ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তাহেরুল মাস্টারের কড়ইতলার পাঠশালা

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 তাহেরুল মাস্টারের কড়ইতলার পাঠশালা

সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র শিশুদের বিনে পয়সায় পড়ানোর ব্যতিক্রমী এক পাঠশালা গড়েছেন তাহেরুল ইসলাম মাস্টার। হতদরিদ্র শিশুদের বাড়ি বাড়ি থেকে ডেকে এনে তিনি তার খোলা আকাশের নিচের কড়ইতলার পাঠশালায় ভর্তি করেন। সেখানে তাদের অক্ষরজ্ঞান শিখানোর পর নিজে তাদের স্কুলে ভর্তি করে দেন। ঈশ্বরদী পৌর এলাকার বাসস্ট্যান্ড রেলগেট ছাড়িয়ে ঈশ্বরদী-রূপপুর মহাসড়ক ধরে এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে বেশ কিছু বস্তিঘর। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় ছিন্নমূল মানুষ ও দিনমজুর পরিবারের বসতি। মহাসড়কের পাশে এক কড়ই গাছের নিচে সেসব দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে তাহেরুল মাস্টার ২০১১ সালে গড়ে তোলেন বিনে পয়সার পাঠশালা। কোন অনুদানে নয় নিজ পেনশনের টাকা থেকেই চলছে তার পাঠশালার কার্যক্রম। আট বছর আগে মাত্র পাঁচ শিক্ষার্থীকে নিয়ে শুরু এ পাঠশালায় এখন শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ জন। এলাকাবাসী জানায় তাহেরুল মাস্টার ঈশ^রদীর বিভিন্ন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেছেন । একটানা ৩৯ বছরের চাকরি জীবন থেকে ২০১০ সালের এপ্রিলে অবসরে যান। অবসর জীবনে এসে তাহেরুল মাস্টার শিক্ষকতার নেশা কিছুতেই ছাড়তে পারছিলেন না। রূপপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অবসরের পরও ছাত্র ছাত্রীদের টানে প্রতিদিনই তিনি ছুটে যেতেন স্কুলে। স্কুলে গিয়ে ঘোরাফেরা করলেও পড়াতে না পাড়ার যন্ত্রণা যেন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। একপর্যায়ে বাড়ির পাশে রেলওয়ের জায়গায় কড়ই তলায় পাঠশালা খুলে সে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি খোঁজেন তাহেরুল মাস্টার। গত আট বছরে ঈশ্বরদী উপজেলার সারা গোপালপুরে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর এক পরম আত্মীয় হয়ে উঠেছেন তাহেরুল মাস্টার। বাড়ি বাড়ি ঘুরে স্কুলে না যাওয়া শিশুদের নিয়ে আসেন পাঠশালায়। নিজের পেনশনের টাকায় কেনেন শিক্ষার্থীদের বই খাতা পেন্সিল। পাঠশালার পড়া শিখে বড় হয়ে ওঠাদের ভর্তি করে দেন গ্রামের স্কুলে। দরিদ্র এসব শিশুদের প্রাইভেট কোচিংয়ের সামর্থ্য নেই। তাতে কি? তাহেরুল মাস্টার নিজেই কাঁধে তুলে নেন তাদের পড়া তৈরির দায়িত্ব। কখনো পুরনো ছাত্র ছাত্রীরাও স্বেচ্ছাসেবক হয়ে লেগে পড়েন প্রিয় স্যারের পাঠশালায়। শুরুর দিকে তাহেরুল ইসলামের কাজটা খুব সহজ ছিল না। কারণ, রেলওয়ের বস্তির পরিবারগুলোর শিক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। বরং বাচ্চাদের দোকান কিংবা অন্য কাজে লাগিয়ে টাকা আয়ের দিকেই তাদের নজর ছিল। সেই সব পরিবারে তাহেরুল মাস্টার দিনের পর দিন শিক্ষার প্রয়োজনিয়তা বুঝিয়ে তাদের বাচ্চাদের পাঠশালায় এনেছেন। নিজ টাকায় শিক্ষা উপকরণ কিনে দিয়ে আগ্রহী করেছেন পড়াশোনায়। সরেজমিনে তাহেরুল মাস্টারের পাঠশালায় গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, দীর্ঘ চাকরি জীবনে দেখেছি কত সম্ভাবনাময় কচি শিক্ষার্থী অর্থাভাব ও সচেতনতার অভাবে ঝরে পড়েছে। চাকরি জীবনেই আমার ইচ্ছা ছিল এদের জন্য কিছু করার। চাকরি থেকে অবসরের পর তাই এ পাঠশালা তৈরি করি। উপজেলা শিক্ষা অফিস বিনামূল্যের বই দিয়ে সহযোগিতা করে। এছাড়া বাকি সব খরচ আমি নিজেই বহন করি। ঈশ^রদীর পৌর এলাকার বাসিন্দা সেলিম সরদার জানান, তাহেরুল স্যারের নিজের আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দরিদ্র শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে চলেছেন। এর জন্য তিনি কখনও সরকারী বা বেসরকারী সহযোগিতার দিকে তাকিয়ে থাকেননি। সকল প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে তিনি পাঠশালা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বার্থপর আত্মমগ্ন সমাজে তিনি এক বিরল দৃষ্টান্ত। সকাল হতেই বহুদিনের পুরনো সঙ্গী ভাঙা সাইকেল চেপে বেরিয়ে পড়েন পাঠশালার কাজে। সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সেও ছুটে চলেন ক্লান্তিহীন। খোলা আকাশের নিচে তাহেরুল স্যারের পাঠশালায় শিক্ষাদানে কখনও বাদ সাধে রোদ, ঝড় কিংবা বৃষ্টি। তিনি বর্তমানে তার পাঠশালা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। কারণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পের সড়ক প্রশস্ত করতে ছেড়ে দিতে হচ্ছে পাঠশালার জায়গাটি। তাই তিনি উদ্বিগ্ন। শুধু তিনি নয়, পাঠশালা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন দরিদ্র অভিভাবকেরাও। তাই নতুন কোন জায়গায় বিনে পয়সার এই পাঠশালা চালাতে সরকারের সহযোগিতা চান তারা। তাতে আশ্বাসও দিয়েছে জেলা প্রশাসন। সারা গোপালপুর গ্রামের রেল বস্তির বাসিন্দা দিনমজুর রাবেয়া খাতুন জানান, কয়েক বছর আগে তাহেরুল স্যার তার ছেলেকে তার পাঠশালায় পাঠানোর জন্য বলেন। রাজি ছিলাম না। কিন্তু স্যারের চাপাচাপিতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাঠাতে বাধ্য হই। এখন বুঝতে পারি ছেলেকে স্যারের স্কুলে পাঠিয়ে আমি কি ভালই না করেছি। শুনছি এ জায়গা থেকে পাঠশালা তুলে দেয়া হবে। তাহলে আমাদের বাচ্চাদের লেখাপড়ার কি হবে? পাঠশালার জন্য স্থায়ীভাবে জায়গা বরাদ্দের দাবি জানান তিনি। পাবনা জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন জানান, শিক্ষক তাহেরুল ইসলামের পাঠশালার কথা উপজেলা প্রশাসনের কাছে শুনেছি। মহৎ এই কাজের স্বীকৃতি দিতে তাকে পুরস্কৃত করব। নতুন কোন স্থানে পাঠশালা স্থাপনে জেলা প্রশাসন সব ধরনের সহযোগিতা করবে। শিক্ষা যেখানে সর্বত্রই যখন বাণিজ্যিকীরণের পথে চলছে সে সময় তাহেরুল মাস্টারের মতো নিঃস্বার্থ মানুষদের শিক্ষার আলো বিস্তারে দিনের পর দিন এগিয়ে যাওয়া এ সমাজের যেন ভিন্ন চিত্র। তাহেরুল মাস্টারের পথ ধরে আরও অনেকেই শিক্ষা বিস্তারে এগিয়ে আসুক এ শুভ কামনা জানাই। -কৃষ্ণ ভৌমিক, নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা থেকে
×