ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহার এখনও অবহেলিত

প্রকাশিত: ১০:২৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

  উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহার এখনও অবহেলিত

বিকাশ দত্ত ॥ বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেলেও দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টে এখনও বেশিরভাগ বিচারপতি ইংরেজীতেই রায় লিখছেন। আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগে ৯৯ বিচারপতি থাকলেও হাতেগোনা কয়েকজন বাংলায় রায় লিখছেন। এর আগেও কয়েক বিচারপতি বাংলায় রায় লিখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। রায় ইংরেজীতে হওয়ায় সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ থেকে শুরু করে আইনকর্মকর্তাসহ আইনবিশেষজ্ঞরা জানান, কয়েক বিচারপতি বাংলায় রায় ও আদেশ লিখছেন। এটি খুবই ইতিবাচক। ভবিষ্যতে তাদের পাশাপাশি আরও অনেক বিচারপতি বাংলায় লিখবেন। উচ্চ আদালতের রায়গুলো বাংলাতেই দেয়া উচিত। হঠাৎ করে না হলেও ধাপে ধাপে এগোতে হবে। কারণ বাংলার জন্য দেশের মানুষ আন্দোলন করেছে, প্রাণ দিয়েছে। আর বাংলায় রায় দিলে দেশের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে রায় দেখতে পারবে। আইন কমিশনের সুপারিশ ও বেশ কিছু বিচারপতির বাংলায় রায় দেয়ার পরও উচ্চ আদালতের বেশিরভাগ বিচারপতি ইংরেজীতেই রায় লিখছেন। নিম্ন আদালতগুলোয় বিচারকাজে বাংলার ব্যবহার বাড়লেও উচ্চ আদালতে এখনো অবহেলিত। কোন ভাষায় রায় দেবেন এটা একান্তই বিচারপতিদের বিষয়। তারা ইচ্ছা করলে যে কোন ভাষায় রায় দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহারে কোন বাধা নেই। নিম্ন আদালতের সিংহভাগ রায় ও আদেশ এখন বাংলায় হচ্ছে। আশা করি উচ্চ আদালতেও এক সময় বাংলা প্রচলন হবে, তবে সময় লাগবে। ১৯৮৯ সালের দিকে সর্বপ্রথম বাংলায় রায় দেন বিচারপতি আমীরুল ইসলাম চৌধুরী। এর পর সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান) ২০০৭ সাল থেকে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দু শতাধিক রায় বাংলায় দিয়েছেন। এদিকে বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেন ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে আজ পর্যন্ত সব রায়ই দিয়েছেন বাংলায়। তিনি বাংলায় প্রায় ৮ হাজার রায় দিয়েছেন। এর পরেই রয়েছে বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল। তিনি প্রায় অর্ধশতাধিক রায় দিয়েছেন বাংলায়। এ ছাড়াও সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেন, বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালসহ কয়েকজন বিচারপতি উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষায় বেশ কিছু রায় দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু সেই অর্থে তাদের অনুসরণ করেননি অন্য বিচারপতিগণ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি লাভ করেছে, মহান ভাষা আন্দোলনের সেই দেশেরই উচ্চ আদালতে আজও উপেক্ষিত বাংলা ভাষা। এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু একদিনে হবে না। অনেকেই বাংলায় রায় দিচ্ছেন। আস্তে আস্তে এই প্রচলন চালু হবে আশা করি। উচ্চ আদালতে রায়গুলো বাংলাতে অবশ্যই দেয়া দরকার। আইনগুলোও বাংলায় করা উচিত। বেশিরভাগ আইন ব্রিটিশ আমলের। সে সমস্ত নজীব বিএলডি, ডিএলআর, এগুলো ইংরেজীতে রয়েছে। বাংলা হওয়া উচিত। সংসদে আইনগুলো বাংলা করার উদ্যোগ নেয়া দরকার। বাংলায় আইন থাকলে বিচারপতিদেরও রায় বাংলায় দিতে সুবিধা হবে। সচরাচর যে সমস্ত আইন আছে সেগুলোকে বাংলায় ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টের আইনজীবী তালিকাভুক্তি লিখিত পরীক্ষার ড্রাফট বাংলায় হওয়া উচিত। আমি মনে করি আস্তে আস্তে সকল ক্ষেত্রেই বাংলার ব্যবহার জোরদার হবে। ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিনউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় ও আদেশ লিখছেন। এটি খুবই ইতিবাচক। ভবিষ্যতে তাদের পাশাপাশি আরও অনেক বিচারপতি বাংলায় লিখবেন। তবে ইংরেজীতে রায় ও আদেশ লেখারও প্রয়োজন রয়েছে। বহির্বিশ্বের বিচারাঙ্গনে আমাদের রায় যাতে ব্যবহৃত হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। কোনভাবেই যেন আমরা পিছিয়ে না থাকি। উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় হলে জনগণ জানতে পারবে। আমাদের কাছে ছুটে আসতে হবে না। বিচারপ্রার্থী জনগণের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতে আইনজীবীরা বিচার প্রার্থনা করেন। বিচারপতিগণ যে রায় দেন তা বোঝার শক্তি সেই সাধারণ বিচারপ্রার্থী জনগণের। এ রায় বোঝার জন্য তাকে কোন আইনজীবী বা অন্য কারোর কাছে যেতে হয়। এ ছাড়া হাইকোর্ট দায়রা আদালতের প্রদত্ত রায়ের পর্যালোচনায় যখন মৃত্যুদ- নিশ্চিত করেন, তখন ক্ষতিগ্রস্ত বা লাভবান পক্ষ, আসামি বা বাদী যে-ই হোন, তিনি ইংরেজী ভাষার কারণে প্রকাশিত রায় বুঝতে পারেন না, জানতে পারেন না কী কারণে এবং কিসের ভিত্তিতে তার দ-াদেশ বহাল থাকল বা খালাস হলো। একজন নাগরিক হিসেবে অবশ্যই মামলার ফলাফল জানার ও বোঝার অধিকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আছে। সে কারণে রায়টি বাংলাতে হলে সাধারণ জনগণ সহজে বুঝতে পারবে। রায়টি বাংলায় দিলে জনগণ ঘরে বসে সহজেই অনলাইনের মাধ্যমে দেখতে পারবে। আইনজীবীরা মনে করেন, অনেক বিচারপতি বাংলায় রায় দিচ্ছেন। একদিনে এটা সম্ভব হবে না। আস্তে আস্তে উচ্চ আদালতে বিচাপতিগণ বাংলাতেই রায় লিখবেন। এমন একদিন আসছে যখন উচ্চ আদালতে সকল রায়ই হবে বাংলায়। সে জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। আইনজীবীরা আরও বলেন, বিচারপতিগণ কোন ভাষায় রায় দেবেন এটা একান্তই বিচারপতিদের বিষয়। তারা ইচ্ছা করলে বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় রায় দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আইনকমিশন বিচারকাজে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ এর প্রয়োগ বিষয়ে একটি সুপারিশ করেন। ৬ বছর আগে তার ওই সুপারিশ আজও আলোর মুখ দেখেনি। ওই সুপারিশে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ সংবিধানের এ বিধান সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না দেখে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ (১৯৮৭ সনের ২নং আইন) জারি করা হয়। এর ধারা ৩-এর বিধান নিম্নরূপ “৩। (১) এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং আইনগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। (২) ৩ (১) উপ-ধারায় উল্লিখিত কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তা হলে উহা বেআইনী বলে গণ্য হইবে।” সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বিধৃত আছে যে, “আদালত” অর্থ সুপ্রীমকোর্টসহ যে কোন আদালত। ১৯৯১ সালের ১৭ নবেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভের পর বাংলা ভাষা নিজ দেশে অনেকটা অবহেলিত হয়ে আছে। নিম্ন আদালতগুলোতে বাংলা চর্চার প্রচলন রয়েছে। অবশ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি থাকাকালীন ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ প্রদান করেছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেছেন, আমাদের সংবিধানে ইংরেজীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছে। এমনকি আমাদের সংবিধানে বাংলা ও ইংরেজীর মধ্যে বিরোধ হলে বাংলাকেই প্রাধান্য দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রয়োগে কোন অসুবিধা দেখি না। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলন হলে জনগণ তা সহজে বুঝতে পারবে।
×