ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

২১ জনের লাশ শনাক্ত হয়নি, স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ চলছে

প্রকাশিত: ১০:৩৯, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

  ২১ জনের লাশ শনাক্ত হয়নি, স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ চলছে

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২১ জনের লাশ এখনও শনাক্ত করা যায়নি। লাশ শনাক্ত করার প্রক্রিয়া হিসেবে নিহতদের স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গের সামনে বুথ বসায় সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ। বিকেল ৩টা পর্যন্ত ১৫ মরদেহের দাবিদার ২০ স্বজনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেন তারা। সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের সহকারী এ্যানালিস্ট নুসরাত ইয়াসমিন জানান, শনাক্ত করা যায়নি এ রকম ১৫টি লাশের দাবি নিয়ে ২০ জন তাদের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। তাদের ডিএনএ নমুনা আমরা সংগ্রহ করেছি। তিনি জানান, নিয়মিত মৃতদেহের নমুনা দিয়ে শনাক্ত করা হলেও অগ্নিদগ্ধদের ক্ষেত্রে তা সময়সাপেক্ষ। যারা ডিএনএ নমুনা দিতে এসেছেন, তাদের রক্ত ও মুখের ভেতর থেকে কোষ সংগ্রহ করা হচ্ছে। মৃতদেহ থেকে হাড় ও দাঁতের নমুনা নেয়া হয়েছে। মৃতদেহ শনাক্ত করতে এক থেকে ৬ মাস সময় লাগবে। আগামীকাল (শনিবার) পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বুথ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে। এরপর মালিবাগ সিআইডিতে যোগাযোগ করতে হবে। মৃতদেহের নমুনা দেয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবা বা স্বামী, স্ত্রী বা সন্তানকে আসার অনুরোধ করেছেন সিআইডির সহকারী ডিএনএ এ্যানালিস্ট। তাদের কাউকে পাওয়া না গেলে ভাই বা বোন আসতে পারেন। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুমানা আক্তার জানান, যাদের চেনার উপায় নেই, তাদের পরিচয় শনাক্তের বিষয়টি এখন ডিএনএ স্যাম্পলের উপরই নির্ভর করছে। এ পরীক্ষার জন্য তিন থেকে চার সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। নিখোঁজদের স্বজনরা যতদিন পর্যন্ত আসবেন, ততদিন পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহের এই কাজ অব্যাহত থাকবে। সিআইডি বিশেষ পুলিশ সুপার রুমানা জানান, চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে জীবন্ত দগ্ধ ৪৬ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি ২১টি মরদেহ শনাক্তে নিহতদের স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করছেন সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের কর্মীরা। এদিকে শুক্রবার সকাল থেকে নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে মর্গের সামনে ভিড় জমান। এদিন মামার কোলে চড়ে মায়ের খোঁজে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে এসেছে পাঁচ বছরের সানিন। সানিন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ওদিন বাড়ির নিচে গিয়েছিল মা। এরপর আর মা ফিরে আসেনি। কোথায় গেল মা। দু’দিন ধরে সে তার মাকে খুঁজে ফিরছে। সবাই বলছে, তার মা আর নেই। সানিনের পাঁচ মাস বয়সী ছোট্ট বোনটাও সারাক্ষণ কাঁদছে। বুধবার রাতে রাজধানীর চকবাজারে চুড়িহাট্টা চৌরাস্তায় আগুনের ঘটনায় সানিনের মা বিবি হালিমা বেগম শিলা নিখোঁজ রয়েছেন। মাকে খুঁজে পেতে তার শিশু মেয়ে সানিনের মুখের লালা ডিএনএ নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করেছেন চিকিৎসকেরা। চকবাজারে আগুনের ঘটনায় ডিএনএ নমুনা দিতে হাসপাতালে আসা স্বজনদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে ছোট ছোট কষ্টের গল্প। চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের স্থান থেকে ২০০ গজ দূরেই পরিবার নিয়ে থাকতেন শিলা। শিলার স্বামী মোহাম্মদ সুমন। তিনি চকবাজারেই ব্যাগের ব্যবসা করেন। বুধবার রাতের আগুন তাদের বাসা পর্যন্ত যায়নি। তবে ‘ভাগ্য’ শিলাকেই আগুনের কাছে নিয়ে গেছে। মর্গে শিলার বোনের স্বামী মোঃ বেলাল হোসেন জানালেন, ঘটনার দিন রাতে সানিন একটু অসুস্থ ছিল। তার বাবা সুমন ছিলেন কর্মস্থলে। তাই শিলা তার এক বোন ও দুই শিশুসন্তানকে বাসায় রেখে নিচে গিয়েছিলেন ওষুধ কিনতে। সেই যে গেলে। আর ফিরে আসেনি বলে জানান বেলাল হোসেন। পরিবারের সদস্যদের ধারণা, নিচে ওষুধ কিনতে গিয়ে শিলা হয় তো ভয়াবহ আগুনের শিকার হন। হয় তো তিনি আর নেই। শনাক্ত না হওয়া লাশের ভেতরে শিলা থাকতে পারেন, এমনটা ভেবে ডিএনএ নমুনা দিতে এসেছেন তাঁরা। বেলাল হোসেন জানান, শিলারা পাঁচ বোন ও তিন ভাই। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে তাঁদের গ্রামের বাড়ি। এদিকে ছেলের নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রোহানের ছবি হাতে তার মা ডিএনএর নমুনা দিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন। চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখনও নিখোঁজ রয়েছেন তার ছেলে রোহান। বৃহস্পতিবার থেকেই ঢামেক মর্গের সামনে কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়াচ্ছিল রোহানের মা-বাবা। শুক্রবার সকাল থেকে মর্গের সামনে ছেলে হারানোর শোকে মুহ্যমান এই বাবা-মাকে। একমাত্র ছেলে রোহানের মরদেহ না পেলেও ফিরে পেতে চান শরীরের এক টুকরো অংশ। ছেলের হারনো বেদনায় বিলাপ করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন রোহানের মা। আবার পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরে আনা হয়। আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, আমার ছেলেডারে আইনা দাও। আমি জানি অয় নাই। অর লাশ লাগব না। শরীরের একটা টুকরো দেন। আমি ওইডা নিয়াই বাচুম। রোহানের বাবা বলেন, গতকাল (বৃহস্পতিবার) সারারাত ছিলাম। খুঁইজা পাই নাই। সারারাত ওর মা ঘুমায় নাই। সকালে আসার পর জেলা প্রশাসনের তথ্যকেন্দ্র থেকে সিআইডি টিম আসার জন্য অপেক্ষা করতে বলছিল। তারা আসার পর আমাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছে। এখন অপেক্ষা করতে বলছে। দেখি কি হয়। একই সময় ভাই লিপু, ভাবী নাসরিন আর ভাতিজা আফতাহীর খোঁজে মর্গে আসেন লিপুর ভাই ইসমাইল হোসেন। ভাই লিপুর ডিএনএ নমুনা দেন তিনি। এরপর ভাবী নাসরিন আক্তারের নমুনা দেন তার ভাই আনোয়ার হোসেন রনি। বোনের নমুনা দিয়ে আনোয়ার হোসেনের আহাজারি সেখানকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। ঘটনার দিন গত বুধবার রাতে অফিস শেষে এক রিক্সায় বাসায় ফিরছিলেন সালেহ মোহাম্মদ লিপু আর স্ত্রী নাসরিন আক্তার তাদের ছেলে আফতাহীকে (৮) নিয়ে। সর্বশেষ বাসা থেকে তিন মিনিট দূরত্বে চুড়িহাট্টা চৌরাস্তায় যানজটে আটকে ছিলেন। এরপর আর খোঁজ মেলেনি তাদের। সেদিনের আগুনে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মোঃ ইসমাইল (৬৫) জীবন্ত দগ্ধ হন। নিখোঁজ বাবা ইসমাইলের সন্ধান পেতে ছেলে সোহরাব ডিএনএ নমুনা দিয়েছে সিআইডির কাছে। ইসমাইলের ছোট ভাই মোঃ মোশারফ হোসেন জানান, আমার বড় ভাই ইসমাইল। ঘটনাস্থলে তখন তিনি আমার মেজ ভাইয়ের দোকানে চা খেতে গিয়েছিল। চা খেয়ে আসছিল ওই রাস্তা দিয়ে। তখনই হয়তো মারা গেছেন। এখন ডিএনএ টেস্টের জন্য আমার ভাতিজা সোহরাবের ডিএনএ দিয়েছি। এ রমকই ১৫টি মরদেহের দাবিদার ২০ স্বজনের ডিএনএ নমুনা দিয়েছে সিআইডি’র কাছে। বাকিটা শুধু অপেক্ষা। ৪৬ লাশ হস্তান্তর ॥ ঢাকার জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জানান, নিহতদের মধ্যে ৪৬টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৪৬ জনের মরদেহ নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১৮টি লাশ অন্য চার মেডিক্যাল কলেজের হিমঘরে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চারটি, কুর্মিটোলায় তিনটি, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যালে পাঁচটি এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যালে পাঁচটি লাশ রাখা হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক। মরদেহ সমাহিত করার জন্য ঢাকা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। নিহত যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে ॥ কামাল হোসেন (৪৫), পিতা নূর মোহাম্মদ, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী, অসি উদ্দিন (২৩), পিতা নাসির উদ্দিন, ধানমণ্ডি, ঢাকা, মোশাররফ হোসেন (৪৩), পিতা মোঃ মাহফুজুর রহমান, নোয়াখালী, হাফেজ মোঃ কাউসার আহমেদ (২৬), পিতা মোঃ খলিলুর রহমান, শ্রীপুর, হোমনা, কুমিল্লা, আলী হোসেন (৬৫), পিতা মৃত বুলু মিয়া, নাটেশ্বর, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী, মোঃ ইয়াসিন (৩৩), পিতা মৃত আবদুল আজিজ, ১৭ কেবি রোড, চকবাজার, ঢাকা, শাহাদৎ হোসেন (৩০), পিতা মৃত মোসলেম উদ্দিন, নারায়ণপুর, ব্রাহ্মণপাড়া, কুমিল্লা, আবু বকর সিদ্দিক (২০), মোহাম্মদপুর, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর, জুম্মন (৫২), ৩২/৩২ ওয়াসা রোড, চকবাজার ঢাকা, মজিবুর হওলাদার (৫০), সন্তোষপুর, মির্জাগঞ্জ, পটুয়াখালী হেলাল উদ্দিন (৩২), নাটেশ্বর, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী, আশরাফুল হক (২০), পিতা মৃত জামশেদ মিয়া, ফরহাদাবাদ, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ইমতিয়াজ ইমরোজ রাসু (২২), পিতা নজরুল ইসলাম, বেড়া, পাবনা, মোঃ সিদ্দিক উল্লাহ (৪৫), নাটেশ্বর, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী, মাসুদ রানা (৩৫), পিতা সাহেব উল্লাহ, নাটেশ্বর, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী, অপু রায়হান (৩১), ৪৬/২, ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, চকবাজার, ঢাকা, আরাফাত আলী (৩), পিতা মৃত মোহাম্মদ আলী, ৪৬/২, ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, চকবাজার, ঢাকা, মোহাম্মদ আলী (২২), ৪৬/২, ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, চকবাজার, ঢাকা, মাহবুবুর রহমান রাজু (২৯), পিতা সাহেব উল্লাহ, নাটেশ্বর, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী, এনামুল হক কাজী (২৮), পিতা মোতালেব কাজী, রামপুর, মির্জাগঞ্জ, পটুয়াখালী, সিয়াম আরাফাত (১৯), পিতা মোঃ ইসমাইল, ৪ নাজিমউদ্দিন রোড, বংশাল, ঢাকা, ওমর ফারুক (৩০), পিতা আবদুল করিম, মুন্সিকান্দি, নড়িয়া, শরীয়তপুর, সোলায়মান (২৫), মধুপুর, টাঙ্গাইল।
×