ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

১৯ জনকে শনাক্ত করতে ৩২ স্বজনের ডিএনএ সংগ্রহ

প্রকাশিত: ১১:০০, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

১৯ জনকে শনাক্ত করতে ৩২ স্বজনের ডিএনএ সংগ্রহ

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ সারি সারি লাশের মাঝে খুঁজে ফিরছেন প্রিয়জনকে। পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১৯ জনের মৃতদেহ শনাক্তে ৩২ জন স্বজনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। শনিবারও আরও দু’জনের মরদেহ শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে ৪৮ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গের সামনে বুথ বসিয়ে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ এই নমুনাগুলো সংগ্রহ করেন। সিআইডির এ্যাসিস্ট্যান্ট ডিএনএ এ্যানালিস্ট নুশরাত ইয়াসমিন সংবাদ সম্মেলনে জানান, শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ১৯ জনকে শনাক্ত করতে ৩২ জন স্বজনের ডিএনএ নমুনা নেয়া হয়েছে। যারা এখনও স্বজনদের খুঁজে পাননি তাদের নমুনা দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি। আমাদের ল্যাবে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। রবিবার পর্যন্ত ডিএনএ নমুনা নেয়া হবে। এদিন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার এ কে এম আলী আজম বলেন, চকবাজারের আগুনে পুড়ে মোট ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পরিচয় শনাক্ত হওয়া ৪৬ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দু’জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এ নিয়ে ৪৮ মরদেহ শনাক্ত করা হয়েছে। এসব মরদেহ তাদের স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পর শনিবার একজনের বিচ্ছিন্ন হাত উদ্ধার করা হয়। হাতটি নিহত ৬৭ জনের কারও, না অন্য কারও তা বলা যাচ্ছে না। পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গুদাম সরানোর বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে আলী আজম বলেন, এ বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসন ও শিল্প মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে। খুব শীঘ্রই তা বাস্তবায়ন করা হবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (ফরেনসিক) রুমানা আক্তার। তিনি বলেন, আমরা ডিএনএ’র নমুনা সংগ্রহ করেছি। ঘটনার পর থেকে তিনদিন ধরে নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গের সামনে ভিড় জমান তারা। শনিবার সকালে স্বামী রিক্সাচালক নূরুজ্জামান হাওলাদারের খোঁজে ঢামেক মর্গে সামনে আসেন শিরিন আক্তার। তার পাঁচ মাস বয়সী শিশু আবুল হোসেন কোলে ছিল। অঝুঝ শিশু আবুল হোসেন নিয়ে তিনদিন ধরে দ্বারে দ্বারে ছুটে বেড়িয়েছেন। কখনও মর্গের সামনে, কখনও তথ্য ডেক্সে আবার কখনও শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মর্গে ঘুরে ফিরছেন। কোথাও স্বামীকে খুঁজে পাননি। শনিবার সকালে নূরুজ্জামানকে শনাক্ত করার জন্য তার পাঁচ মাস বয়সী শিশু ছেলে আবুল হোসেনের গালের মাংস ও স্ত্রী শিরিন আক্তারের রক্ত সংগ্রহ করেছেন সিআইডি টিমের সদস্যরা। তাদের ডিএনএ পরীক্ষা করে নিখোঁজ নূরুজ্জামানের পরিচয় শনাক্ত করা যাবে। এ সময় শিরিনের পাশে থাকা নিখোঁজ নূরুজ্জামানের বোন জানান, ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার সকালে খেয়ে রিক্সা নিয়ে রেব হন নূরুজ্জামান। সাধারণত বিকেলেই বাসায় ফেরেন। কিন্তু ওইদিন ৯টার দিকেও ফেরেননি। তখন তার মোবাইল ফোনে কল দেয়া হয়। তিনি বলেন, বারবার কল দেয়ার পর ওইদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে ভাই (নূরুজামান) ফোন ধরে। সে জানায়, জ্যামে আছে চকবাজারে বলেই ফোন কেটে দেয়। এরপর কিছুক্ষণ পর থেকেই তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। নূরুজ্জামানের বোন বলেন, রাত ১১টায় টিভিতে খবর দেখি আগুনের। পরে ওইদিন রাত ১২টায় আমরা নারায়ণগঞ্জ থেকে চলে আসি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে সারারাত ছিলাম। ভাইরে খুঁইজ্যা পাই নাই। শুক্রবারও খোঁজ করছি। বিকেলে চইল্যা যাই। আইজ (শনিবার) আবার সকালে আইছি। ডিএনএ নমুনা দিতে বলছে, আমরা নমুনা দিয়েছি। এখন মিটফোর্ড হাসপাতালে যাব। লাশ দেখতে, যদি আমার ভাইরে পাই। মর্গের সামনে দুই হাতে নিখোঁজ ভাই এনামুল হকের পাসপোর্ট সাইজের দুটো ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বোরকা পরা এক তরুণী রোজিনা। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন তার বৃদ্ধ বাবা। ছেলের হারানো শোকে মুহ্যমান এই বৃদ্ধ জানান, তার ছেলের নাম এনামুল হক। বুধবার রাতে চকবাজারের সাকুরা মার্কেটে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে রিক্সায় কেরানীগঞ্জের বাসায় ফেরার পথে নিখোঁজ হন। গত তিনদিন ধরে প্রতিদিনই চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলে ছুটে আসছেন। যদি ছেলের খোঁজ মেলে সে আশায়। অসহায় হয়ে তিনি বলেন, ছেলের লাশটাও কি পামু না? নিখোঁজের বোন রোজিনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, ভাইটা কি বাঁইচ্যা আছে? আগুনে পুড়ে না জানি কত কষ্ট পাইছে। সকালে সিআইডি তাদের ডিএনএ নমুনা নিয়েছেন। এরকমই মর্গের সামনে বুথ বসিয়ে নিখোঁজের খোঁজে ৩২ জন স্বজনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছে সিআইডি। ৪৮ জনের লাশ হস্তান্তর ॥ রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা চৌরাস্তায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ৬৭ জনের মধ্যে ৪৮ জনের পরিচয় মিলেছে। তাদের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। শনিবার ঢামেক কলেজ মর্গে থেকে দুটি মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। এদিন সকাল ১১টার দিকে ঢামেক মর্গে জামা আর ট্রাউজারের টুকরো দেখে আনোয়ারকে চিনেছেন তার পরিবার। তার বড় ভাই সাজ্জাদুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনার সারাদিনই তার ভাই তার সঙ্গেই ছিলেন। পুরো দেহ পুড়ে গেলেও কনুইয়ের কাছে জামার একটি টুকরো ও পরনে ট্রাউজারের একটি টুকরো ছিল। তা দেখে তিনি ভাইকে শনাক্ত করতে পেরেছেন। আনোয়ার হোসেনের লাশ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের মর্গে ছিল। সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সেলিম রেজা জানান, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটসহ মৃতদেহের দাবিদারকে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মৃতদেহ বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে লাশটি হস্তান্তর করা হয়েছে। এদিকে চকবাজার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) (ডিএমপি-ঢাকা) মুনশি আবদুল লোকমান জানান, সকালে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি থানার নাটেশ্বর ইউনিয়নের মির্জানগর গ্রামের আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর লাশ শনাক্তের পর একই গ্রামের মোঃ জাফর আহমেদের মরদেহ শনাক্ত করেছে তাদের পরিবার। মঞ্জুর মরদেহ নম্বর ৪১ ও জাফরের ৬১। তাদের মরদেহ দেখে শনাক্ত করা হয়েছে। নিখোঁজ জাফর আহমেদের বড় ছেলে রাজী আহমেদ জানান, বাবা জাফর প্লাস্টিক ব্যবসায়ী ছিলেন। কাঁচামাল কিনতে সেদিন বুধবার রাতে চকবাজার গিয়েছিলেন তিনি। ঘটনার পর থেকে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। তারা ঘটনাস্থলসহ হাসপাতালে এই তিনদিন খুঁজে বেরিয়েছেন। শুক্রবার রাতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে বাবার জাফরের মরদেহ শনাক্ত করেন। রাজী বলেন, বাবার পরনের শার্ট দেখে শনাক্ত করেছি। ডিএনএ নমুনাও নেয়া হয়েছে। তিনি জানান, শনিবার জেলার প্রশাসন বাবা জাফর আহমেদের লাশ বুঝিয়ে দেন। পরে ঢামেক মর্গে জেলা প্রশাসনের বুথের সামনে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার এ কে এম আলী আজম জানান, চকবাজারের আগুনে পুড়ে ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শুক্রবার পর্যন্ত পরিচয় শনাক্ত হওয়া ৪৬ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিদের মধ্যে দু’জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তার নাম আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। চুড়িহাট্টার হায়দার মেডিক্যাল সেন্টারের মালিক ছিলেন তিনি। আরেকজন জাফর আহমেদ। তিনি প্লাস্টিক ব্যবসায়ী। শনিবার স্বজনদের কাছে তাদের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান তিনি। জেলা প্রশাসন বুথ থেকে জানা গেছে, অশনাক্ত মরদেহের মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চারটি, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চারটি, কুর্মিটোলায় তিনটি, হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পাঁচটি ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের ফ্রিজে তিনটি মরদেহ রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলায় দেশের বৃহৎ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে ফ্রিজ নষ্ট থাকায় ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ মরদেহগুলো বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়। এদিকে শুক্রবার ৪৬টি মরদেহ শনাক্ত করা হয়েছে। পরে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত বৃহস্পতিবার ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার রতন কুমার দেবনাথ জানান, পোড়া ওই ভবনে তল্লাশির অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার সকালে ৯টার দিকে তিনি বেজমেন্টের দরজা খোলেন। সারি সারি ড্রাম ও বস্তার স্তূপ দেখতে পান। ভেতরে ঢুকে বিশাল এ্যামাউন্টের এই রাসায়নিক দ্রব্য আর প্লাস্টিক রোলের এই মজুদ পাই। এখানে আছে বিভিন্ন ধরনের পিগমেন্ট। জাপান, ভারত, চীন ও অস্ট্রিয়া থেকে এগুলো আমদানি করা হয়েছে। রতন জানান, কাপড়ের রং হিসেবে ব্যবহৃত এসব উপাদান খুবই দাহ্য। এখানে যদি আগুন লাগত, তাহলে আগুনের ব্যাপকতা বিশাল আকার ধারণ করত, আগুন নেভাতেও বেগ পেতে হতো। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সেদিন চুড়িহাট্টার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের প্রায় ১৫ ঘণ্টা সময় লাগে। জীবন্ত দগ্ধ হন ৬৭ জন। এর মধ্যে ওয়াহেদ মঞ্জিলের নিচতলাতেই একসঙ্গে ২৪টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। যার মধ্যে দুই বছরের শিশু ও নারীও ছিল। সিঁড়ি ঘরের ফ্লোরে দলা পাকানো অবস্থায় ছিল পোড়া লাশগুলো।
×