ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ড. শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগ

প্রকাশিত: ০৯:০১, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে  ড. শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগ

১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের মেধাবী শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়টির তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বুলেট ও বেয়োনেটের আঘাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় ১৯৬৯ সাল ছিল এক বিশাল গণআন্দোলনের বছর। ১৯৬৬ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ছয় দফা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল দলিল হিসাবে প্রতিটি বাঙালীকে উজ্জীবিত করেছিল। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী প্রায়-ভঙ্গুর রাষ্ট্রটিকে বিভিন্নভাবে টিকিয়ে রাখার কূটকৌশল হিসেবে তখন কাল্পনিক এক ‘আগরতলা মিথ্যা মামলা’র নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর প্রিয় সংগঠন আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এবং ১৯৬৬ পেরিয়ে ১৯৬৯ পর্যন্ত পাকিস্তানীদের ঔপনিবেশিক অত্যাচারে বাঙালী ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এদিকে, বাঙালীর মুক্তি সনদ ‘ছয় দফা’ কে কেন্দ্র করে যেন কোন আন্দোলন দানা বাঁধতে না পারে সেজন্য আইয়ুব-মোনায়েম চক্র তাদের ঘৃণ্য কূটকৌশল অবলম্বন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের প্রায় সকল জ্যেষ্ঠ নেতাকেই ১৯৬৯ সাল অবধি কারাগারে আবদ্ধ করে রেখেছিল। এই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই ১৯৬৯-এর ৮ জানুয়ারি, তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়িতে দেশের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়েছিল। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ অতিদ্রুত ১২ জানুয়ারি পল্টনে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করে এবং এরই ধারাবাহিকতায়, ১৭ জানুয়ারি সমগ্র দেশে এক দাবি দিবস পালন করা হয়। এই দাবিগুলোর মধ্যে ‘দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান’, অবিলম্বে ‘জরুরী আইন প্রত্যাহার’ এবং সেই সঙ্গে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তির বিষয়টি ছিল অন্যতম। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ভোলা থেকে আগত তৎকালীন সময়ের তরুণ ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে দেশের সকল সমমনা ছাত্র সমাজকে একত্রিত করে গঠন করা হলো ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাঁদের এগারো দফা সংবলিত দাবি সরকারের কাছে পেশ করেন যার মধ্যে শেখ মুজিবের মুক্তির ইস্যুটিই ছাত্র সমাজেরও প্রধান দাবি হিসাবে গৃহীত হয়। এরই প্রেক্ষাপটে, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯-এর ১৮ জানুয়ারি দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট, ১৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ দিবস এবং ২০ জানুয়ারি সারাদেশে ছাত্রবিক্ষোভের আয়োজন করেন। ২০ জানুয়ারির মিছিল ছিল বিশাল এবং এটি নিয়ে আমরা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করার সময় ছাত্রনেতা আসাদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আসাদের মৃত্যু তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রসমাজকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ ও উদ্বেলিত করে তোলে। বলাবাহুল্য, আইয়ুববিরোধী-আন্দোলন তখন এক প্রচন্ড গতিময়তা অর্জন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ও সমমনা ছাত্রছাত্রীরা সমগ্র মাসজুড়েই কারফিউ ভেঙ্গে গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরই কিছু দিনের মধ্যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হিতাহিত জ্ঞান-শূন্য হয়ে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথিত অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে জেলের অভ্যন্তরে বন্দী অবস্থায় হত্যা করে এবং এরই ফলে দাবানলের মতো সমস্ত দেশের জনসাধারণ মুক্তিপাগল হয়ে ওঠে; আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশে। আসাদ থেকে শুরু করে, সার্জেন্ট জহুরুল হক, মতিউর রহমান এমনি অগণিত মৃত্যু আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারির গণআন্দোলনে। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেড় মাস সময়ের মধ্যে সমগ্র দেশে প্রায় অর্ধশত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ১৪৪ ধারা এবং কারফিউ দিয়েও পূর্ব বাংলার উত্তাল জনস্রোতকে আন্দোলন-বিমুখ করা সম্ভব হয়নি। এমনি একপর্যায়ে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বুলেট ও বেয়োনেটের আঘাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিক্ষক ও প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা নিহত হন। তিনি তখন তাঁর পেশাগত প্রক্টরিয়াল দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রদের পাকিস্তানী সেনাসদস্যদের হাত থেকে রক্ষার বিভিন্ন কৌশলী প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বুলেট ও বেয়োনেটের আঘাতে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। ড. জোহার মৃত্যুর ঘটনা শুধু দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্র্তী বিভাগীয় শহর রাজশাহীর মধ্যেই আবদ্ধ থাকেনি। তাঁর মৃত্যু দেশের চলমান আন্দোলনকেও এক ভিন্নতর গতি এনে দেয়। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সময়ের ছাত্ররা বিভিন্ন হল থেকে কারফিউ ভঙ্গ করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। ইতোমধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জোহার মৃত্যু-সংবাদ সমগ্র ঢাকা শহরের জনগণকে রাত্রির মধ্যেই উত্তাল করে তোলে এবং সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে জনতার ঢল রাস্তায় নেমে পড়ে। পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ বাধে। ঢাকার রাজপথে রক্তের স্রোত বয়ে যায় এবং এতে ওই রাত্রিতেই অন্তত ২০ জনের মৃত্যু ঘটে। দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষকরা এর প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। যার ফলে, দেশে সমগ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়। এরপরই উপায়ান্তর না দেখে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার অতি দ্রুত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হন। ড. জোহার মৃত্যু মূলত আইয়ুবের পতনকে ত্বরান্বিত করে এবং দেশময় সমস্ত সরকারী নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে যায়। বলাবাহুল্য, ড. জোহার মৃত্যুর মাত্র ৩৪ দিনের মধ্যেই জেনারেল আইয়ুব খান তার পরবর্তী সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। এরই ধারাবাহিকতায় আমরাও ধীরে ধীরে স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাই এবং এর পরবর্তী ইতিহাস সকলেরই জানা আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখনও ড. জোহাকে আঁকড়ে ধরে আছে কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর ১৮ ফেব্রুয়ারি শ্রদ্ধার সঙ্গে এই দিনটিকে পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আজও প্রথাগতভাবে এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একজন জোহা-স্মারক বক্তাকে এনে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ থেকে সারাদিন বিভিন্ন প্রোগ্রাম গ্রহণ করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটি সত্য যে, দেশের অন্য কোন স্থানে ড. জোহাকে নিয়ে কোন আলোচনা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় না। দেশে বর্তমানে এতগুলো টিভি চ্যানেল থাকলেও ড. জোহাকে নিয়ে কোথাও কোন বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করতে দেখা যায় না বললেই চলে। এমনকি খোদ রাজশাহীতেই শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তাঁকে নিয়ে সেভাবে কোন স্মরণানুষ্ঠান হয় না। দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। ড. জোহার স্মৃতিকে ধরে রাখবার জন্য এই দিনটিকে জাতীয়ভাবে উদযাপনের উদ্যোগ নেয়ার জন্য শিক্ষামন্ত্রীকে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি। লেখক : প্রাক্তন সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি); বর্তমানে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের প্রফেসর
×