ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বৃদ্ধাশ্রমের একাকিত্ব ঘোচাতে ‘শিশু পরিবারেই’ আবাসন

প্রকাশিত: ১১:০২, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বৃদ্ধাশ্রমের একাকিত্ব ঘোচাতে ‘শিশু পরিবারেই’ আবাসন

সমুদ্র হক ॥ অভিজ্ঞ নাগরিক (সিনিয়র সিটিজেন) যারা পরিবারের অবহেলিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাদের পারিবারিক আবহের বন্ধনে রাখতে দেশে প্রতিটি শিশু পরিবারে বৃদ্ধাশ্রম খোলা হয়েছে। যেখানে পরিবারের অবহেলিত বয়স্করা নিজের বাড়ির মতো শিশুদের সঙ্গে থাকবেন। মনে করবেন তারাই নাতি-নাতনি। জীবনের শেষ প্রান্তে হেসেখেলে বাকি সময়টুকু পার করবেন। প্রাথমিকভাবে প্রতিটি শিশু পরিবারে বিশেষায়িত দশটি করে আবাসন সংরক্ষিত থাকছে। ‘আপনজন’ তাদের অবহেলা করতে পারে, আশ্রিতের মতো থাকতে হতে পারে। অপার স্নেহের বন্ধনে বিচ্ছেদও ঘটতে পারে। প্রিয়জনের এমন আচরণে কোন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা জীবনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারেন। চোখের কোণ থেকে অবচেতনেই গড়িয়ে পড়তে পারে দু’ফোঁটা অশ্রু। এসব বয়স্ক ব্যক্তির কথা ভেবে দু’বছর আগে সরকার দেশে প্রথমবারের মতো প্রতিটি শিশু পরিবারে ৬৫ বছরোর্ধদের (যারা অভিজ্ঞ নাগরিক) আবাসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। যে শিশু পরিবার শুধু মেয়েদের জন্য নির্ধারিত সেখানে শুধু বয়স্ক নারী থাকতে পারেন। যেমন বগুড়ার শিশু পরিবার শুধু মেয়েদের জন্য। ’৫৯ সালে নগরীর উত্তরে ফুলবাড়িতে শিশু পরিবার প্রতিষ্ঠা করা হয়। আগে নাম ছিল সরকারী এতিম খানা। ’৬২ সালে ১৩ দশমিক ২২ একর ভূমির ওপর ইমারত নির্মিত হয়, নাম হয় সরকারী শিশু পরিবার। অবকাঠামো স্থাপনা ছাড়াও আছে সুপ্রশস্ত সড়ক, বড় মাঠ, শিশু বিনোদনের স্থান, আম-কাঁঠাল ও ফলাদির বাগান। তিনটি বড় পুকুর, যার একটি শানবাঁধানো। ’৮৪ সাল থেকে বগুড়া শিশু পরিবারে শুধু এতিম মেয়েদের ‘নিবাসী’ করা হয়। যারা শিশু পরিবারে থাকে তাদের বলা হয় নিবাসী। এই শিশু পরিবারে অবহেলিত বৃদ্ধরা থাকতে পারলে প্রকৃতির সান্নিধ্যে জীবনের শেষবেলা ঘরখানি খুঁজে পাবেন। যা বয়স্কদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। কারণ ছোট্ট ঘটনাতেই তারা সবচে বেশি কাতর ও ব্যথিত হয়ে পড়েন। তাদের সেন্টিমেন্টও বেশি। প্রকৃতির সান্নিধ্য তাদের এই অবস্থা থেকে অনেকটা মুক্ত করতে পারে। তার ওপর শিশু পরিবারের নিবাসীরা তাদের সঙ্গে সময় কাটাবে নাতি-নাতনির মতো। এভাবে বয়স্ক এবং অনাথ শিশুরা উভয়েই খুঁজে পাবেন তাদের ফেলে আসা বা চলে যাওয়া আপনজনকে। মনস্তাত্ত্বিকদের ভায়ায় যা এক ধরনের আবেগের স্নেহ ও ভালবাসা। দেশের সবচেয়ে পুরান এই শিশু পরিবারে মেয়ে নিবাসী আছে ১৬৩। যারা প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করছে। পরে অনেকেই উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ, গান, নাটক, খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় সুনাম কুড়িয়েছে। বৃদ্ধাশ্রমের বয়স্করা তাদের কাছে পেলে জীবনের দুঃখবোধ ভুলে জীবনবোধের নতুন ধারা খুঁজে পাবেন, যা তাদের শেষদিন পর্যন্ত আনন্দের মধ্যে রাখবে। এই প্রশান্তি তাদের আয়ু বাড়িয়ে দিতে পারে। বর্তমানে দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর। এ বিষয়ে বগুড়া সমাজকল্যাণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শহীদুল ইসলাম খান জানান, বগুড়া শিশু পরিবার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে। এখানে বয়স্করা জীবনের শেষপ্রান্তে শিশুদের সঙ্গে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন। তাদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা, কাপড় ও আনুষঙ্গিক সব কিছুই সরকার বহন করবে। সুপরিসর জায়গা, গাছগাছালি, পুকুরঘাট শানবাঁধানো সবই আছে। টেলিভিশন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিনোদনের ব্যবস্থাও আছে। নিজের বাড়ির মতো, এমনকি কখনও কখনও তারচেয়েও বেশি সুখ তারা পাবেন। দেশের প্রতিটি শিশু পরিবারেই এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বললেন, অনেক সময় রক্তের সম্পর্ক স্নেহের সম্পর্কের কাছে হার মানে। শিশু পরিবারে থাকাকালীন তারা (বয়স্ক) এতিম শিশুদের কাছ থেকে ভালবাসা পাবেন। কারণ শিশু পরিবারের ‘নিবাসী’ শিশুদের কারও বাবা নেই, কারওবা মা নেই। কারও মা-বাবা কেউ-ই নেই। তারাও বয়স্কদের পেয়ে আপনজন হিসেবে গ্রহণ করবে। স্নেহ-ভালবাসার এই পরিবেশে আপনজনের ভালবাসাবঞ্চিত প্রবীণরা আনন্দের মধ্যে শেষ জীবনের বাকি সময়টুকু কাটাতে পারবেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বয়স্ক নারীর ‘হোম সিকনেস’ (আপন কুটিরে থাকার প্রবণতা বা ফিরে যাওয়ার অসুস্থতা) এতটাই বেশি যে নিজের ঘর ছেড়ে আসতে চান না। তার প্রতি সন্তানের অবহেলা থাকার পরও সন্তানকেই আঁকড়ে রাখতে চান। সোনাতলা এলাকার প্রায় ৭০ বছরের বৃদ্ধা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন- তার চার ছেলেমেয়ের সবার বিবাহিত। কোন সময় ছেলের সংসারে কোন সময় মেয়ের সংসারে থাকতেন। এক সময় লক্ষ্য করলেন কখনও ছেলে কখনও ছেলের বৌ ও জামাই তাকে ভাল চোখে দেখছে না। ব্যথিত হৃদয় নিয়ে স্বামীর ভিটায় ফিরে এলেন। সেই ভিটার ওপর দখলদৃষ্টি ছেলেদের। শত অবহেলার পরও তিনি সন্তানদের ছেড়ে যেতে চান না। আবেগাপ্লুত ওই বৃদ্ধা বলেন ‘ওরা তো আমারই ছেলেমেয়ে। ওরা তাড়িয়ে দিলেও মা কি কখনও সন্তানকে ফেলতে পারে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তবু সেখানেই থাকবেন। শিশু পরিবারে থাকার কথা বললে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে না সূচক জবাব দেন। এ বিষয়ে শিশু পরিবারের উপতত্ত্বাবধায়ক বলেন, তিনি চেষ্টা করেছেন এমন বয়স্কাদের শিশু পরিবারে আবাসনের ব্যবস্থা করে দিতে। এমনও হতে পারে, যারা আসতে চান তারা শিশু পরিবারে যে তাদের আবাসনের সঙ্গে খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে তা জানেন না। সরকারী-বেসরকারী কোন পর্যায়েই প্রচার না থাকায় একাকীত্বের বয়স্করা শিশু পরিবারে যাচ্ছেন না। তিনি জানান, শিশু পরিবারের শিশুদের জন্য যে বরাদ্দ বয়স্কদের জন্য একই বরাদ্দ। প্রতিদিন সকাল ও বিকেলের নাস্তা, দুপুর ও রাতে ভাত দেয়া হয়। যাতে পুষ্টিযুক্ত খাবার পায় সে জন্য মাছ-মুরগি-দুধ-সবজিসহ উন্নতমানের খাবার তালিকায় থাকে। চিকিৎসার জন্য খণ্ড কালীন চিকিৎসক আছেন। বেশি অসুস্থ হলে উন্নত চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক শহীদুল ইসলাম খান জানান, শিশু পরিবারে বয়স্করা থাকতে পারলে উন্নতমানের পরিবেশই পাবেন। একটা ফ্যামিলি বন্ডিং তৈরি হবে।
×