের তৃপ্তি দিতে পারছে কি না সেটাতেই বইমেলার আসল উদ্দেশ্য নিহিত আছে। অধরা আঞ্জুমান পৃথা তরুণ লেখিকা তারুণ্যের প্রতিভাকে জাগিয়ে রাখতে বইয়ের চেয়ে বড় কোন সমাধান নেই। নতুন নতুন লেখক-লেখিকারা যেভাবে সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে বাংলা সাহিত্য আরও বহুদূর এগিয়ে যাবে। শুধু ধরা কলম কখনো না ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করাটা জরুরী। ভীষণ জরুরী। ‘গল্পশোভন’ আমার প্রথম একক বই। এ পর্যন্ত বাস্তব-অবাস্তব, সুখ-অসুখ, পাওয়া-না পাওয়া, আপন-পর নিয়ে যত গল্প লিখেছি সব গল্প এই বইতে আছে। ছোট ছোট সন্তান দিয়ে এই গৃহ ভর্তি করেছি। আর অসীম আবেগ জড়ানো আছেই। ‘লেখিকা’ ট্যাগ আমার সঙ্গে যায় না। তবু গল্প লেখার এত সাহস কোথা থেকে এলো জানি না। বইমেলায় যখনই যাই, পাঠকের ভালবাসা আর আগ্রহ অসম্ভব রকম মুগ্ধ করে। হাসান নাঈম তরুণ কবি প্রাচীনকালে মুনি-ঋষিদের তীর্থগুলো একই সঙ্গে ছিল জ্ঞানচর্চাকারীদের জন্য বিদ্যাপীঠও। একালের বিদ্যাপীঠে জ্ঞানচর্চা তো হয় তবে তাকে তীর্থস্থান বলতে আমাদের অধ্যাপকগণও কুণ্ঠিত হবেন। আমি মনে করি অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলার লেখক-পাঠকের জন্য তীর্থ। ‘আমাদের বর্তমানের সাহিত্য যেমন আগেকার সাহিত্যের কাছে ঋণী, তেমনি ভবিষ্যতের সাহিত্যও একালের সাহিত্যের কাছে ঋণী থাকবে,’ এ কথা যদি সত্য হয় তবে একুশে গ্রন্থমেলা শুধু মেলা নয় অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যতের যোগ রচনার এক প্রতিষ্ঠিত সংঘ। আমরা বরাবরই বইমেলার অপেক্ষায় থাকি। মেলাকে ঘিরে আকাক্সক্ষা যেমন আছে, আশঙ্কাও আছে। আকাক্সক্ষার কথা হচ্ছে; বইমেলায় প্রতিবছরই প্রবীণদের পাশাপাশি নবীনদের বই বের হচ্ছে, নবীনরা লিখছে, লিখতে হলে ভাবতে হয় অর্থাৎ ভাবছে। ভাবনার মধ্যেই কোন জাতির জাতীয় মুক্তির বীজ নিহিত। আমি তো আশা করি এ ভাবনার মধ্য দিয়েই আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক মুক্তি সর্বোপরি চৈতন্যের মুক্তি সম্ভব। আর আশঙ্কার কথা হচ্ছে অনেকেই আত্মপ্রচারে, খ্যাতির লোভে কিংবা কারও পয়সা আছে শুধু সে আত্মম্ভরিতায় বই প্রকাশের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। আমাদের আত্মাকে সমৃদ্ধ করতে হবে, গ্রন্থ রচনাটাই মুখ্য নয়। আমি আশা করি অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের আত্মার সমৃদ্ধির পথকে সুগম করবে। পাঠকের ভাবনা সাজিদ আল ইসলাম সবচেয়ে ভাল লাগছে, এই ২০১৯ এ এসে বইয়ের প্রতি মানুষের এত আগ্রহ। আমার মনে হয় যতদিন যাচ্ছে, আগ্রহ ততো বাড়ছে। নানা বয়সী পাঠকও বাড়ছে। এই বইমেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো, নতুন বেশকিছু লেখক তৈরি হয়েছে এবং সেই সঙ্গে বই পড়ার ধরণও বদলেছে। আগে যেখানে গল্প/ উপন্যাস টাইপ বই বেশি চলত সেখানে মোটিভেশনাল / আত্মউন্নয়নকেন্দ্রিক বইয়ের পাঠক চাহিদা দেখার মতো। একই জেনারের বই থেকে এখন পাঠক চাহিদা তৈরি হয়েছে বিভিন্ন জেনারের বইয়ের প্রতি। এখানে যেমন সাদাত হোসাইন স্থান গেড়েছেন, ঠিক তেমনি টাইমলাইনে উঠে আসছেন আইমান সাদিক, শামির মোন্তাজিদের মতো নবীন লেখকরা। তবে পাঠক চাহিদা বাড়লেও বইয়ের দাম বাড়ার কারণে অনেকেই হয়ত পছন্দের বইটি কিনতে পারছেন না। মেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রশংসা করতেই হয়। পাশাপাশি পরিবেশ, মেলার ভেতরের খাবারের স্টলে খাবারের দাম ও মান নিয়ে আরও নজর দেয়া দরকার বলে মনে করি। কাজী আফ্রিদা আহসান নতুন বছর মানেই আমার জন্য- বইমেলার অপেক্ষা। ছোটবেলায় বই ছিঁড়তে ছিঁড়তেই আমার প্রথম বই পড়া। প্রথম পড়া বই ‘কাজলা দিদি’। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় ছেঁড়ার পর বইটি পড়ি। বইপোকা হওয়ার যাত্রা সেখান থেকে শুরু। বইমেলা মানেই বাঙালীর এক উৎসব। তবে অতিরিক্ত বাণিজ্যিকীকরণ, অতিরিক্ত অলঙ্করণে মেলা জৌলুস হারাচ্ছে। বাচ্চাদের জন্য খেলার জায়গা না করে পুরো বইমেলায় তাদের বিচরণের উপযোগী পথ করা যেতে পারে। স্টলগুলোর দিকে নজর দেয়া জরুরী। দমকা বাতাসে স্টল ভেঙ্গে পড়া দুঃখজনক। পুরনো বই হারিয়ে যাওয়া বা নতুন লেখকদের মূল্য না দেয়ার দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। সততা স্টোর বইমেলাকে নতুন রূপ দিয়েছে। কিছু পাঠকদের মধ্যে সংস্কৃতিকে ধারনের চেয়ে সেলফি বা শুধুই ঘোরাঘুরির প্রবণতা দেখা যায়। পাঠক সমাজকে নিজেদের সত্তা আঁকড়ে ধরে লেখকদের উৎসাহ দিতে হবে।
×