ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা শহীদদের নিবেদিত শ্রদ্ধায় স্নাত সংস্কৃতি অঙ্গন

প্রকাশিত: ১১:২০, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ভাষা শহীদদের নিবেদিত শ্রদ্ধায় স্নাত সংস্কৃতি অঙ্গন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আমার এমন মধুর বাংলা ভাষা/ভায়ের বোনের আদরমাখা/মায়ের বুকের ভালবাসা...। এভাবেই কবিতার আশ্রয়ে মাতৃভাষার প্রতি মমত্ব প্রকাশ করেছিলেন কবি জসীম উদ্্দীন। সেই মমত্ববোধের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে গড়া বাঙালীর রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সংগ্রাম ও আন্দোলনের ইতিহাসে দারুণভাবে সমৃদ্ধ এই দেশ। বৃহস্পতিবার ছিল এ রাষ্ট্রের কৃষ্টিলালিত সংগ্রামী ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ এক দিন। বাংলা বর্ণমালার জন্য প্রাণ বিসর্জনকারী বাংলা মায়ের দামাল ছেলের রক্তস্নাত অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। একইসঙ্গে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষার জন্য রক্ত ঝরানো দিনটিতে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয়েছে ভাষা শহীদদের। নানা আয়োজনে বহুমাত্রিক পরিবেশনায় স্নিগ্ধ রূপ বিরাজ করেছে রাজধানী সংস্কৃতি অঙ্গনজুড়ে। বহুমাত্রিক পরিবেশনায় ভালবাসা জানানো হয়েছে বর্ণমালার জন্য প্রাণ সঁপে দেয়া শহীদদের। প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায়ও ছিল নানা আয়োজন। গানের সুরে, কবিতার ছন্দে, নৃত্যের প্রকাশে কিংবা বক্তার কথা অথবা নৃত্যশিল্পীর নাচের মুদ্রায় ছিল ভাষাসৈনিকদের বন্দনা। এসব পরিবেশনায় উঠে এসেছে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা। রবীন্দ্র সরোবরে জোটের একুশের অনুষ্ঠানমালা ॥ একুশের বিকেলে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরের উন্মুক্ত মঞ্চটিকে ঘিরে বয়ে গেছে প্রাণের স্পন্দন। জল-হাওয়া বেষ্টিত এ মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশাত্ববোধক গান, নাচ, আবৃত্তি ও পথনাটসহ রকমারি পরিবেশনা। ‘একুশ আছে জয়োদ্ধত একুশ বাঁচে অবিরত’ স্লোগানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত ১৪ দিনব্যাপী একুশে অনুষ্ঠানমালার শেষদিন ছিল বৃহস্পতিবার। সমাপনী দিনে বিকেল থেকে শুরু হয় অনুষ্ঠান। শোনা যায় ফজলে লোহানী রচিত একুশের কবিতার পঙ্ক্তিমালা- শীতল পৃথিবী, অবশ নগর/ অসার আকাশ, বাতাস নিথর.../মৃত্যু হয়েছে আজকে ওদের/বোবা পাখিগুলো পাখা ঝাপটায়/একুশে রাতের আঁধার নামে সব শহরের গলিঘুঁজিতে...। ভাষা শহীদদের প্রতি ভালবাসা জানিয়ে কবিতাটি পাঠ করেন আবৃত্তিশিল্পী বেলায়েত হোসেন। শিল্পিত উচ্চারণে নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলী পাঠ করেন তানভীর মোকাম্মেলের কবিতা ‘পরিচয়’। এছাড়াও একক কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করেন কাজী বুশরা আহমেদ তিথী। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ছিল সম্মেলক সঙ্গীত। সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী পরিবেশন করে ‘আম্র্রকুঞ্জে পলাশের কুঞ্জে/আবার এসেছে ফাগুন’। দলটি পরিবেশিত বাকি দু’টি গানের শিরোনাম ছিল ‘ভুলবো না ভুলবে না একুশে ফেব্রুয়ারি’ ও ‘রক্ত শিমুল তপ্ত পলাশ ডিলো ডাক সুনীল ভোরে। সম্মেলক কণ্ঠে সুরতীর্থর শিল্পীর গেয়ে শোনায় ‘সংকোচের বিহ্বলতায় হয়ো না ম্র্রিয়মাণ’ ও ‘জয় মা বলে ভাসা তরী’। গানের সুরে বাংলা ভাষার গৌরবগাথাকে কণ্ঠে তুলে নেন নাসিমা শাহীন ফ্যান্সি। গেয়ে শোনান ‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা’। বায়ান্নর রক্তভেজা দিনের উঠে আসে শাহ আলমের কণ্ঠে। গেয়ে শোনান ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙালি/ তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’। কলকাতার শিল্পী অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় পরিবেশন করেন ‘একই গঙ্গা পদ্মা ধলেশ্বরী মেঘনা/এপার ওপার যাই বলো সবখানেতে বাসা’ ও ‘জয়তু বঙ্গবন্ধু জয়তু’ শিরোনামের দুটি গান। এছাড়া একক কণ্ঠে গান শোনান আব্দুল হালিম খান, মারুফ হোসেন, মাফিদা আক্তার মালা ও বিথী ফারজানা রহমান। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে স্বনন ঢাকা, শ্রুতিঘরের বাচিকশিল্পীরা। শিশু সংগঠন পরিবেশনায় অংশ নেন নূপুর একাডেমি ও মন্দিরা সাংস্কৃতিক পাঠশালা। মুদ্রার সঙ্গে অভিব্যক্তির সম্মিলনে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যজন। সব শেষে ছিল নাট্যধালা ও নাট্যদল পরিবেশিত পথনাটকের পরিবেশনা। ছায়ানটে একুশের অনুষ্ঠান ॥ বসন্ত সন্ধ্যায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহীদদের নিবেদিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। সঙ্গীত পরিবেশনা ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে সাজানো হয় অনুষ্ঠান। খুদে শিল্পীদের পরিবেশনায় ছিল দলীয় গান ‘মানুষ হ’ মানুষ হ’ আবার তোরা মানুষ হ’ এবং ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’। বড়রা কণ্ঠে তুলে নেয় ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা’ ও ‘ভুলবো না ভুলবো না ভুলবো না। প্রদর্শিত হয় সেন্টু রায় নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘তবু মনে রেখো’। শিল্পকলায় বিভিন্ন দেশের ভাষার গান ॥ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ‘বিশ্বের সকল মাতৃভাষা রক্ষা করবে বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে বিভিন্ন দেশের ভাষাভাষীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিল্পকলা একাডেমি। একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠানের শুরুতেই চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে নিহতদের স্মরণে নীরবতা পালন করা হয়। এরপর বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক পর্বের সূচনা হয় জাতীয় সঙ্গীত এবং ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের মাধ্যমে। গান শেষে একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী শিল্পীদের উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নেন। অনুষ্ঠানে একাডেমির সঙ্গীত শিল্পীরা বিভিন্ন ভাষার গান পরিবেশন করেন। সায়কার পরিচালনায় উপস্থাপিত হয় ব্রিটিশ আমল থেকে বর্তমান সময়কে তুলে ধরা কোরিওগ্রাফি। ফিলিপাইন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন ও ফিলিপাইন সোসাইটি বাংলাদেশ পরিবেশন করে গান ও কবিতা। কানাডা হাইকমিশনের গ্যাবরিয়েল মাথিউ পরিবেশন করেন কবিতা ও গান। সৈয়দা সায়লা আহমেদ লীমার পরিচালনায় শ্রীলঙ্কা, মরক্কো, ভারত, নেদারল্যান্ড, নেপাল ও আফগানী ভাষার গানের সুরে সমবেত নৃত্য পরিবেশিত হয়। কোরিয়ান স্কুলের শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশনার পাশাপাশি সুর তোলে বাদ্যযন্ত্রে এবং নাচ পরিবেশন করে।
×