ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অনুমোদন দিয়েছে খনি কর্তৃপক্ষ

বড়পুকুরিয়ার ‘গায়েব’ কয়লাকে সিস্টেম লস দেখিয়ে প্রস্তাব

প্রকাশিত: ১১:০৮, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বড়পুকুরিয়ার ‘গায়েব’ কয়লাকে সিস্টেম লস দেখিয়ে প্রস্তাব

রশিদ মামুন ॥ বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ‘গায়েব’ কয়লাকে সিস্টেম লস দেখিয়ে প্রস্তাব অনুমোদন করেছে খনি কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি খনি কর্তৃপক্ষের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) বলা হয়েছে এক লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪শ’ মেট্রিকটন কয়লা সিস্টেম লস হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কয়লা উধাও হওয়া নিয়ে সারাদেশে হৈ চৈ হয়। তখন কয়লা খনির কয়েক কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিক সরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনকে দুদক এ বিষয়ে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয় সরকার। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা পৃথক কমিটি গঠন করে। খনি কর্তৃপক্ষ এজিএম সভার প্রতিবেদনে বলছে, ২০০৪ সাল থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু করে বড়পুকুরিয়া। তবে শুরুতে দুই সেট উত্তোলন যন্ত্রের মধ্যে এক সেট খনির মধ্যে আটকা পড়ায় দুই বছর তেমন কয়লা তোলা হয়নি। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে গিয়ে উত্তোলন বাড়তে থাকে। ওই মাসে বড়পুকুরিয়ার কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ৫৩ হাজার ৫৪৩ দশমিক ৭০ মেট্রিকটন। তখন সামান্য কিছু কয়লা বাইরে অন্য ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করা হলেও বেশিরভাগ কয়লা পিডিবির বিদ্যুত কেন্দ্রে সরবরাহ করা হতো। সে সময় অর্থাৎ ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ৩৮ হাজার ২২৪ মেট্রিকটন কয়লা কোল ইয়ার্ডে জমা ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সিস্টেম লসের হিসেবটা প্রতি বছর ধরেই করতে হবে। কোম্পানির কর্মকর্তা কর্মচারীরা প্রতিবছর কয়লার এই বর্ধিত উৎপাদনে বেশি লাভ দেখিয়েছে। এতে তাদের প্রফিট শেয়ারের পরিমাণ বেড়েছে। যারা এই সুবিধা নিয়েছে তাদের কাছ থেকে সব ফিরিয়ে নেয়া উচিত। পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক মাইন এ্যান্ড মিনারেল মকবুল-ই ইলাহী বলেন, আমি শুরু থেকেই বলছি এটা সিস্টেম লস। কিন্তু এটার তো হিসেব থাকতে হবে। সেটা যারা করেনি, করতে দেয়নি- বেশি করে কোম্পানির লাভ দেখিয়ে সেখান থেকে প্রফিট শেয়ার নিয়েছে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। প্রসঙ্গত কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোন কোম্পানির লাভের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বেতন ভাতার বাইরেও কোম্পানির কর্মীদের দেয়া হয়। বড়পুকুরিয়ায় এর পরিমাণ অনেকটাই বেশি। কোম্পানির নিজস্ব জনবল কম থাকায় প্রফিট শেয়ারের পরিমাণ বেশি হচ্ছে। খনিটিতে কাজ করা সাবেক এক এমডি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ধারাবাহিকভাবে কয়লা উত্তোলন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কখনই সিস্টেম লস হিসেব করেনি খনি কর্তৃপক্ষ। তার মতে ভূগর্ভস্থ খনি থেকে কয়লা তোলার সময় কয়লার সঙ্গে পানি ওঠে। কোন কোন ক্ষেত্রে কাঠের টুকরা এবং নুড়ি পাথরও ওঠে। কনভেয়ার বেল্টের নিচে স্কেল দিয়ে কয়লা মেপে নেয়া হয়। আবার আরেকটি কনভেয়ার বেল্ট দিয়ে বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্রে কয়লা দেয়া হয়। বিদ্যুত কেন্দ্রে যাওয়ার পথে কনভেয়ার বেল্টের পাশে পিডিবি শ্রমিক রাখে যাতে নুড়ি ও কাঠের টুকরো তারা ফেলে দেয়। ফলে এখানে কিছুটা ওজনে পার্থক্য হয়। এছাড়া অবিক্রীত কয়লা খোলা মাঠে রেখে দিলে বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে আগুন ধরে যায়। ভেতরে ভেতরে এই আগুন জ্বলে কয়লা ছাই হয়ে যায়। একইভাবে কয়লার ছোট অংশ যাকে ‘কোল ডাস্ট’ বলা হয় তা পানিতে ধুয়ে যায়। ফলে নানাভাবেই কয়লা কমে যায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কয়লাখনির সিস্টেম লস হিসেব করা হলেও আমাদের এখানে তা করা হয়নি, যা আরও আগে করা উচিত ছিল। কয়লা খনি কর্তৃপক্ষ যে হিসেব দিয়েছে তাতে দেখা যায় ২০০৪-০৫ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ১০১ লাখ ৬৩ হাজার ৯৯৪ দশমিক ৮২৫ মেট্রিকটন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। এই সময়ে পিডিবির কাছে মোট বিক্রীত কয়লার পরিমাণ ৬৬ লাখ ৬১ হাজার ৮৪৩ দশমিক ৫৪২ মেট্রিকটন আর পিডিবি ছাড়া অন্য গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা হয়েছে ৩৩ লাখ ১৯ হাজার ২৮১ দশমিক ৩০২ মেট্রিকটন। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যবহার দেখানো হয়েছে ১২ হাজার ৫২ দশমিক ২১৫ টন। এ ছাড়া ২৬ হাজার ১৮২ দশমিক ৩৭১ মেট্রিকটন মজুদ দেখিয়ে বাকি ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০০ মেট্রিকটনকে সিস্টেম লস দেখানো হয়েছে। প্রতিবছর প্রতিখাতে হিসেব দেখালেও শেষ বছরে এসে কয়লার ঘাটতিকে ‘সিস্টেম লস’ দেখানো হলো। খনি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলছেন, এর আগে সিস্টেম লস হিসেব করার জন্য একটি কমিটি করা হয়েছিল ওই কমিটি একটি প্রতিবেদনও তৈরি করে কিন্তু কমিটির রিপোর্ট সে সময় গ্রহণ করা হয়নি। ওই সময় খনিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যিনি যোগ দিয়েছিলেন তিনি বলেন, এর আগে এগুলো করা হয়নি। এখন এই ঘাটতির পরিমাণ দেখালে হৈ চৈ হবে কাজে, এমন কিছু করার দরকার নেই। কয়লা উত্তোলনের মাস প্রতি হিসেবে দেখা যায় এর আগেও দুইবার একেবারেই কোল ইয়ার্ডে কোন কয়লা ছিল না। কিন্তু তখন বিষয়টি প্রকাশ পায়নি। এর আগে ’১০ সালের আগস্টে কোল ইয়ার্ডে মজুদ দেখানো হয়েছে ২৯ হাজার ৪৬১ দশমিক ৭১ মেট্রিকটন আর আর ২০১৩ সালের এপ্রিলে মজুদ দেখানো হয় ৪০ হাজার ২২৭ দশমিক ৪০ মেট্রিকটন। এই দুই সময়ের কখনই কোল ইয়ার্ডে কোন কয়লা ছিল না। খাতাকলমে এই কয়লার হিসেব ছিল। কিন্তু তখন সিস্টেম লস হিসেব করার সুযোগ থাকলেও তা করেনি খনি কর্তৃপক্ষ। এবার কয়লা উধাও হওয়ার খবর প্রকাশের সময় গত বছরের শেষ দিকে জুলাইয়ে এক লাখ ৪৭ হাজার ৬৪৪ মেট্রিকটন মজুদ দেখায় খনি কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন খনির কয়লার কি পরিমাণ সিস্টেম লস হয় তার হিসেব নিরূপণ করে বছরপ্রতি হিসেব রাখা উচিত। তা না করা হলে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের সুযোগ নিতে পারে। তবে বিভিন্ন পক্ষ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে তাদের তদন্তের পর এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
×