ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রক্তস্নাত একুশ এবং ক্ষুদে ভাষাসৈনিকদের অবদান

প্রকাশিত: ১২:০৯, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

রক্তস্নাত একুশ এবং ক্ষুদে ভাষাসৈনিকদের অবদান

১৯৫২ সনের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে ঘটে যাওয়া বহু ঘটনার মধ্যে পুলিশ বনাম খুদে পিকেটারদের লড়াই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, যদিও পাকিস্তান ও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ১৯৫২ সনের ২২শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় একুশে ফেব্রুয়ারি ফুলার রোডে পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সালাহউদ্দিন নিহত হয়েছে বলে একটি খবর ছাপা হয়। উক্ত সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার বিভিন্ন ফ্যাকালটির রেকর্ডপত্র সার্চ করে সালাউদ্দিন নামের কোন ছাত্রের সন্ধান পায়নি। পরবর্তীকালে আর একটি খবর ছাপিয়ে আজাদ তার ভুল সংশোধন করে। প্রকৃত ঘটনা হলো : একুশে ফেব্রুয়ারি ফুলার রোডে পিকেটিংরত অবস্থায় ৯ বছর বয়সী সালু পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শিশু হত্যার দায় এড়াবার জন্য পুলিশ কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গেই তার লাশ তুলে নিয়ে যায় এবং বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে অজ্ঞাতস্থানে দাফন করে। সালু মেডিক্যাল কলেজের সম্মুখে ফলের দোকানের শিশু শ্রমিক ছিল। দৈনিক বার ঘণ্টা শ্রমের জন্য সে কোন মজুরি পেত না, মজুরির পরিবর্তে তাকে দুবেলা খাবার দেয়া হত। কোন কারণে একদিন কাজ করতে না পারলে ওইদিন তাকে অনাহারে থাকতে হত। সালু আমার দলের সদস্য ছিল এবং একুশের দিন আমাদের সঙ্গে ২ ঘণ্টা পুলিশ কাস্টডিতে আন্তরীণ ছিল। ১৯৫২ সনের দৈনিক আজাদ পত্রিকার ২২শে ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের আক্রমণে গুরুতররূপে আহত যে ১৭ জনের তালিকা প্রকাশিত হয় তাদের মধ্যে যথাক্রমে এম এ মোতালেব এবং এ রশিদ ছিলেন ১৪ বছর বয়সী এবং বছিরউদ্দিন আহমেদ ও মাসুদুর রহমান ছিলেন ১৫ বছর বয়সী বালক। এরপর আসে নয় বছর বয়সী ভাষা শহীদ অহিউল্লাহর কথা। রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের ছেলে অহিউল্লাহ ২২শে ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে পদযাত্রার সময় নবাবপুর রোডে পুলিশ ইপিআরের গুলিতে নিহত হয়। লাশটি ফেরত পাওয়া তো দূরের কথা তার কবরটি পর্যন্ত সন্ধান পাইনি তার মা-বাবা। একজন শহীদ ভাষা সৈনিক হলেও গণমাধ্যমে তাকে চিহ্নিত করা হযেছে রাজপথে দাঁড়িয়ে থাকা মিছিলের দৃশ্য অবলোকনকারী একজন উৎসুক বালক হিসেবে। প্রত্যক্ষদর্শী ভাষাসৈনিক তোফাজ্জল হোসেনের (২) বর্ণনায় জানা যায় ১৯৫২ সনের ২২শে ফেব্রুয়ারি হরতাল ও কারফিউ চলাকালীন সময়ে ঢাকার নীলক্ষেতে অবস্থিত সেনাবাহিনীর রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্পের সম্মুখে পুলিশের গুলিতে আরেকটি শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ শিশুটির নিথর দেহটি তুলে নিয়ে যায়। এরপর শিশুটির আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সালুর মতই এই ‘নাম না জানা’ শিশুটির মরদেহ পুলিশ গুম করেছিল। বায়ান্নর ভাষা সৈনিক ১১ বছর বয়সী লেবু মিয়া চরম দারিদ্র্যের শিকার হয়ে ১৯৬৫ সনে মৃত্যুবরণ করেন। গৃহহীন ও অনাহার ক্লিষ্ট এই ভাষাসৈনিক ভিক্ষারত অবস্থায় ঢাকার নওয়াবপুর রোডে মারা গেলে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে তাকে অজ্ঞাতস্থানে কবর দেয়া হয়। রাষ্ট্র তার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, গণমাধ্যম ছিল নীরব। বায়ান্নর আর একজন ৯ বছর বয়সী ভাষাসৈনিক সুব্রত বারুরী ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হলে রাষ্ট্র তার চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্য দিতে অপারগতা জানিয়েছে। অবশেষে প্রবাসী একজন ভাষাসৈনিক তার সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ভারত থেকে অপারেশনের মাধ্যমে গলা থেকে ক্যান্সার আক্রান্ত টিউমারটি অপসারণ করা হলে তার প্রাণ রক্ষা হয়। এবারও গণমাধ্যম নীরব। মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর থানাধীন পুলিশী নির্যাতন ও গ্রেফতার বরণকারী ক্ষুদে ভাষাসৈনিক ওয়াজ উদ্দিন মাস্টার, রেয়াজ উদ্দিন, যতীন দাশ ও নিরঞ্জন বসুর ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখার ইতিহাসটি লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে গেল। ক্ষুদে ভাষাসৈনিকদের বরাত দিয়ে বলা যেতে পারে যে, এরা শুধু বাংলাদেশে নয়, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালী তরুণ-তরুণীরা ভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও মাতৃভাষার সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়েছেন। ১৯৬২ সালে আসামের (ভারত) শিলচরে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাকে একটি সরকারী ভাষারূপে স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে যে এগারোজন ভাষাসৈনিক শহীদ হন তার মধ্যে খুদে ভাষাসৈনিক কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন সর্বকনিষ্ঠা। তিনি ছিলেন স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রী- এসএসসি পরীক্ষার্থী। মেডিক্যাল কলেজ ব্যারাক চত্বরে, ফুলার রোডে, চাঁনখারপুলে পুলিশের সঙ্গে ক্ষুদে পিকেটারদের মুখোমুখি সংঘর্ষের সময় পুলিশের ব্যাটন চার্জে যে সকল বালক আহত হয়েছিল তাদের মধ্যে মূল লেখকও একজন। তাদের কথা কী কোন কাগজে ছাপা হয়েছে? সোজা উত্তর হয়নি। স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে যৎসামান্য সড়ক-সেতুর নামকরণ ভাষাসৈনিকদের স্মরণে করা হলেও খুদে ভাষা সৈনিকগণ রয়েছেন এই তালিকার বাইরে। গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ভাষাসৈনিকদের স্বীকৃতিদানের সরকারী সিদ্ধান্ত একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ কিন্তু খুদে ভাষাসৈনিকগণ বাদ পড়েছেন এই তালিকা থেকে। খুদে ভাষাসৈনিকদের ভাবনা বয়সের অজুহাত তুলে তাদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে। তাদের এই সংশয় দূর করার জন্য বৈষম্যহীন সমতার নীতিটি অনুসরণ করা একান্ত আবশ্যক। যেকোন সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হলে সংশ্লিষ্ট সংগ্রামীদের শুধুমাত্র বয়সের মাপকাঠিতে নয়, তাদের দক্ষতা, বীরত্ব, নেতৃত্ব, ত্যাগ, দেশপ্রেম, বিচক্ষণতা ইত্যাদি গুণাবলীকে আমলে নিতে হবে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে মহান একুশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এই শিক্ষা থেকে পাঠ নিয়ে প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক ভাষাসৈনিকদের সমহারে মর্যাদা প্রদান করতে হবে। পাকিস্তানের প্রয়াত গবর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (২১শে মার্চ, ১৯৪৮) ভাষার প্রশ্নে যে নেতিবাচক জবাব দিয়েছেন তার ৪ বছর পর ১৯৫২ সনের ২৭শে জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা দানকালে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন, রাষ্ট্রভাষা চুক্তির শর্ত ভেঙ্গে, জিন্নাহর মন্তব্যকে অনুসরণ করে ঘোষণা করেন উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। বস্তুত ভাষার প্রশ্নের জিন্নাহর মন্তব্যটি হুবহু প্রতিধ্বনিত হয়েছিল নাজিমুদ্দিনের কণ্ঠে। এই ঘোষণার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গে ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫২ সনের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটির সভায় খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যের প্রতিবাদে ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘট এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ববঙ্গে হরতাল, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ সমাবেশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটিও এই সিদ্ধান্তটিকে সমর্থন দেয়। সরকার এই প্রতিবাদ কর্মসূচী বানচাল করার জন্য ২০শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ১ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে জনসভা, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা আমতলার সমাবেশে জড় হতে থাকে, যোগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা, আম জনতা ও সঙ্গে খুদে পিকেটারগণ বেলা এগারোটায় শুরু হয় ছাত্রসভা, সিদ্ধান্ত হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের। পর্যায়ক্রমে দশজনের একটি করে দল ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় পুলিশের হাতে গ্রেফতার বরণ করতে থাকেন। এই সময় খুদে পিকেটারদের একটি দল (এই লেখকের নেতৃত্বে) রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, ১৪৪ ধারা মানি না, গ্রেফতার বন্ধ কর, পুলিশী জুলুম চলবে না। এই স্লোগান দিয়ে পুলিশী কর্ডন ভেঙ্গে বার হবার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনীর টিয়ারগ্যাস ও ব্যাটন চার্জের শিকার হন। অনেকে আহত হন, লেখক নিজেও। শুরু হয়ে যায় পুলিশের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ, পুলিশের প্রতি ইট-পাটকেল ছোড়া, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গ্রেফতার ও পরে ছাড়া পাওয়া। মেডিক্যাল কলেজের পুরো চত্বরটি হয়ে উঠেছিল একটি রণক্ষেত্র। সংঘর্ষ প্রায় তিন ঘণ্টা চলে, অপরাহ্ণ ৩-২০ মিনিটে গুলিবর্ষণ করে পুলিশ এই প্রতিবাদী সমাবেশকে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনে। গুলিতে রফিক, বরকত, জব্বার, সালুসহ নাম না জানা আরও অনেকে শহীদ হন। একুশের সমাবেশে অংশগ্রহণের প্রশ্নে আমার পর্যবেক্ষণ- সে দিনের উপস্থিতি ৪ দলে বিভক্ত ছিল : ১ম দলে সরকার পক্ষের সমর্থকগণ পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার অজুহাতে বন্দুকের গুলি ছুড়ে ভাষা আন্দোলনকে চিরতরে দমাতে চেয়েছিলেন, ২য় দলে ছিলেন বিরোধীদলের সমর্থকগণ। তারা চেয়েছিলেন আসন্ন নির্বাচনে জয়লাভ করে সাংবিধানিক উপায়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, তাদের কাছে ১৯৫৪ সনের সাধারণ নির্বাচনটি প্রাধান্য পায়। ৩য় দলে ছিলেন উচ্চাভিলাষী ছাত্রছাত্রী যারা পেশাগত ক্যারিয়ার তৈরি সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ প্রাপ্তির আশায় অপেক্ষা করছিলেন, সেইসঙ্গে ছিলেন হাসপাতালে আসা ভিজিটর ও নীরব দর্শকমন্ডলী, আর ৪র্থ দলে ছিলেন ভাষার দাবি আদায়ের প্রশ্নে আপোষহীন, ত্যাগী ও নির্ভীক চিত্তের ছাত্র-জনতার একটি অংশ এবং এই দলেই ছিলেন খুদে পিকেটারগণ যারা শুরু থেকেই পুলিশী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, ইট-পাটকেল সম্বল করে যারা পুলিশের প্রতি আক্রমণ অব্যাহত রেখেছিলেন। খুদে পিকেটারদের ঢিল ছোড়া ও তাদের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি আক্রমণের সঙ্গে পুলিশের গুলি বর্ষণের বিষয়টি ছিল নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। উভয়পক্ষের মধ্যে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ যতই তীব্রতর হচ্ছিল, পুলিশ প্রশাসন ততবেশি তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল। শঙ্কিত প্রশাসন চত্বরের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে সরকার ও ছাত্র-জনতার মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘোষণা করে এবং গুলি বর্ষণের মধ্য দিয়ে তাদের নিশ্চিত পরাজয় সাময়িকভাবে রোধ করে। পুলিশের সঙ্গে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে যে লড়াই হয়েছিল তার বিবরণ বিভিন্ন ভাষাসৈনিক, লেখক ও ভাষা গবেষকবৃন্দ বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছেন : ভাষাসৈনিক গাজিউল হক লিখেছেন : ‘পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল ছুড়ছে। ছাত্ররা মেইন গেট দিয়ে বেরোতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব দিকে মধুর রেস্তরাঁর সঙ্গে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা যে ছোট প্রাচীরটি ছিল তা টপকিয়ে মেডিক্যাল কলেজে যেতে থাকে এবং মেডিক্যাল কলেজ থেকে বেরিয়ে পরিষদের দিকে মিছিল নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করে। পুলিশের ওপর ছাত্রদের ইট-পাটকেল ছোড়া নিয়ে যে কী রকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, সে দিনের একটি ছোট্ট ঘটনার কথা উল্লেখেই তা বোঝা যায়। হাসান হাফিজুর রহমান এবং আজহারকে পাঠানো হয়েছিল যাতে ইট-পাটকেল ছোড়া বন্ধ হয় তার জন্য চেষ্টা করতে। হাসান হাফিজুর রহমান ও আজহার গেলেন। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে ইট ছুড়তে বারণ না করে তারা নিজেরাই ইটের বড় বড় টুকরো নিয়ে পুলিশের প্রতি ছুড়তে থাকেন।” ভাষাসৈনিক হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছেন : “বেলা একটা সোয়া একটার দিকে অলি আহাদ আমাকে বললেন, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসের সামনে যে গেটে, সেখানে ছাত্ররা পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়ছে। সেখানে গিয়ে ছাত্রদের ঢিল ছোড়া বন্ধ করুন। তিনি আরও বলেছিলেন, আমাদের খবর আছে, পুলিশ হয়তো আজকে গুলিও করতে পারে, আমি দেড়টার দিকে সেখানে যাই। কলেজের গেটে আমি দেড়টার দিকে পৌঁছে দেখি ছেলেরা ঢিল ছুড়ছে এবং আমার যতদূর মনে হয়, সেখানে আমার পৌঁছার মিনিট পনেরো পরেই গুলিটা হয়।” ভাষাসৈনিকব আহম্মদ রফিক লিখেছেন : “তখনকার পরিস্থিতিটা ছিল এ রকম- প্রাঙ্গণে সমবেত ছাত্রদের কণ্ঠে স্লোগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, পুলিশি জুলুম চলবে না, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই, আর সেই সঙ্গে সংঘবদ্ধভাবে অনেকটা ঢেউয়ের মতো রাস্তায় উপস্থিত হওয়া এবং যথারীতি পুলিশের প্রহারে ফিরে আসা। এর মধ্যে স্কুলের ছোট ছোট ছেলে পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়েছে, পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়েছে। এক পর্যায়ে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে থাকে, দু’একটা শেল হাসপাতাল চত্বরেও পড়ে। বাতাস কাঁদানে গ্যাসের ঝাঝালো গন্ধে ভারি।” ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু লিখেছেন : “কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জের মধ্যেই আমি ছুটে গেলাম এ্যাসেম্বলি হলের (জগন্নাথ হল) দিকে। নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কিছু ছাত্র মিছিল ভ-ুল করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পুলিশের ওপর ইট পাটকেল ছুড়তে থাকে। পুলিশের সঙ্গে কিছু ছাত্র-ছাত্রীও এতে আহত হয়।” ভাষা আন্দোলন গবেষক এমআর মাহবুব লিখেছেন : “২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ বিধান পরিষদের অধিবেশন ছিল তিনটায়। বিশ্ববিদ্যালয় দেয়াল ভেঙ্গে ছাত্ররা পরিষদ ভবনে যাবার উদ্দেশ্যে আমতলা থেকে বেরিয়ে ‘চলো, চলো এ্যাসেম্বলি চলো বলে মেডিক্যাল ব্যারাকে সমবেত হয়। প্রতিবাদে ছাত্র ও পুলিশের সাথে শুরু হয় খ-যুদ্ধ। পুলিশের প্রতি ছাত্রদের ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও পিকেটিং অব্যাহত থাকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কন্ট্রোল রুম থেকে চলতে থাকে জ্বালাময়ী বক্তৃতা।” ইট-পাটকেল ব্যবহার করে পুলিশের সাথে ছাত্র-জনতা-পিকেটারদের সংঘর্ষের বিষয়টি ভাষাসৈনিক ও ভাষা আন্দোলন গবেষকরা সকলেই স্বীকার করেছেন। তাঁদের অনেকেই বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন বেলতলা পুকুর পাড় ও চানখাঁরপুলসহ বিরাট চত্বরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছিল যদিও আমতলা-মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণ এলাকাটিতে শুরুতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও পুলিশী অভিযান কেন্দ্রীভূত ছিল। উল্লিখিত সংঘর্ষে ইট-পাটকেলের ব্যবহারকে ভাষাসৈনিক রওশান আরা বাচ্চু ছাড়া আর কেউ সমালোচনা করেনি। রওশন আরা বাচ্চু তার লেখায় কঠোর সমালোচনা উপস্থাপন করে বলেছেন যে ইট-পাটকেল নিক্ষেপকারীরা নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী এবং মিছিলটি ভেঙ্গে দেয়ার জন্যই তারা এ কর্মটি করেছেন। আমি নিম্নবর্ণিত কারণে তার এই মন্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করি। ক) সরকারের ১৪৪ ধারা জারির ফলে মিটিং মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকায় মিছিলটি বের করা যায়নি। সত্যাগ্রহ অনুসরণ করে পর পর ১০ জনের একটি করে দল বের হয়ে মিছিলে যোগদানের প্রচেষ্টা পুলিশী গ্রেফতারের কারণে মোটেও সম্ভব হয়নি। খ) বিক্ষোভকারী ভাষাসৈনিকদের ‘নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী’ বলে আখ্যায়িত করেছিল পাকিস্তান মুসলিম লীগ ও তাদের পূর্ববঙ্গীয় সমর্থকরা। আমি কখনো শুনিনি যে মাতৃভাষা প্রেমী ও বাঙালী নৃতাত্ত্বিকতায় বিশ্বাসী কোন বাঙালী একুশের বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশের প্রতি পিকেটারদের ইট-পাটকেল ছোড়াকে ‘নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী’ বলে তিরস্কার করেছে। পুলিশের সাথে বিক্ষোভকারীদের যে সংঘর্ষ প্রশাসনের ভাষ্য ছিল এটি ‘উস্কানিমূলক’ অপরদিকে পিকেটারদের মতে এটি ছিল মূলত ‘আত্মরক্ষামূলক’। শেষোক্ত মন্তব্যটি সকলের কাছে গৃহীত। একথা সকলেরই জানা যে বিক্ষোভ সমাবেশের এই পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সংস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি কিংবা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না, নেতৃবৃন্দের নির্দেশও কেউ মানেনি (ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের মন্তব্য দেখুন)। তারপরেও সংঘর্ষে সম্পৃক্ত ছাত্র-জনতা বিশেষ করে ক্ষুদে পিকেটারদের দলটি পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ অব্যাহত রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। ভাষাসৈনিক আহম্মদ রফিক তার প্রবন্ধে ‘আক্রমণ’ সংঘবদ্ধভাবে চালিত হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন। আমার ধারণা যদি এই দিন সমাবেশ প্রশাসনের হুকুম মেনে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতো তাহলে বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের জন্য কম করে হলেও আরও দেড় যুগ অপেক্ষা করতে হতো। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে একুশের রক্তাক্ত ঘটনার পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার সাংবিধানিক মর্যাদা দিতে তৎকালীন প্রশাসন দীর্ঘ ৪ বছর সময় নিয়েছিলো (১৯৫৬ সনের ১৬ই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণ পরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়)। আমি বিশ্বাস করি একুশের সমাবেশের সেই ‘বিপ্লবী অভিযান’ আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ে একটি মূল্যবান অবদান রেখেছিল। এই অভিযানে ক্ষুদে পিকেটারদেরকে লিডিং রোল রয়েছে তাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। স্বীকৃতি প্রশ্নে ক্ষুদে ভাষাসৈনিকগণ সরকারী কিংবা বেসরকারী সংস্থার অনুকূল সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়নি। এর বহুবিধ কারণের মধ্যে রয়েছে; জ্যেষ্ঠ ভাষাসৈনিকদের তরফ থেকে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদের সদস্য তালিকায় এদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি আর ঐ তালিকাটি পাঠানো হয়েছিল সরকারের নিকট গেজেট আকারে প্রকাশের জন্য। ঐ তালিকায় কতিপয় অ-ভাষা সৈনিকদের নাম রয়েছে বলে অভিযোগ উঠলে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গেজেট প্রকাশনা বাতিল করা হয়। সরকারের সর্বোচ্চ প্রশাসনের মধ্যে বয়স- বৈষম্যের বিষয়টি এই ক্ষেত্রে এখনও উপস্থিত। ২০১৪-১৫ সালের একুশে পদক এ্যাওয়ার্ডের প্রতিযোগী একজন ক্ষুদে ভাষাসৈনিকের মনোনয়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে বয়স- বৈষম্যের শিকার হন। কম বয়সী হওয়ার বিবেচনায় তার সাহস ত্যাগ, নেতৃত্ব ও সর্বোপরি ভাষা আন্দোলনে তার অমূল্য অবদান বয়স বৈষম্যের যাঁতাকলে পড়ে এক নিমিষে বিলুপ্ত হলো। মাননীয় সরকারপ্রধান তার মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করলেন। খবরটি জানাজানি হয়ে গেলে সাংস্কৃতিক মহলের নেতৃবৃন্দ দুঃখ প্রকাশ করলেন বটে কিন্তু বয়স-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন না, গণমাধ্যম নীরব রইলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অল্পবয়সী বালক-বালিকারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতিও লাভ করেছেন। এমন ৩ জন সাহসী এ্যাক্টিভিস্টদের কৃতিত্বের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিচে উপস্থাপন করা হলো। জ্যাক কর্নওয়েল (জন্ম : ৮ জানুয়ারি ১৯০০; মৃত্যু: ২ জুন, ১৯১৬) ইংল্যান্ডের একটি দরিদ্র পরিবারে ১৫ বছর বয়সী সন্তান-জন জ্যাক ট্রেভার্স কর্নওয়েল (জ্যাক কর্নওয়েল নামে অধিক পরিচিত) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইংল্যান্ডের প্লিমাউথ কেহাম নাভাল ব্যারাকে ‘২য় শ্রেণী বালক’ ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হন। এক বছর প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ‘১ম শ্রেণী বালক’ ক্যাডট হিসেবে পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন এবং ১৯১৬ সালের ২২ মে যুদ্ধ জাহাজ এইচ এম এম চেষ্টারে তাকে পোস্টিং দেয়া হয়। উত্তর মহাসাগরে অবস্থিত জোটল্যান্ডের যুদ্ধে এইচ এম এম চেষ্টার অগ্রণী যুদ্ধ জাহাজের ভূমিকা পালন করতে নিয়ে জার্মান ক্রুইজারের ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হয়। গোলাম আঘাত জ্যাকের কামানোর চারিপাশের কর্তব্যরত গানার বৃন্দের বেশিভাগ মৃত্যুবরণ করেন এবং বাকিরা গুরুতরভাবে আহত হয়ে ডেকের মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। জ্যাক প্রাণঘাতী আঘাতে ভীষণভাবে আহত হয়েও খোলা ডেকে তার কামানের পাশে একা দাঁড়িয়ে থেকে তার কমান্ডারের পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। শক্তিশালী জার্মান ক্রইজারের ১৭বার মুহুর্মুহু আক্রমণের ফলে চেষ্টার পিছু হটতে বাধ্য হয়। পোর্টে ফিরে আসলে আহত জ্যাককে গ্রিমস্বি হাসপাতালে স্থানান্তরিক করা হয়। চিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ১৯১৬ সালের ২ জুন যুদ্ধাহত জ্যাকের মৃত্যু হয়। রয়াল নেভি কর্তৃপক্ষ তার লাশ ন্যাভাল কফিনে করে তার পরিবারের বাসস্থান পূর্বলন্ডনের লিটিল ইলফোর্ডের অন্তর্গত আলাভারস্টোন রোডে পাঠিয়ে দেয়। পরিবারের উদ্যোগে মানরপার্ক সিমিট্রিতে কমিউনাল গ্রেভে অতি সাধারণভাবে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। নৌযুদ্ধে জ্যাকের সাহসিকতা ও যেনতেন প্রকার তার শেষকৃত্বের কাহিনী জানাজানি হয়ে গেলে স্থানীয় প্রতিবেশী ও নাগরিকবৃন্দ কড়া প্রতিবাদ জানান। তারা তার বীরত্বের স্বীকৃতি ও যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার দেহ পুনরায় সমাধিস্থ করার জোর দাবি উত্থাপন করেন। নগরবাসীর দাবির প্রতি উত্তরে ইস্টহাম বরা কাউন্সিল ১৯১৬ সনের ২৯ জুলাই জ্যাকের কফিন কবর থেকে তুলে ইস্টহাম টাউন হলে নিয়ে আসে এবং টাউন হল থেকে গানক্যারেজে তার কফিন শোভাযাত্রার মাধ্যমে ম্যানরপার্ক সিমিট্রিতি নিয়ে গিয়ে পূর্ণ নাভাল গার্ড অব অনার প্রদানপূর্বক পুনর্বার সমাধিস্থ করে। হাজার হাজার লোকের কফিন শোভাযাত্রায় স্থানীয় মেয়র ও এমএমপি উপস্থিত থেকে তার প্রতি শুদ্ধা নিবেদন করেন। ১৯১৬ সালের ১৬ নবেম্বর বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাজ্যের মহামান্য রাজা এই ক্ষুদে সৈনিকের মরণোত্তর অতীব সম্মানজনক ভিক্টোরিয়া ক্রস পদকে ভূষিত করেন। জ্যাক কর্নওয়ালের দেশপ্রেম, কর্তব্যপালন, শৃঙ্খলাবোধ, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের মহিমা স্মরণে তাঁর নামে জ্যাক কর্নওয়েল কমিউনিটি সেন্টার, জ্যাক কর্নওয়াল ভিসি ক্যাডেট সেন্টার, জ্যাক কর্নওয়েল স্ট্রীট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ও সড়কের নামকরণ করা হয়। ২০০৪ সালে রয়ালমেইল তাঁর ছবিসহ ডাক টিকেট ইস্যু করে। প্রতি বছর জুন মাসে তাঁর স্মরণে লিটিল ইলফোর্ডে একটি র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়। নাম না জানা একজন ক্ষুদে ভাষা কয়েদি ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করে। উর্দুুর পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করা হয়। ফলে প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত বাংলাভাষাভাষী লোকজনকে ভীষণভাবে হতাশ করে। পূর্ববঙ্গের ছাত্র-জনতা বৃহত্তর ভাষা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকার সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের পক্ষ থেকে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে বাংলাভাষা দাবি দিবস ঘোষণা করা হয়। ‘দাবি দিবস’ উপলক্ষে ইডেন বিল্ডিং, জিপিওসহ বহু স্থানে পিকেটিং করা হয়। পিকেটারদের কঠোর হস্তে দমন করার জন্য পুলিশ প্রশাসন সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান (পরে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু) আব্দুল মান্নান, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, সওকত আলী, খালেক নেওয়াজ প্রমুখসহ বেশ কিছু ছাত্রকে গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করে জেলের কয়েদিদের মধ্যে কিছু সংখ্যক অপ্রাপ্তবয়সী ছাত্র পিকেটার ও ছিল। শেখ মুজিবর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে অনুর্ধ ১০ বছর বয়সী একজন কয়েদি পিকেটারের উল্লেখ আছে। গ্রন্থে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত এই ক্ষুদে ভাষা সৈনিকের একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে যে বালকটি তার সাথী অন্য ছাত্রদের জেলখানায় রেখে কেবলমাত্র তাকে ছাড়িয়ে নেয়ার তার প্রভাবশালী পিতার স্বার্থপর প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে। তার এই উদ্দীপনামূলক সিদ্ধান্তটি অন্যান্য কয়েদিকের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে এই ক্ষুদে ভাষা সৈনিকদের উদ্দেশ্য তার দেয়া বিবরণ নি¤েœ তুলে দেয়া হলো।(৮) ‘একথা সত্য, আইনকানুন ছাত্ররা একটু কমই মানত জেলখানায়। শামসুল হক সাহেব, মান্নান সাহেব ও আমি- এই তিন জনই সকলকে বুঝিয়ে রাখতাম। এদের মধ্যে অনেকে স্কুলের ছাত্রও ছিল। নয় কি দশ বছরের একটি ছেলেও ছিল আমাদের সাথে। ‘তোকে আজই বের করে নিব’। ছেলেটা তার বাবাকে বলেছিল, ‘অন্যান্য ছাত্রদের না ছাড়লে আমি যাব না।’ সে যখন এই কথা ফিরে এসে আমাদের বলল, তখন সকলে তাকে আদর করতে লাগল এবং তার নামে ‘জিন্দাবাদ’ দিল। তার নাম আজ আর আমার মনে নাই, তবে কথাগুলো মনে আছে। ভীষণ শক্ত ছেলে ছিল। গ্রেফতারকৃত একজন ছাত্রেরও মনোবল নষ্ট হয়নি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার প্রস্তুত ছিল।’ মামালা ইউসুফজাই (জন্ম : ১২ জুলাই, ১৯৯৭) শুরুতে মালালা ইউসুফজাই পাকিস্তানের নারীশিক্ষা প্রবর্তনকারী একজন নির্ভীক শিশুকর্মী ছিলেন। পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাপী নারীশিক্ষার অধিকার আদায় অভিযানের একজন বীর সেনানী হিসেবে পরিচিতি পান। সোয়াত সামরিকভাবে তালেবানদের দখলে আসলে তারা সেখানে বালিকা স্কুল বন্ধ ও বালিকাদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তালেবানদের ঘোষণাটিকে অমান্য করে ১৫ বছর বয়সী মালালা তার অল্প কয়েকজন বান্ধবীকে নিয়ে স্কুলে যাতায়াত অব্যাহত রাখেন। এর ফলে তালেবানগণ তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর বিকেলে স্কুল বাসে মালালার বাড়ি ফোর পথে স্থানীয় একজন তালেবান অতি নিকট থেকে তার প্রতি পিস্তলের গুলিবর্ষণ করে। মালালা গুরুতরভাবে আহত হন। পাকিস্তানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর তাকে উন্নতমানের চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই সংবাদ প্রচারিত হলে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার সমর্থনে এগিয়ে আসেন। মালালার স্থানীয় পর্যায়ের ও সীমিত আকারের নারী- শিক্ষার অধিকার আদায় অভিযানটি ‘অতি শীঘ্র’ আন্তর্জাতিক নারী শিক্ষার আন্দোলনে’ রূপান্তরিত হয়। মালালা সুস্থ হয়ে উঠলে, বিশ্বনেত্রীবৃন্দ তাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানায়। ‘২০১৫ সালের শেষে পৃথিবীর সকল দেশের শিশুদের পাঠশালায় উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ’ জাতিসংঘের পরিকল্পিত এই কর্মসূচীটি মালালার স্মরণে গৃহীত হয়। মালালা এখন পড়াশোনার সাথে সাথে পাকিস্তানসহ অন্যান্য দরিদ্র ও নির্যাতিত শিশুদের শিক্ষান্নোয়নে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখে চলেছেন। মালালা ১৯৯৭ সালের ১২ জুলাই পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম খাইবার পাকতুনখা বিভাগের সেয়াত জেলার মিনগোরা শহরে একটি সুন্নি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নতৃাত্ত্বিক পরিচয়ে সে পুস্তুন এবং পুস্তু তার মাতৃভাষা। তিনি পুস্তু, উর্দ্দু, ও ইংরেজী ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। পিতা, মাতা, দু’জন কনিষ্ঠ ভ্রাতা ও মালালাসহ তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচ। মালালার পিতা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই একজন কবি ও কয়েকটি প্রাইভেট স্কুলের স্বত্বাধিকারী, মাতা তোরপেকাই একজন গৃহকর্ত্রী। ছোট বেলায় পিতার নিকট মালালার প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি। পরে পিতার মালিকানায় পরিচালিত মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে তার শিক্ষা গুহণ শুরু। বর্তমানে সে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম শহরের একটি কলেজে অধ্যয়নরত। তার অভূতপূর্ব সাহস, ত্যাগ ও বিশ্বব্যাপী নারী শিক্ষা বিশেষ করে শিশু শিক্ষার সংগ্রামে অমূল্য অবদানের জন্য মালালা বহু পুরস্কার লাভ করেন। নিম্ন কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মান প্রাপ্তির উল্লেখ করা হলো : * ২০১১ সালে পাকিস্তান ন্যাশনাল ইয়োথ পিস প্রাইজ। * ২০১২ সালে মাদার তেরেসা এ্যাওয়ার্ড। * ২০১৩ সালে সাখারব প্রাইজ। * কানাডা সরকারের অনারারি সিটিজেনশীপ। * ২০১৪ সালে ওয়ার্ল্ড চিলড্রেন প্রাইজ (সুইডেন) * ২০১৪ সালে হ্যালিফ্যাক্স ইনিভার্সিটি অফ কিংস কলেজ প্রদত্ত অনারারি ডক্টরেট। * ২০১৪ সালে কো-রিসিপিয়েন্ট অফ দি ২০১৪ নবেল পিস প্রাইজ। মাত্র ১৭ বছর বয়সে মালালা ইউসুফজাই পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ নবেল লরিয়েট হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় বয়সের বিবেচনা তাদের কৃতিত্বকে স্লান করতে পারেনি। যে কোন প্রকারের বৈষম্য মানবাধিকারের পরিপন্থী এবং বয়স-বৈষম্য এর ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে কোন নাগরিকদের সুকাজের স্বীকৃতি বয়স বিবেচনা নয় বরং কৃতিত্ব ও অবদান বিবেচনায় দেয়া হয়েছে। আমার অনুমান, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘদিন পরেও বহু ক্ষুদে ভাষাসৈনিকদের পরিচিতি আমাদের নিকট অজ্ঞাত রয়েছে। আশা করি ভাষা আন্দোলন গবেষকগণ তাদের গবেষণার মাধ্যমে আর অনেক ক্ষুদে ভাষাসৈনিকদের পরিচিত ও বীরগাথা ইতিহাসের পাতায় তুলে ধরে ভাষা প্রেমী নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবেন। সুজনেরা বয়স- বৈষম্যনীতির উর্ধে উঠে সকল ভাষাসৈনিকদের প্রতি যথার্থ ও মর্যাদা প্রদান নিশ্চিত করবেন।
×