ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নোয়াখালীরই দশজন চক ট্র্যাজেডির শিকার

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 নোয়াখালীরই দশজন চক ট্র্যাজেডির শিকার

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ জীবিকার টানে রাজধানীতে এসে পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় বিভিন্ন দোকান-কারখানায় কাজ করতেন যারা, তাদের অনেকেই বুধবার রাতে দোজখী যন্ত্রণায় ভুগে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। সেদিনের চকবাজার ট্র্যাজেডির অসহায় শিকার হতভাগাদের মধ্যে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর শিকার হয়েছেন বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার সন্তানেরা। এছাড়া ভ্যানেই পুড়ে মারা গেছে কুড়িগ্রামের তিন যুবক। নাটোরের এক রিক্সাচালক রয়েছে মৃতের তালিকায়। আর অন্যান্য জেলার মানুষ তো রয়েছেই। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের। জানা গেছে, চকবাজারে অগ্নিকা-ে নোয়াখালীর সোনাইমুড়িসহ বিভিন্ন উপজেলার নিহতদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। স্বজন হারানোর বেদনায় মুহ্যমান পরিবারের সদস্যরা। বৃহস্পতিবার রাত ও শুক্রবার সকাল থেকে স্ব স্ব এলাকার নিহতদের কয়েকজনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। স্বজন ও স্থানীয়দের তথ্য মতে, অগ্নিকান্ডে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি, কোম্পানীগঞ্জ ও বেগমগঞ্জ উপজেলার নিহতদের মধ্যে মোট দশজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে সোনাইমুড়ির নাটেশ্বর ইউনিয়নের ঘোষকামতা গ্রামের খাসের বাড়ির সাহেব আলীর দুই ছেলে মাসুদ রানা (৩৬) ও মাহাবুবুর রহমান রাজু (২৮), পশ্চিম নাটেশ্বর গ্রামের মিনহাজী বাড়ির মৃত ভুলু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ আলী হোসেন (৬৫), নাটেশ্বর গ্রামের সৈয়দ আহমদের ছেলে হেলাল উদ্দিন, মির্জা নগর গ্রামের আবদুর রহিম বিএসসির ছেলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (৩৮), মমিন উল্যার ছেলে সাহাদাত হোসেন হিরা (৩২), মৃত গাউছ আলমের ছেলে নাছির উদ্দিন (৩২) ও পার্শ্ববর্তী বারোগা ইউনিয়নের দৈলতপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে আনোয়ার, বেগমগঞ্জ উপজেলার মুজাহিদপুর গ্রামের কামাল হোসেন ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরএলাহী গ্রামের জসিম উদ্দিন। নিহতদের মধ্যে শুক্রবার সকাল ৮টায় পূর্ব নাটেশ্বর গ্রামের হেলাল উদ্দিন, ৯টায় ঘোষকামতা গ্রামের মাসুদ রানা ও মাহাবুবুর রহমান রাজুর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় বেগমগঞ্জের মুজাহেদপুরে কামাল হোসেন, কোম্পানীগঞ্জের জসিম উদ্দিন ও ৩টার দিকে পশ্চিম নাটেরশ্বর গ্রামের মৃত ভুলু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ আলী হোসেনেরও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া দিনের বিভিন্ন সময়ে বাকিদের জানাজা সম্পন্ন হবে। এদিকে নিহতদের স্বজনরা জানান, ভয়াবহ এ অগ্নিকা-ে নোয়াখালীর অনেকের নিহত হওয়ার খবরে স্বজন ও এলাকাবাসী নিহতদের বাড়িতে সমাগম হলেও আসেননি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কেউ। কুড়িগ্রাম ॥ জেলার হতদরিদ্র তিন যুবক কাজের সন্ধানে গিয়েছিলেন ঢাকায়। কাজ করত একটি জুতার দোকানে। বুধবার রাত দশটায় জুতার দোকান থেকে মালামাল নিয়ে অন্য দোকানে ডেলিভারি করতে যাওয়ার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণের শিকার হন। ভ্যানেই দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান হতভাগ্য ৩ যুবক। নিহতরা হলেন- নাগেশ্বরী উপজেলার আবু বক্করের পুত্র খোরশেদ আলম (২২), একই উপজেলার হাজিপাড়া গোবর্ধনকুঠি গ্রামের রাজু মিয়া (১৮) ও সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের শিবের চর মাঠের পাড় এলাকার আব্দুল কাদেরের পুত্র সজিব (২৩)। ঢাকার চকবাজার ট্রাজেডির শিকার কুড়িগ্রামের এই ৩ জনের মরদেহ পারিবারিকভাবে দাফন করা হয়। শুক্রবার সকালে গ্রামের বাড়িতে তাদের লাশ এসে পৌঁছালে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, এরা সকলেই চকবাজার এলাকায় ছোটবেলা থেকেই একটি জুতার দোকানে কাজ করত। খোরশেদ আলমের মামা নবিউল্লাহ জানান, খোরশেদ আলম বাবার একমাত্র ছেলে। তার বাড়ি ভিটা ৬ শতক জমি ছাড়া কোন সহায় সম্বল নেই। জুতার দোকানে কাজ করে সে দিনমজুর বাবাকে সাহায্য করত। অপরদিকে, রাজু মিয়ার ভাই মাসুদ জানান, তারা দুই ভাই। বাবা মারা যাওয়ার পর রাজু চলে যায় ঢাকায় জুতার দোকানে কাজ করতে। মাসুদ ভ্যান চালান। বাড়ি ভিটা ছাড়া তাদের কোন জমি নেই। এছাড়া সজিব ওই জুতার দোকানে কাজ করে প্রায় এগারো বছর ধরে। তাদেরও বাড়ি ভিটা ছাড়া কোন জমি নেই। তার পিতা আব্দুল কাদের বলেন, আমার একমাত্র ছেলে তাও চলে গেল। এখন কাকে নিয়ে বাঁচব। নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মরদেহ দাফনের জন্য প্রত্যেক পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঢাকায় বিশ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন জানান, দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তাদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। নাটোর ॥ ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে হতাহতদের এক জনের বাড়ি নাটোরের সিংড়া উপজেলার হাতিয়ানদহ ইউনিয়নের পাটকান্দি গ্রামে। শুক্রবার সকাল থেকে রিক্সাচালক সাইফুল ইসলামের বাড়িতে চলছে মাতম। নিহেতর বাড়িতেই স্বজনদের আহাজারি করতে দেখা যায়। সাইফুলের সঙ্গে রিক্সা চালাতে অন্য যারা ঢাকাতে গেছে তাদের কেউ কোন সন্ধানই পাচ্ছেন না, তারা বেঁচে আছেন কি না মরে গেছেন তাও জানেন না। বাবা কৃষক আব্দুল কাদেরের অভাবের সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে স্ত্রী ও সন্তানকে রেখে ঢাকায় রিক্সা চালাত সাইফুল। কিন্তু চকবাজারের আগুন কেড়ে নিয়েছে তার প্রাণ। শুক্রবার ভোরে মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আসতেই শোকের ছায়া নেমে আসে গ্রাম জুড়ে। অপরদিকে, বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে নিহত সাইফুলের লাশ নিজ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। লাশ বাড়িতে আনার পরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন নিহতের স্বজনরা। পরে শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে নিজ গ্রামে জানাজা শেষে পাটকান্দি কবরস্থানে নিহত সাইফুলের দাফন করা হয়। এদিকে, স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, শুধু সিংড়ার সেরকোল, পুঠিমারী, কুশাবাড়ী, নতুন পাড়া, নলবাতা, নীলচরা, পাটকান্দি, সাঐল, লাড়ুয়া, ধুলিয়াডাঙ্গা, কয়েক শ’ লোক ঢাকার চকবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যবসা করেন। তাদের দাবি উক্ত ঘটনায় হতাহতের মধ্যে আরও অনেকে থাকতে পারে। নিহত সাইফুলে চাচাতো ভাই রতন আলী ও বড় ভাই হাসান আলী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে গলার মালা ও পায়ে চিহ্ন দেখে নিহত সাইফুলের মৃতদেহ শনাক্ত করে। সাইফুলের স্ত্রী খালেদা ও দুই মেয়ে খাদিজুল (৭) সাদিয়া (৫) নিয়ে চিন্তিত হয়ে পরেছেন তার বাবা আব্দুল কাদের। কারণ তার ছেলের আয় রোজগার দিয়েই চলত ছয় জনের সংসার খরচ। অসহায় এই পরিবারের প্রতি সহযোগিতায় সরকার এগিয়ে আসবেন এমনটাই প্রত্যাশা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ফরদাবাদ গ্রামে ডাঃ আশরাফুল হক রাজন ঢাকার চকবাজারে অগ্নিকা-ে মারা যান। তিনি চকবাজারে গিয়েছিলেন এক বন্ধুর সঙ্গে। মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করে তার ছোট ভাই মোঃ ফখরুল হক সুজন। তার মৃত্যুর খবর তার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে তার আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। শুক্রবার তার গ্রামের বাড়ি ফরদাবাদে ৮টায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাকে পরিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
×