ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার

প্রকাশিত: ১১:৪৩, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে প্রাণ উৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তৈরি হয়েছে শহীদ মিনার। মাতৃভাষার দাবিতে প্রাণ উৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণে ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাা দিবস। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত শহীদ মিনার নিয়ে লিখেছেন- নাঈম খান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় ১৯৫২ সালে। মিনারটির অবস্থান ছিল ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্র হোস্টেলের বারো নম্বর শেডের পূর্ব পাশে। শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উচ্চ ও ৬ ফুট চওড়া। উদ্বোধনের দিন অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানী পুলিশ ও সেনাবাহিনী প্রথম শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলে। এরপর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়ার পরে ১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু করা হয়। এর আগে ১৯৫৬ সালে আবু হোসেন সরকারের মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বর্তমান স্থান নির্বাচন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। তৎকালীন পূর্ত সচিব (মন্ত্রী) আবদুস সালাম খান মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে ‘শহীদ মিনারের’ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য চূড়ান্তভাবে একটি স্থান নির্বাচন করেন। এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৬৩ সালে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে। বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হামিদুর রহমান মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত শহীদ মিনারের স্থপতি ছিলেন। তারই রূপকল্পনা অনুসারে ১৯৫৭ সালে নবেম্বরে তিনি ও নভেরা আহমেদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সংশোধিত আকারে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ ব্যক্তিত্ব আবুল বরকতের মাতা হাসিনা বেগম নতুন এই শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কাছে হওয়ায় এই দুই ক্যাম্পাসে নতুন করে কোন শহীদ মিনার গড়ে ওঠেনি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে ঢাকা মেডিক্যাল ক্যাম্পাসের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সব স্তরের লোক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানালেও ছোট আকারে তাদের ক্যাম্পাসে আরও একটি শহীদ মিনার রয়েছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও রয়েছে একটি শহীদ মিনার। তবে সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে ২১ ফেব্রুয়ারিসহ বিভিন্ন দিনে ফুল দিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে প্রশাসন ভবনের সামনে দিয়ে পূর্বদিকে গেলেই দেখা মিলবে এই ক্যাম্পাসের দৃষ্টিনন্দিত শহীদ মিনার। এটি রাজশাহীর অন্যতম স্থাপত্যকীর্তি। শহীদ মিনারটি ২ লাখ ৯ হাজার বর্গফুট বা চার একর ভূমিতে ১২ ফুট উঁচু ৬ কোণা প্লাটফর্মের ওপর ৫৬ ফুট লম্বা চারটি স্তস্তম্ভ দিয়ে তৈরি। শহীদ মিনারটির পাশেই রয়েছে উন্মুক্ত মঞ্চ, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, রাকসু ভবন, কেন্দ্রীয় কাফেটারিয়াসহ আকর্ষণীয় ফুলের বাগান ও ১৮ হাজার বর্গফুটের সবুজ চত্বর। শহীদ মিনারের পটভূমিতে আছে বিখ্যাত শিল্পী মুর্তজা বশীরের ৩২১৬ ফুটের একটি বিশাল ম্যুরাল। রয়েছে শিল্পী ফনীন্দ্রনাথ রায়ের একটি ম্যুরাল। এই শহীদ মিনারের স্থপতি মুর্তজা বশীর। অমর ভাষাসৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশে ১৯৬৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল হামিদ, আব্দুর রাজ্জাক, বায়েজিদ আহমেদ, শমসের আলী, আহসানুল করিমসহ একাধিক ছাত্রের একান্ত প্রচেষ্টায় এক রাতেই শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনে শহীদ মিনার তৈরি করেছিলেন তারা। তারপর ১৯৬৪-৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চেষ্টায় শহীদ মিনারটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকবাহিনী শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলে। স্বাধীনতার পর বাংলা ১৩৭৯ সালের ২৬ বৈশাখ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ মিনারটি বর্তমান স্থানে পুনরায় নতুন করে স্থাপন করেন। বাংলা ৯ বৈশাখ ১৩৯২ বা ২৩ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলী এর উদ্বোধন করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে ‘অমর একুশে’ ভাস্কর্যটি পার হয়ে একটুখানি সামনে গেলেই চোখে পড়বে দেশের সব চেয়ে উঁচু শহীদ মিনারটি। মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে নির্মিত হয় এই শহীদ মিনারটি। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কলা ভবনের সম্মুখে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনারটি। ২০০৬ সালে নির্মিত হয়েছে এই শহীদ মিনারটি। ভূমি থেকে ৭১ ফুট উঁচু তিনটি ত্রিভুজাকৃতির স্তম্ভের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। ত্রিভুজটি সবদিকে ৫২ ফুট ব্যাসের ইটের চত্বরের ওপর স্থাপিত। মঞ্চের ব্যস ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের প্রতীক। এ ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০, ও ১৯৭১ মোট আটটি পর্যায়ে চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। তাই ’৫২ ফুট ব্যাসের মঞ্চটি আটটি সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে এসে স্থিতি লাভ করে। তিনটি স্তম্ভ প্রতীকায়িতভাবে বাংলার ভাষা, শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আলাদাভাবে ৭১ ফুট উঁচুতে উঠে শূন্যে মিলিত হয়ে একটি একক সত্তায় অভিন্ন রূপে প্রকাশ পেয়েছে। শহীদ মিনারটির স্থপতি শিল্পী রবিউল হোসাইন। শহীদ মিনার চত্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে এক অন্যতম প্রিয় একটি আড্ডার স্থল। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সিলেটে অবস্থিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ৩২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার। শহীদদের সম্মানের কথা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু একটি টিলায় ওই বছর ১২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। শহীদ মিনারটি ৫৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট একটি টিলায় ৬ হাজার ৮শ’ ৮৬ বর্গফুট জায়গা নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। মাটি থেকে শহীদ মিনারটির মোট উচ্চতা ৭৮ ফুট। এর ৯৯টি স্টেপ রয়েছে, যা ৩টা ফ্লাইটে বিভক্ত। মূল স্তম্ভটি আরও ৭টি সিঁড়ির ওপর অবস্থিত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য গর্ব ও আকর্ষণের এক অপরূপ নিদর্শন এই শহীদ মিনার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত দর্শনার্থীদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হলো এ শহীদ মিনারটি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের পূর্বাঞ্চলের অন্যতম বৃহত্তর বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও রয়েছে আকাশছোঁয়া দৃষ্টিনন্দন একটি শহীদ মিনার। এটি নির্মিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২৭ বছর পর। ১৯৯৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য রফিকুল ইসলাম চৌধুরী এ শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের নক্সা করেন ‘অপরাজেয় বাংলা’র স্থপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। প্রায় দশ শতক জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে গৌরবের অন্যতম নিদর্শনটি। বাংলার রূপ-প্রকৃতির বর্ণনা দিতেই ত্রিভুজাকৃতির মিনারের চূড়ায় রাখা হয়েছে শাপলা ফুলের কলি। মিনারের মধ্যখানে রয়েছে একটি কৃত্রিম সাগর, যা একসাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় উচ্চ শিক্ষার পাঠ নিতে আসা হাজার হাজার তরুণ প্রাণকে।
×