ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভুতুড়ে এলাকা চক

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ভুতুড়ে এলাকা চক

গাফফার খান চৌধুরী ॥ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণেই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে চকবাজারে ৬৭ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ও ৪১ জনের দগ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ওয়াহেদ ম্যানশনে কেমিক্যালের বড় গুদাম ও আশপাশের ভবনে প্লাস্টিকের দানার গুদাম থাকায় হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে। গুদামে কেমিক্যাল না থাকলে আগুন ভয়াবহ রূপ নিতে পারত না। প্লাস্টিকের দানা গলে রাস্তায় ছড়িয়ে আঠায় মানুষের পা আটকে গিয়েই মূলত মর্মান্তিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সবাই। তদন্ত কমিটির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য। ইতোমধ্যেই তদন্ত কমিটি আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ছয়টি বাড়িকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সামনে লালফিতা দিয়ে ঘেরাও করে বাড়ির সামনে নোটিস ঝুলিয়ে দিয়েছে। বাড়িগুলো বসবাসের অযোগ্য বলে নোটিসে বলা হয়েছে। এ ঘটনায় ওয়াহেদ ম্যানশন নামের বাড়ির মালিকের দুই ছেলেসহ অজ্ঞাত ১০/১২ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি মনিটরিং করছে। নিহতদের স্মরণে এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনায় দেশের প্রতিটি মসজিদে জুমার নামাজের পর বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। এলাকায় বিদ্যুত, গ্যাস ও পানি না থাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পুরো এলাকায় ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় এলাকাবাসীর মধ্যে রীতিমত ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করতে অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরনো ঢাকা থেকে সব রাসায়নিক গুদাম সরানোর কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গঠিত তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরির্দশন করেছে। তারা যেকোন মূল্যে পুরনো ঢাকায় কেমিক্যালের গুদাম সরানোর জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। চুড়িহাট্টার বাসিন্দা প্রত্যক্ষদর্শী তারিক হাসান (৫৬) বলছিলেন, ঘটনার সময় তিনি মদিনা ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে গিয়েছিলেন। মদিনা ফার্মেসি হচ্ছে, যে ছয়টি বাড়ি মারাত্মকভাবে পুড়ে যাওয়ার কারণে পরিত্যক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে তার মধ্যে ৬১ নম্বর বাড়িটি। মদিনা ফার্মেসি বাড়িটির নিচতলায়। ওষুধ কিনে আমি মোড় ঘুরে পশ্চিম দিকে যাচ্ছি। এ সময় একটি বিকট শব্দ হয়। শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি মাইক্রোবাসে আগুন ধরে যায়। দেখা গেল একটি পিকআপ ওই মাইক্রোবাসটিকে পেছন থেকে মেরে দিয়েছে। যে জায়গায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরেছে, তা থেকে তার দূরত্ব মাত্র ১০ থেকে ১৫ হাত। মুর্হূতেই সিলিন্ডারে ধরা আগুন সামনের পিকআপে থাকা গ্যাস সিলিন্ডারে ধরে যায়। তা থেকে আগুন ধরে রাজ হোটেলের নিচে থাকা সিলিন্ডারে। চোখের পলকে পুরো এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আমি চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের দক্ষিণ দিকের যে গলিতে দাঁড়িয়েদিলাম, সেখান থেকে সরে একটু ভেতরের দিকের গলিতে গিয়ে অবস্থান নেই। সেখান থেকে পুরো আগুন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে এর পর লাগে মসজিদের সামনে থাকা বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার ও তারে। এর পর আগুন ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলায় থাকা কেমিক্যালে লেগে যায়। এতক্ষণ পর্যন্ত আগুন দূর থেকে দেখা সম্ভব ছিল। অর্থাৎ আগুনের তান্ডব অতটা ছড়ায়নি। দূর থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। তখন চুড়িহাট্টা মোড়ে যানজটে আটকে থাকা লোকজন যে যার মতো সরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু যানজট এতটাই তীব্র ছিল যে, মানুষ ভেতর থেকে বের হতে পারছিল না। কেমিক্যালের গুদামে আগুন লাগার আগ পর্যন্ত যানজটে আটকে থাকা লোকজনের ধারণা ছিল, তারা বের হতে পারবেন। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে তারা সেখান থেকে হয়ত সরে যেতে পারবেন। এজন্য সরে যাওয়ার ব্যাপারে অনেকের তেমন তৎপরতাও দেখা যাচ্ছিল না। কেমিক্যালের গুদামে আগুন লাগার পর আর সেই আগুন ভবনের উপরের দিকে উঠতে থাকায় বডি স্প্রের বোতল বিস্ফোরিত হয়ে পুরো এলাকায় মারাত্মকভাব্ েছড়িয়ে পড়ে। এ সময় যানজটে আটকে থাকা লোকজন চিৎকার করতে করতে বাঁচার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে ঘটে যায় অন্য ঘটনা। আগুনের তাপে প্লাস্টিকের দানা গলে লাভার মতো হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। যানজটে আটকে থাকা লোকজন রিক্সা বা গাড়ি বা ভ্যান বা প্রাইভেটকার থেকে সরে যাওয়ার জন্য নিচে পা রাখে। সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিকের দানা গলে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়া আঠায় পা আটকে যায়। এতে করে কেউ আর সেখান থেকে নিজেদের পা সরিয়ে বের হতে পারেননি। এ কারণে যে যেখানে যে অবস্থায় সেই অবস্থায়ই তাদের মৃত্যু হয়। উদ্ধারকালে কারও লাশ বসা অবস্থায়, কারও দাঁড়ানো অবস্থায় ঢলে পড়ে মারা যাওয়ার লক্ষণ দেখা গেছে। মাহিন নামের একটি শিশুর প্লাস্টিকের দানা গলে যাওয়া আঠায় পা আটকে যায়। শিশুটি পা তোলার অনেক চেষ্টা করেও পারেনি। সেখানেই বসে পড়ে। বসা অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়েছে। এভাবেই মৃত্যু হয়েছে সবার। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ জানান, ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনের দিকের গলিতে রিক্সা থেকে লাফিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল ২৫ জন। সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। তাদের লাশ সেই গলি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস যে ৬৭ জনের লাশ উদ্ধার করেছে, তাদের অধিকাংশের লাশ চুড়িহাট্টা মোড়ে ছিল। এতে ধারণা করা হয়, যানজটে আটকে পড়া লোকের মারা গেছেন। তারা আর আগুনের ভয়াবহতার কারণে সরে যেতে পারেননি। হোটেলের ভেতরে খেতে গিয়েও অনেকেই মারা গেছেন। প্রাইভেটকার, সিএনজি, অটোরিক্সা, মাইক্রোবাস, পিকআপসহ যে যে গাড়ির ভেতরে ছিল, তাদের সেখানেই মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ কেমিক্যালে আগুন লাগার পর তা এতটাই দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে যে, কেউ আর তাদের অবস্থান পরিবর্তন পর্যন্ত করতে পারেননি। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) তদন্ত কমিটিও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কেমিক্যালের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে। শুক্রবার সকালে ডিএসসিসির ১১ সদস্যের দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ও ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (উন্নয়ন) লে. কর্নেল এসএম জুলফিকার রহমান জানান, ভবনের ভেতরে গ্যাস লাইটার রিফিলের পদার্থ ছিল। এটা নিজেই একটা দাহ্য পদার্থ। এছাড়াও অন্যান্য কেমিক্যাল ছিল। যা আগুন দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। পারফিউমের বোতলে রিফিল করা হতো এখানে। সেই বোতলগুলো ব্লাস্ট হয়ে বোমার মতো কাজ করেছে। তদন্ত কমিটির সদস্য ও বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী জানান, ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিম ও কলামগুলো বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩ ও ৪ তলার বিম ও কলাম তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সপ্তাহখানেক পরে বাড়িটি ব্যবহারের উপযোগী কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। বাড়িটিতে গোডাউন থাকলেও আগুন নেভানোর কোন যন্ত্রপাতি ছিল না। যে ছয়টি বাড়ি আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়নি। রাজউকের অথরাইজড অফিসার ও কমিটির সদস্য মোঃ নুরুজ্জামান জহির জানান, ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ভবনগুলো রাজউকের অনুমোদন নিয়ে তৈরি হয়েছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ডিএনসিসির কমিটির প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম জানান, আগুনে ছয়টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছয়টিই প্রাথমিকভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী বলে মনে হচ্ছে। ৬৪ নম্বর ওয়াহেদ ম্যানশন, তার পশ্চিম পাশে থাকা দু’তলা ৬১ নম্বর বাড়ি এবং ওয়াহেদ ম্যানশনের লাগোয়া ৬৫ ও ৬৬ নম্বর দুটি বাড়ি। আর ৬৪, ৬৫ ও ৬৬ নম্বর বাড়ির ঠিক মুখোমুখি রাস্তার উল্টোদিকে থাকা রাজ্জাক ম্যানশন ও তার লাগোয়া পূর্বদিকেরসহ মোট ছয়টি বাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বাড়ির সামনে লালফিতা দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। আর তার সামনে নোটিস ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। নোটিসে বলা হয়েছে, বাড়িগুলো ঝুঁকিপূর্ণ এবং বসবাসের অযোগ্য। এখনও অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের সম্পর্কে তেমন কোন খোঁজখবর দিতে পারছে না ফায়ার সার্ভিস বা এলাকাবাসী। এলাকাবাসী ও তদন্তকারীদের ধারণা, অনেকের লাশই কেমিক্যালে গলে ছাইয়ের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। এদিকে ঘটনার পর থেকেই সেখান ভিড় করছেন হাজার হাজার মানুষ। জনতার ভিড় সামলাতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। বাড়িগুলো একনজর দেখার জন্য সেখানে যেন জনতার ঢল নেমেছে। পুরো এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। প্রসঙ্গত, ঘটনার পর ডিএনসিসির তরফ থেকে ১১ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা হচ্ছেন বুয়েটের পুর কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী, অধ্যাপক ইশতিয়াক আহমেদ, ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক এস এম জুলফিকার রহমান, ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান, ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (বিদ্যুত) জাফর আহমেদ, ডিএসসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম, রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম, রাজউকের পরিচালক শাহ আলম, অথরাইজ অফিসার নুরুজ্জামান জহির এবং সিটি কর্পোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হাশেম। এদিকে ফায়ার সার্ভিসের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি অগ্নিকা-ের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। কমিটির সদস্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, এ ঘটনায় সরকারী সংস্থাগুলোর গাফিলতি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। এদিকে চকবাজারের অগ্নিকা-ের ঘটনায় মামলা হয়েছে। অবহেলাজনিত প্রাণনাশের অভিযোগে মামলাটি দায়ের হয়। দগ্ধ আরাফাত ইসলাম সিয়ামের (১৯) আত্মীয় হাবীবুর রহমান রুবেল শুক্রবার চকবাজার থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক হাজি আবদুল ওয়াহেদের দুই ছেলে শহীদ ও হাসানসহ অজ্ঞাত ১০/১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। নিহত ৬৭ জনের মধ্যে ৪৫ জনের মরদেহ শনাক্ত করার পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। দগ্ধ ৪১ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে নয় জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
×