ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেছে

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ‘মাছের খনি’ বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছের সন্ধান পাওয়া গেছে। গত অর্থবছরে শুধু সাগর থেকে আহরিত হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টন মাছ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের এই মাছ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় সম্পদ। এটি এক বড় মাছের খনির নাম। দেশে যে পরিমাণ মৎস সম্পদ রয়েছে তার ১৬ ভাগের যোগান দিচ্ছে বঙ্গোপসাগর। ভবিষ্যতে এই সাগর থেকে আরও বেশি মাছ আহরণ করা সম্ভব। এজন্য ব্লু-ইকোনোমি বা সমুদ্র অর্থনীতির দিকে নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশ ব্লু ইকোনমি ডায়লগ অন ফিশারিজ এ্যান্ড লাইভ স্টক’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক কর্মশালায় বিশেষজ্ঞরা এ তথ্য জানান। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) যৌথভাবে এ কর্মশালার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু। কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন, এফএওর প্রতিনিধি জ্যাকুলিন এলদার। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রইছউল আলম মন্ডলের সভাপতিত্বে এতে আরও বক্তব্য দেন, এফএওর বাংলাদেশ প্রতিনিধি রবার্ট ডলাস সিম্পসন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম এ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়াল এ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলম, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত সিডসেল বেন্টকিন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (ব্লু-ইকোনমি) তৌফিকুল আরিফ, মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবু সাইদ মো. রাশেদুল হক। আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বিশাল সমুদ্রসীমা জয়লাভ বাংলাদেশের ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতির জন্য এক বড় পাওয়া। সাগরে মাছ, তেল, গ্যাসসহ নানাবিধ সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে মৎস্য সম্পদ বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। তিনি বলেন, দেশের মাছের ১৬ ভাগ আসছে বঙ্গোপসাগর থেকে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে। শুধু চিংড়ি রয়েছে ১৬ প্রজাতির এবং বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক ও জৈব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রয়েছে। গত ২০১৭-১৮ সালে দেশে উৎপাদিত মোট ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার মাছের মধ্যে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিকটনই এসেছে সমুদ্র থেকে। প্রসঙ্গত, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতে নিষ্পত্তি হওয়ার পর বঙ্গোপসাগরের আরও ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ অধিকৃত বর্ধিত এই সমুদ্রাঞ্চলে গবেষণা চালিয়ে ইতোমধ্যেই ৪৭৫ প্রজাতির বিপুল পরিমাণ মাছের সন্ধান পেয়েছে সরকার। এই ‘মাছের খনি’ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে বলে মনে করা হচ্ছে। দেশের মিঠাপানিতে রয়েছে মাত্র ২৫০ প্রজাতির মাছ। মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে মৎস্য আহরিত হয় ৪২ লাখ ৭৭ হাজার টন। এর মধ্যে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন ইলিশ রয়েছে। সমুদ্র সম্পদের সঠিক জরিপের মাধ্যমে মৎস্য আহরণ আগামীতে অনেক বেড়ে যাবে। এছাড়া প্রতিবছর এ অঞ্চল থেকে ৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন টন মাছ আহরিত হলেও এর মধ্যে মাত্র ০ দশমিক ২৯ মিলিয়ন টন মাছের হিসাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যোগ হয়। বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ছোট ট্রলার ও নৌকা মাছ আহরণে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই তুলনায় বড় ট্রলার নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে নজর দিয়েছে সরকার। দেশের মৎস্যজীবীদের জন্য বড় ট্রলারসহ আর্থিক সহায়তা এবং অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় ভারত ও মিয়ানমারের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় যুক্ত হয়েছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে উত্তরণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে সামুদ্রিক সম্পদের গুরুত্ব ও অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের ৫ লক্ষাধিক জেলে প্রায় ৭০ হাজার যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক নৌযানের সহায়তায় জীবিকা নির্বাহ করছেন। সেই সঙ্গে মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। আরভি মীন সন্ধানী নামের সমুদ্র গবেষণা ও জরিপ-জাহাজের মাধ্যমে সমুদ্রের চিংড়িসহ তলদেশীয় ও উপরস্থ মাছের জরিপের কাজও চলছে। জানা গেছে, মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামে বিশ্বমানের ৩টি এ্যাক্রিডিটেড ল্যাবরেটরি পরিচালনা করা হচ্ছে। ২০১৭-১৮ সালে ৬৮ হাজার ৯৩৫ টন সামুদ্রিক মাছ রফতানির মাধ্যমে দেশের আয় হয়েছে ৪ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। হিমায়িত ও জীবন্ত এসব সামুদ্রিক রফতানি পণ্যের তালিকায় রয়েছে চিংড়ি (হিমায়িত, কুকড ও বরফায়িত), মাছ (হিমায়িত ও বরফায়িত), কুচিয়া/ইল (জীবিত), কাঁকড়া (জীবিত ও হিমায়িত), শুঁটকি ও লবণাক্ত শুঁটকি, হাঙ্গরের পাখনা ও মাছের আঁশ। বর্তমানে বাংলাদেশের মাছ বিশ্বের ৫৬ দেশে রফতানি হচ্ছে। সর্বাধিক মাছ রফতানিকৃত ১০ দেশ হলো-নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, ফ্রান্স, আমেরিকা, জাপান ও রাশিয়া। মাছ ও চিংড়ির পণ্যে রেসিডিউ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমের সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালের এপ্রিলে ইইউ মিশনের সুপারিশে ইইউভুক্ত দেশে বাংলাদেশের মৎস্যপণ্য রফতানিতে টেস্ট সার্টিফিকেট জমাদানের বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করা হয়েছে। শুধু তাই নয় ব্লু-ইকোনমির বাস্তবায়নে উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের উন্নয়নে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২৪০ মিলিয়ন মান ডলারের ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল এ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট’ শীর্ষক বৃহত্তম একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। উপকূলীয় ও বঙ্গোপসাগরের জলজসম্পদ ও সুযোগ কাজে লাগাতে মন্ত্রণালয় নানামুখী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া আরভি মীন সন্ধানী নামক সমুদ্র গবেষণা ও জরিপ-জাহাজের মাধ্যমে সমুদ্রের চিংড়িসহ তলদেশীয় ও উপরিস্থ মাছের জরিপের কাজও চলছে। ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন ও দেশে মেরিকালচার লাভজনক হওয়ায় বাংলাদেশেও এই মেরিকালচারের প্রজনন-প্রযুক্তির গবেষণার মাধ্যমে মৎস্য-আহরণের সম্প্রসারণ ঘটানো জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে।
×