ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহীর স্বাস্থ্যসেবা চিত্র ॥ শহরে ছুটছেন প্রান্তিক মানুষ

গ্রামে থাকেন না চিকিৎসক

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

গ্রামে থাকেন না চিকিৎসক

স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী ॥ গ্রামে চিকিৎসকদের থাকতে অনীহার কারণে রাজশাহীর ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মিলছে না কাক্সিক্ষত চিকিৎসা সেবা। গ্রামের এসব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে রয়েছে চিকিৎসক সঙ্কট। অর্ধেক চিকিৎসক পদ খালি থাকায় খুঁড়িয়ে চলছে চিকিৎসা সেবা। অনেকে যোগদান করলেও প্রেষণ ও সংযুক্তি নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। আর এ কারণেই প্রান্তিক মানুষ স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে অসচেতন ও দালালদের প্ররোচণায় তারা ছুটছেন শহরের প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালে। আর ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে প্রাণহানি ঘটলেও মিলছে না প্রতিকার। উপজেলা পর্যায়ের ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র সমূহে চিকিৎসক থাকেন না বললেই চলে। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর প্রায় একই অবস্থা। রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন দফতরের দেয়া তথ্য অনুয়ায়ী, চিকিৎসক সঙ্কট চলছে জেলার ৯ উপজেলার ৭৬ ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রেই। প্রত্যেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন করে সহকারী সার্জনের পদ রয়েছে। এর মধ্যে পবা উপজেলার ৯ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৪টিতে, মোহনপুরের ৬ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৩টিতে, তানোরের ৮ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৮টিতে, গোদাগাড়ীর ১১ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৯টিতে, বাগমারার ১৭ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ১৭টিতে, দুর্গাপুরের ৭ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৭টিতে, চারঘাটের ৬ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৬টিতে, পুঠিয়ায় ৭ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৭টিতে এবং বাঘার ৫ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৩টিতেই চিকিৎসক নেই। কেবল ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রই নয়, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতেও চিকিৎসক সঙ্কট। জেলার বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের পদ রয়েছে সবমিলিয়ে ২২টি। এখানে নেই জরুরী মেডিক্যাল অফিসার ও মেডিক্যাল অফিসার। শূন্য রয়েছে সার্জারি, গাইনি, মেডিসিন, এ্যানেসথেসিয়া, চক্ষু, হৃদরোগ, চর্ম ও যৌন এবং অর্থপেডিক বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট পদও। পবা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রয়েছেন একমাত্র আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার। এর বাইরে নয় উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই পদে কোন চিকিৎসক নেই। নগরীর উপকণ্ঠ হওয়ায় পবা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোন চিকিৎসক পদ শূন্য নেই। তবে এখানে রোগীদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। গত বছরের ১২ নবেম্বর রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ বানেশ্বর এলাকায় পুষ্প ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় মারা যান মর্জিনা বেগম (৩২) নামে এক গৃহবধূ। নিহত মর্জিনা জেলার চারঘাট উপজেলার বালুদিয়ার গ্রামের হাফিজুর রহমানের স্ত্রী। এর আগে ২০ অক্টোবর বাঘা উপজেলা সদরের জননী ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় মারা যান আজমিরা বেগম (২৮) নামে এক প্রসূতি। তিনি ওই উপজেলার গড়গড়ি ইউনিয়নের চাঁদপুর ব্যাঙগাড়ি গ্রামের সাইদুল ইসলামের স্ত্রী। স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপে শেষ পর্যন্ত মামলায় গড়ায়নি এসব ঘটনা। স্থানীয়রা বলছেন, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক নেই। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে কাক্সিক্ষত সেবা মিলছে না। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকেই শহরের ক্লিনিক-হাসপাতালে যাচ্ছেন। তবে শহরের হাসপাতালেও মিলছে না সেবা। অনেকে বাধ্য হয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে শরণাপন্ন হন বেসরকারী ক্লিনিকে। সেখানে টাকা ব্যয় করেও মিলে না চিকিৎসা। গোদাগাড়ী উপজেলার দুর্গম এলাকা চরআষাড়িয়াদহে রয়েছে ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র। এখানে একজন সহকারী সার্জনের পদ থাকলেও দীর্ঘদিন ধরেই শূন্য এই পদ। একই দশা উপজেলার আরও ১০ ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের। যদিও কাগজে কলমে বালিয়াঘাটা উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাঃ লায়লা রাজ্জাক এবং বাসুদেবপুর উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাঃ তৌহিদা সাবরিনকে কর্মরত দেখানো হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এদের মধ্যে ডাঃ তৌহিদা রাজশাহী নগরীর পুলিশ হাসপাতালে প্রেষণে নিযুক্ত। আর ডাঃ লায়লা সংযুক্ত মানিকগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজে। জেলার উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর মধ্যে পুঠিয়ায় ৬, চারঘাটে ৬, দুর্গাপুরে ৭, বাগমারায় ৪, তানোরে ৭, মোহনপুর ও গোদাগাড়ীতে একজন করে চিকিৎসকের পদ শূন্য। আর এ নিয়েই সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্র। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ গোদাগাড়ীতে রয়েছে ৩১ শয্যা হাসপাতাল। প্রতিদিনই এখানে ঘটছে ছোটবড় সড়ক দুর্ঘটনা। অথচ জরুরী অস্ত্রোপচারের জন্য এই হাসপাতালে নেই সার্জিক্যাল বিশেষজ্ঞ। ৯ চিকিৎসক পদ থাকলেও এখানে আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারসহ শূন্য আরও ৫ পদ। এখানকার হাসপাতাল-স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সঙ্কট রয়েছে নার্সের। জেলায় নার্সিং সুপারভাইজারের মঞ্জুরিকৃত ৭ পদের বিপরীতে কর্মরত ৫ জন। এছাড়া ১৮৬ পদের বিপরীতে সিনিয়র স্টাফ নার্স কর্মরত ১৭১ জন। আর ১০ পদে সহকারী নার্সের বিপরীতে কর্মরত মাত্র একজন। তবে চিকিৎসক সঙ্কটে সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ সঞ্জিত কুমার সাহা। তিনি বলেন, যে চিকিৎসক কর্মরত আছেন, তারা সাধ্যমতো সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। নতুন চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হলে চিকিৎসক সঙ্কট থাকবে না। চিকিৎসকরা গ্রামে থাকতে চান না বলেও স্বীকার করেন রাজশাহীর সিভিল সার্জন।
×