ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লে. কর্নেল মোঃ সাইফুল ইসলাম

ভেজাল, আইএফএসটি ও কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ভেজাল, আইএফএসটি ও কিছু কথা

ড. কুদরত-ই-খুদা ১৯৫৫ সালে ইস্ট রিজিওনাল ল্যাবরেটরিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান তেজগাঁও, ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিবেকবান বিখ্যাত এ বিজ্ঞানী নিশ্চয়ই এদেশের আপামোর জনগণের কল্যাণের জন্য ভেবেছিলেন আর বিবেকের তাড়নায় ও দায়িত্ব বোধের আলোকেই এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন। তিনি তার বিবেক দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে হয়ত বা সেদিন বুঝেছিলেন এদেশের মানুষের রাজনৈতিক মুক্তি একদিন হবেই কিন্তু ভেজাল হতে মুক্ত করতে হলে এদেশের মানুষের জন্য অবশ্যই বিজ্ঞানের গবেষণা, চর্চা ও নানাবিধ খাদ্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষার খুবই প্রয়োজন রয়েছে। তার সেই চিন্তা-চেতনা ও বিবেকের তাড়নায় হয়ত তিনি বহু কষ্টে গড়ে তুলেছিলেন সে দিনের সেই ইস্ট রিজিওনাল ল্যাবরেটরিজ নামক প্রতিষ্ঠানটি। সেই ছোট্ট প্রতিষ্ঠানটি কালের চক্রে একটু একটু করে আজ দেশের জনগণের আশা আর আস্থা অর্জন করে নিয়েছে। সে দিনের সে স্বনামধন্য বিজ্ঞানীর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানটি আজ কত রকমে সেজেগুজে একাকার হয়ে বিজ্ঞানচর্চায় তার দেশবাসীকে ভেজালের বেড়াজাল হতে মুক্ত করছে তার কথা কে-না জানে। দেশের বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানচর্চা করবেন, ভেজালমুক্ত রাখার জন্য নানাবিধ পদ্ধতির মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য ভেজালমুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করবেন। ভেজালকারী পণ্যের মালিককে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন ভেজাল থেকে দেশকে মুক্ত করার কথা বলবেন, লেখনী লিখবেন। সরকারকে ভেজালের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার নৈতিক ও মানবিক শক্তি যোগাবেন। বর্তমানে এ রকম বেশকিছু বিজ্ঞানী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন ওঋঝঞ (Institute of Food, Science and Technology) এর অধীনে। দেশের প্রয়োজনে এবং এ আধুনিক যুগের ভেজালের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে সময়ের প্রয়োজনে BCSIR এর অধীনে ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় IFST. ড. কুদরত-ই-খুদা আজ যদি বেঁচে থাকতেন তবে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত খুশি হতেন যে, এ দেশের সরকার ২০১২ সালে অত্যাধুনিক Biomedical and toxicological Research Institute তৈরি করেছেন, যেখানে মানুষসহ অন্য যে কোন প্রাণীর উঘঅ ঞবংঃ সম্ভব। এই উঘঅ ঞবংঃ করতে আমাদের বিদেশে যেতে হতো এবং এতে করে সরকারের বহু অর্থ ব্যয় করতে হতো। বর্তমানে এই উঘঅ ঞবংঃ-এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা দেশবাসীকে নানাবিধ সেবা প্রদান করছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সকল সদস্যের জন্য ভেজালমুক্ত পুষ্টিকর খাবার সরবরাহের গুরু দায়িত্বটি সাপ্লাই এ্যান্ড ট্রা›সপোর্ট ডিরেক্টরেটের উপর নির্ভর করে। নানা প্রতিকূলতায় ও সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে এই দায়িত্বটি তারা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পালন করে আসছেন। অঋঋউখ (Armed Forces Food and Drug Laboratory) ভেজাল নিরূপণে সার্বক্ষণিক তাদের পাশে রয়েছে। অঋঋউখ- এর কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত খাদ্য দ্রব্যের নানাবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে খাদ্য দ্রব্যের সঠিক মান বজায় রাখছেন এবং সেনাবাহিনীর সকল সদস্য প্রতিদিন ভেজালমুক্ত মানসম্মত খাবার গ্রহণ করছেন। ওঋঝঞ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে গত দেড় মাস ধরে যে আলাপ-আলোচনা ও বিজ্ঞানাগারে বহুবিধ Test ও তার ফলাফল জানলাম তাতে করে ভেজালের এক অদম্য আক্রমণে পরেছি আমরা। আমরা যে খাবার খাই তা মূলত তিনভাবে দূষিত হতে পারে (Physically, Chemically, Microbiologically). আমাদের দেশে খাদ্যদ্রব্যের ভেজাল যে কত শত প্রকারের হতে পারে সে সম্পর্কে দু-একটি না লিখলেই নয়। খাদ্যদ্রব্যের ভেজাল সম্পর্কে বলার পূর্বে ভেজাল কাকে বলে তা বোধকরি বলার অবকাশ রয়েছে। খুব সহজ করে বলতে গেলে, ভেজাল হচ্ছে কোন খাবারকে Physically, Chemically অথবা Microbiologically দূষিত করা যা খেলে মানব দেহের ক্ষতি হবে বা হতে পারে। দেশের সব ব্যবসায় ভেজাল না থাকলেও যে সকল ব্যবসায় ভেজাল বহু মাত্রায় রয়েছে তার অন্যতম হলো আমাদের খাদ্য দ্রব্যের ভেজাল। এবার জানা যাক, কিভাবে ভেজাল মেশানো হচ্ছে আমাদের খাবারে- ১. ধরুন, আপনি কাঁচা শাকসবজি কিনতে যাচ্ছেন তা হলে মনে রাখতে হবে যে এখানে বেশিরভাগ ভেজাল শুরু হয় মাঠ থেকে, বেশি করে পোকামাকড় দমনের ওষুধ প্রয়োগের দ্বারা এবং কোন কোন সময় অতিরিক্ত ভাল ফসলের আশায় বেশি কেমিক্যাল সার ব্যবহারের ফলে। ২. সবজি/ফল মূল ক্ষেত হতে তোলার পূর্বে অথবা পরে পাকানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে নানা কেমিক্যাল/কার্বাইড ব্যবহার করা হয়। তবে এখানে মনে রাখতে হবে কার্বাইড দিয়ে কলা বা অন্য কোন ফল পাকানো হলে তাতে অন্যদের কিছু করার বা ভাবার নেই যদি না তাতে মাত্রাতিরিক্ত কার্বাইড দেয়া না হয়। বিজ্ঞানীরা কার্বাইডের চাইতে প্রাকৃতিকভাবে তাপ বৃদ্ধির মাধ্যমে ফল পাকাতেই বেশি নিরাপদ মনে করেন। ৩. শাকসবজি কচি ও সতেজ রাখতে পটল, মটরশুটি, পেঁপে ইত্যাদিতে সবুজ রং (Malachite Green) মেশানো হয়। তাই বিজ্ঞানীরা বলেন, এসব বস্তু চেনার সহজ উপায় হলো শাক-সবজিগুলো পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে তা যাচাই-বাছাই করে দেখতে যদি পানিতে সবুজ রং দেখা যায় তবে তা ভালভাবে ধুয়ে তারপর সেগুলো রান্না করে খেতে। ৪. মাছে ফরমালিন মিশিয়ে বহুদিন তাকে সজীব রাখার একটি কৌশল যা ব্যবসায়ীরা হরহামেশাই করে থাকেন। এ মাছ চিনার উপায় হলো মাছের Dryness শুকিয়ে খসখসে ভাব এবং মাছের চোখ ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া। মাছের ফরমালিন মিশানো আছে কিনা জানার জন্য ওঋঝঞ আবিষ্কার করেছে ফরমালিন কীট। এ ফরমালিন কীট ব্যবহারের ফলে মাছের পানির রং পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মাছে ফরমালিন উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। মাছের ফরমালিন কীটটি IFST হতে যে কেউ ক্রয় করতে পারেন অত্যন্ত সাশ্রয়ী মূল্যে (প্রতিটি কীটের মূল্য মাত্র ২৫০ টাকা)। ৫. তরল দুধেও ফরমালিন দেয়া হচ্ছে আর তা নিরূপণ করার জন্য আমাদের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন ফরমালিন কীট। এ কীট ব্যবহার করলে দুধের রং এর পরিবর্তন হলে বোঝা যায় দুধে ফরমালিন রয়েছে। দুধের ফরমালিন কীটটি IFST হতে যে কেউ ক্রয় করতে পারেন অত্যন্ত সাশ্রয়ী মূল্যে (প্রতিটি কীট এর মূল্য মাত্র ১০০ টাকা)। প্রায়ই বাজারে মেয়াদ উত্তীর্ণ পাউরুটি বিক্রি করতে দেখা যায়। পাউরুটি, বাদাম জাতীয় বস্তুতে সহজেই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে বসে তাই পাউরুটি বা বাদামের উপর সাদা আবরণ পড়লে তা না খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ভাল, আর খেলে ক্যা›সারসহ নানাবিধ অসুখ হতে পারে। প্রায়ই বাজারে মেয়াদ উত্তীর্ণ আচার বিক্রি করতে দেখা যায়। দীর্ঘদিন আচার আলো-বাতাসে/রোদে না রাখার কারণে যদি তাতে সাদা প্রলেপ পড়ে তবে তা খাওয়া যাবে না, বর্জন করতে হবে। এই প্রকার আচার খেলে ক্যা›সারসহ নানাবিধ কঠিন রোগ হতে পারে। গোল মরিচের সঙ্গে পেঁপের বিচি মিশিয়ে ভেজাল গোল মরিচ বাজারে হরহামেশাই বিক্রি হচ্ছে। জিরার সঙ্গে ঘাসের বিচি মিশিয়ে ক্রেতাকে ঠকানো হচ্ছে। দারুচিনির সঙ্গে গাছের ছাল মিশিয়ে দারুচিনি বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। DDT (Dichloro Dipheûl Trichloroethane) একটি মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থ যা খাদ্য দ্রব্যের ভেতর প্রয়োগ করলে এবং সে খাদ্য দ্রব্যে আমরা যতই ধুয়ে, রান্না করে খাই না কেন এ রাসায়নিক পদার্থ আমাদের দেহে ঢুকে রয়ে যায় এবং তা প্রতিনিয়ত আমাদের শরীরের ক্ষতি সাধন করতে থাকে। DDT এর ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় এনে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে DDT ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে । গত ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে ‘জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস’ উপলক্ষে এক প্রদর্শনী মেলায় প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন যে, ‘কোন বিষ খেয়ে আমাদের দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হোক এটা আমরা চাই না। খাদ্যে ভেজাল দেয়াটা মনে হয় কিছু কিছু শ্রেণীর একটি চরিত্রগত বদভ্যাস। এটা বন্ধ করতে হবে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এরূপ নির্দেশের পর আশা করি জনগণ, ব্যবসায়ী ও এ দায়িত্বে নিয়োজিত সকল সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে খাদ্যে ভেজালরোধে তাদের শক্তি নিয়োজিত করবেন। ভেজাল সবসময় ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা এনে দেয় না মাঝে মাঝে নির্মমভাবে ব্যবসায় বিরাট অংকের ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশের বড় বড় সাইজের গলদা চিংড়ি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানি হতো, এখনও হচ্ছে। তাই বেশি লোভের আসায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চিংড়ির ভেতর ভেসলিন ও অন্যান্য পদার্থ মিশিয়ে ওজন বাড়িয়ে বিদেশে রফতানি করেছিল ফলে চিংড়ি মাছ রফতানিতে যে ধস নেমেছিল তা আমাদের সবারই জানা। নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চিত করতে এ ধরনের আরও বহুবিধ ঞরঢ়ং রয়েছে যা আপনার পরিবার পরিজনের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। এবার ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে দু’একটি কথা না লিখলেই নয়- আপনি ব্যবসা করছেন এতে দোষের কিছু নেই। ব্যবসার প্রচার-প্রসার যেমন দেশ ও জাতিকে তার উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছতে সাহায্যে করে, অন্যদিকে ভেজাল খাবারে প্যাথলজি, হাসপাতাল এবং ডাক্তারি ব্যবসা বাড়ালেও মানুষের জীবনের অবসান হয়, অকালে ঝরে পরে কত মানুষ, কত আপনজন। তাই জনগণের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও এগিয়ে আসতে হবে ব্যবসায়ের মাধ্যমে মানব সেবায়। তাই খাবার জাতীয় যে কোন দ্রব্য সামগ্রী বাজারে দেয়ার পূর্বে নিজ উদ্যোগে তা IFST তে ল্যাব Test করিয়ে নিন। এতে IFST-এর বিজ্ঞানীরা আপনাকে বলে দেবে আপনার উৎপাদিত/সরবরাহকৃত খাদ্য দ্রব্যগুলো মানুষের জন্য কতটা নিরাপদ। সরকার অনেক অর্থ খরচ করে এ দেশের মানুষের খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মুক্ত রাখার জন্য IFST (Bangladesh Standards Testing Institution) নামক একটি সংস্থা গড়ে তুলেছেন। ভেজাল রোধে এ সংস্থাটির অনেক সাফল্য রয়েছে সাধারণ জনগণ এ সংস্থাটির কার্যক্রম রোজার মাসে বিস্তারিত দেখতে পান। আশা করি, সংস্থাটি জনগণের এ সেবায় নিজেদের অতীতের মতো ভবিষ্যতেও নিয়োজিত রাখবেন। তাদের সুনাম ধরে রাখতে সচেষ্ট থাকবেন। ভেজাল নিরাময়ে ও দ্রব্যমূল্যেও অযৌক্তিক দামের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনটি টনিকের মতো কাজ করছে। ইতোমধ্যেই সংস্থাটির কার্যক্রম জনগণের ও প্রচার মাধ্যমের বেশ নজর কেড়েছে। তাই ভোক্তা অধিকার আইন যারা (ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর) সংরক্ষণ করে জনগণকে ভেজালের কঠোর জাল ছিন্ন করতে সাহায্য করছেন ও দ্রব্যের অতিরিক্ত মূল্যরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা নিচ্ছেন তাদের সাধুবাদ ও ধন্যবাদ দুটোই জানাই। একটি কথা অত্যন্ত পরিষ্কার করে বলা দরকার, ভেজাল রোধে জনসচেতনতার কোন বিকল্প নেই। জনগণ সচেতন হলে দ্রব্যের ভেজাল ও হঠাৎ উর্ধমুখী দাম অনায়াসে দূর করা সম্ভব। জনগণ সচেতন হলে ভেজালকারীরা ভয় পান, সরকার অবশ্যই উৎসাহিত বোধ করেন এবং নিজ দায়িত্বের প্রতি সরকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সজাগ হয়ে নানাবিধ পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। সবশেষে এটাও বলতে চাই, প্রচার মাধ্যম ও সাংবাদিকরা সর্বদাই জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে ও ভেজাল রোধে অত্যন্ত কঠিন নিয়ামকের কাজ করে থাকেন। ভেজালের বিরুদ্ধে তাদের এ মহৎ ও গতিশীল ধারা অব্যাহত থাকুক সে কামনায় রইলাম। লেখক : সেনা কর্মকর্তা, সেনাসদর, কিউএমজির শাখা (এসটি পরিদফতর), ঢাকা সেনানিবাস
×