ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এস এম মুকুল

চরাঞ্চল হতে পারে নতুন শস্যভাণ্ডার

প্রকাশিত: ১২:১৩, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

চরাঞ্চল হতে পারে নতুন শস্যভাণ্ডার

দেশের প্রায় সব চরাঞ্চলেই সবজি ও ফসলের উৎপাদন বেশ ভাল। কিছু ফসলের বাম্পার ফলন এবং প্রচলিত ফসলের বাইরে নতুন ধরনের সবজি যেমন- ক্যাপসিকাম, স্কোয়াস চাষে ব্যাপক সাফল্যে নতুন আশায় দিনবদলের স্বপ্ন দেখছেন চরাঞ্চলের জনগণ। নদী অববাহিকায় জেগে ওঠা চর কৃষি অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরফলে চরাঞ্চলে বসবাসরত মানুষের জীবনমান ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে। চরে অভাবি মানুষ নেই। চাষাবাদ করে চরের বাসিন্দারা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। চরবাসীর এই উন্নয়নে কৃষি সংশ্লিষ্ট কর্মসূচী বিশেষ ভূমিকা রাখছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এক সময়ের চর নিয়ে দখলবাজদের ক্ষমতার লড়াইয়ের অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে চরাঞ্চলে এখন কেবলই আশার আলো। চরাঞ্চলের উৎপাদিত সবজি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে পরীক্ষামূলক আবাদকৃত কয়েকটি সবজির ফলনে আশাতীত সাফল্য পাওয়ায় দেশের চরাঞ্চল নিয়ে কৃষি অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে দেশের সকল চরাঞ্চলের উপযোগী ফসল চাষাবাদে সরকারী ও বেসরকারীভাবে বিভিন্ন কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- কর্মসংস্থান ও অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্প। চরাঞ্চলের কৃষকদের মতে, চরাঞ্চলের জমি অসমতল ও বালির পরিমাণ বেশি হওয়ায় ইরি-বোরোর পরিবর্তে ছয়-সাত ধরনের ফসল চাষ করা যায়। চরের জমিতে আখ চাষের পর লাল শাক, পাট, কলমি শাক চাষ করা যায়। এসব সবজি রোপণের ১৫ দিন পর বাদাম, মরিচ, ঢেঁড়স ও পুঁইশাকের বীজ বপন করা যায়। এক মাসের মধ্যে সবজি বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হয়। সবমিলিয়ে চরাঞ্চলে বিশেষত সবজি উৎপাদনে বিরাট সুযোগ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে শীত মৌসুমে রংপুরে চরাঞ্চলের ৩৫ থেকে ৫০ ধরনের সবজি চাষ হচ্ছে। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, রংপুর অঞ্চলের ৮ জেলায় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে ১৯ লাখ টন সবজি। প্রতি কেজির দাম ২০ টাকা হিসেবে ৪ হাজার কোটি টাকা আয় করবে এখানকার কৃষকরা। চর সাধারণত দুই ধরনের Ñ দ্বীপচর এবং সংযোগ। দ্বীপচর হলো- নদীর মধ্যে শুধু বালুরাশির দ্বীপ, যার চারপাশে সারা বছর পানি থাকে। আর সংযোগ চর হলো- সাধারণ প্রবাহে নদী তীরের সঙ্গে মূল ভূখ-ের সংযোগ থাকে। ১ হাজার ৭২২ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত নদীর হাইড্রো-মরফোলজিক্যাল গতিশীলতার উপজাত হিসেবে অথবা নদী তীরের ভূমি ক্ষয় ও ভূমি তৈরির ফলে চর সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের সাতটি অঞ্চলের ৩১টি জেলার মোট ১১০টি উপজেলায় ১৬ শতাংশের ওপর এবং ১০৬টি উপজেলায় ৮-১৫ শতাংশে আংশিক চরাঞ্চল বিরাজমান। জানা গেছে, বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ১৬ শতাংশ চরভূমি। এসব চরভূমিতে প্রায় কোটি মানুষের বসবাস। বাংলাদেশ শত শত নদী অববাহিকার দেশ। জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক নিয়মে এসব নদীর বুকে অসংখ্য চর জেগে উঠে। কারণ বাংলাদেশের নদীগুলো উত্তরের হিমালয় থেকে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর অবধি প্রতিবছর কোটি কোটি টন বালি ও কাদা বয়ে নিয়ে আসে। প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত এসব বালি-কাদায় উঁচু হয়ে ওঠে নদ-নদীর তলদেশ। আর তাদের সঙ্গমস্থল বা মোহনার মুখে জেগে ওঠে নানা আকৃতির চর। রিলিফনির্ভরতা থেকে সবজি বিপ্লবের সূচনা গত কয়েক দশকে নদীভাঙন ও অন্যান্য কারণে সর্বস্ব হারানো মানুষেরা অবস্থান নিয়েছেন চরাঞ্চলে। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যই নির্জন ধু-ধু বালুচরে দলে দলে গড়ে তুলেছেন মাথাগুঁজার ঠাঁই। সেখানে অনেক প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যদিয়ে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের। নেই রাস্তাঘাট, নেই সুপেয় পানি ও সেচের পর্যাপ্ত সুবিধা। পরিবার পরিজন নিয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে বসবাসের সুযোগ পেলেও সেখানে তাদের জীবন যেন দুর্বিষহ সংগ্রামের। এক সময় চরের কৃষকরা মনে করলেন, চরে যদি কাশফুল জন্মে তাহলে শস্যও ফলানো যাবে। শুরু হলো সবজি ও ফসল ফলানোর পরীক্ষা-নীরিক্ষা। পরীক্ষা সফল প্রমাণিত হওয়ার পর প্রথম চরে বোনা হলো সরিষা, পরে ভুট্টা, ধনিয়া ও মরিচসহ বিভিন্ন সবজি শস্য ও মসলা। এইভাবে কৃষকের প্রচেষ্টায় দেশের একেকটি চর এখন যেন একেকটি শস্যভা-ার। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার দেশের চরগুলোতে কৃষির উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণ, কৃষিঋণ, বীজ ও সার সহায়তা পাচ্ছেন চরের কৃষকরা। এভাবেই গত প্রায় দুই দশকে সেসব চরাঞ্চলবাসীরা নিজেদের প্রয়োজনে চরের দৃশ্যপট এখন অনেকটাই পাল্টে দিয়েছেন। অথচ একদশক আগেও চরের মানুষ বলতে অতি দরিদ্রদের বোঝাত। কারণ তখন তারা ছিল রিলিফনির্ভর। এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। চরাঞ্চলের জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে বিভিন্ন জাতের ফসল। জেগে ওঠা পলিমাটি, বালুচর কিংবা চরের অনাবাদি ভূমি এখন সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কৃষির অবারিত ক্ষেত্র হিসেবে। সারা বছরই কোন-না- কোন ফসল ও সবজির আবাদ হচ্ছে। এখন চরের মানুষদের জীবনধারায় এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। জমি তৈরি, বীজ বপন, পরিচর্যা কিংবা ফসল তোলার ব্যতিব্যস্ততা চরাঞ্চলের নৈমিত্তিক চিত্র। এরফলে বেশির ভাগ চরেই দেখা দিয়েছে কর্মচাঞ্চল্য। চরাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে শাক সবজির চাষ করে বহু পরিবার সচ্ছলতা এসেছে। শুধুমাত্র ধান চাষের উপর নির্ভরশীল কৃষিতে শাক সবজির চাষ এনে দিয়েছে নতুন গতি। কৃষকদের জীবন জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে কৃষির এই সফল বিবর্তন। খাদ্য নিরাপত্তায় নতুন আশা চর এলাকায় ফসলের নিবিড়তা ১৫০-১৮৫ শতাংশ। মূল ভূখ-ের চেয়ে অস্থায়ী চর সাধারণত কম উৎপাদনশীল। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, অধিকাংশ চরের জমি আকস্মিক বন্যাকবলিত হয়ে ভেঙে, বালি মাটি দ্বারা ঢেকে বা ক্ষয় হয়ে যাওয়ায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। দেশের বিভিন্ন চরে পরিবেশ সম্মতভাবে সবজি চাষ বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চরের জমিতে সবজি চাষ করে কৃষকদের অভাব দূর হচ্ছে। প্রতি বিঘা জমিতে বিভিন্ন সবজি উৎপাদন করে বছরে ২৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা ক্ষেত্র বিশেষে আরও বেশি লাভ করতে পারছেন। এর বাস্তব চিত্র দেখা যাবে সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার দুর্গম যমুনার বিভিন্ন চরে। সেখানে হচ্ছে আধুনিক পদ্ধতিতে মাচায় সবজি চাষ। এই চাষের মধ্য দিয়ে তারা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, সবজি উৎপাদন চরের কৃষকদের মাঝে নতুন এক উদ্দীপনা তৈরি করেছে। কৃষকেরা সবজি বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে আগের চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হচ্ছেন। অক্সফাম ইন বাংলাদেশের পলিসি, এ্যাডভোকেসি, ক্যাম্পেইন এ্যান্ড কমিউনিকেশন্স ম্যানেজার এসএম মনজুর রশীদ বলেন, দেশের চরের কৃষি অপার এক সম্ভাবনার জায়গা। কিন্তু বহুবিধ কারণেই চরের উন্নতকৃষি ব্যবস্থাপনায় এখনও নানা ধরনের জটিলতা বিদ্যমান। চরের কৃষিসেবা ও ব্যবস্থাপনাকে আধুনীকিকরণের মধ্যে দিয়ে অধিক হারে খাদ্য উৎপাদনের প্রচেষ্টা সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে অপারসম্ভাবনা জাগিয়েছে চরাঞ্চলের কৃষি। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে করণীয় দেশের একেকটি চর এলাকা যেন কৃষি-অর্থনীতির অবারিত সম্ভাবনার ক্ষেত্র। পরিকল্পনা মাফিক অগ্রসর হলে অথৈর্নতিক সমৃদ্ধির নতুন ক্ষেত্র হিসেবে বিরাট ভূমিকা রাখবে চরাঞ্চল। চরাঞ্চলের জমি এবং কৃষক সমাজ অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলার শিকার। আধুনিক চাষবাস সুবিধা না থাকায় চরাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন আশানুরূপ নয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর তাই চরের কৃষিজমি এবং কৃষকের প্রতি আরও নজর দেয়া এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে। চর কৃষির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আরও যা যা করণীয় হতে পারেÑ লবণাক্ত এলাকার চরগুলোতে পাটসহ লবণাক্ততাসহিষ্ণু ফসল উৎপাদনের চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। চরাঞ্চলে ছাগল, মহিষ, ভেড়া ও উন্নত জাতের গরু পালনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এনজিওর মাধ্যমে কুটির শিল্পভিত্তিক উৎপাদনশীল কাজের ব্যবস্থা করা, একটি চর একটি কো-অপারেটিভ সোসাইটি গঠন করা, দেশের চরাঞ্চলে কৃষকদের ভূমির মালিকানা লিজভিত্তিক করা, চরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দেয়া, চরাঞ্চলের গ্রামে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি করা। কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে চরাঞ্চলে কৃষি প্রদর্শনী প্লট করা যেতে পারে, যাতে কৃষকরা চরবান্ধব ফসল চাষবাস করতে অগ্রহী হয়, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের চরের কৃষকদের সঙ্গে সভা-সমাবেশ বাড়ানো, চরাঞ্চলে আরেকটি সম্ভাবনার জায়গা হলো গবাদি পশুপালন। কিন্তু দেশের সব চরে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এবং উৎপাদিত পণ্যের বিপণন প্রক্রিয়ায় এখনো নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। ফলে চরে যে বিস্তীর্ণ আবাদি জমি রয়েছে সেখানে সেই মাত্রায় অধিক ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ চরাঞ্চলে নতুন নতুন কৃষিপ্রযুক্তির অভাব, উন্নতমানের বীজের সঙ্কট, উন্নত জাতের ফসল চাষের প্রচলন না থাকা, সেচ সঙ্কট এবং উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বিপণন ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা এবং কৃষকদের দ্রুত ঋণ সহায়তা পাওয়ার ব্যবস্থা না থাকা।
×