ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শালুক

প্রকাশিত: ১২:৪৪, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

শালুক

গেন্দি পুনাইডা আমার গোটা দিন ধইরা অইদ বানে ঘুইরা গরুর ন্যাদা খাচি ভইরা আইন্না ভুর দেয়। বাঁশ, পাতা, খড়িমড়ি টুহাইয়া গাদ্দি মাইরা থোয়। হেতি দিয়া মনের সুহত ফলফলাইয়া আগুন জালাইয়া আইন্দা বাইড়া তগোর আক্ষইসা পেট ভরি। আর দামড়া মাইয়াডা দশ বৎসরে ঠ্যাং দিচ্ছে তাও যদি এহানকার কুডাডা ওহানকা লাড়ায়। ওই দামড়ি তোর লাজ, লজ্জা দুইয়া খাইছোত? এত মুখ করি তা-ও তোর শরম অয়না? এইবার তরে ঢাহার শহরে মাইনষের বাড়িত কামে পাডামু। বুঝবি কাম কইরা ভাত খাইতে ঠ্যালা কেমুন। বছর দশকের মেয়ে শালুক তার ফর্সা মুখটা হাসি হাসি করে বলে ঢাহা যামু না আমি। হুনছি ঢাহার মানুষ বড় ডাহাইত। কামের ছেরিগোরো মাইরা টাঙ্কিত গুইঞ্জা থোয়। কুনো কুনো বেডিরা বলে খুরচুনের (খুন্তি) ছ্যাক দেয়। আবার নাহি গরম পাানি, গরম ফ্যান শইল্যে ঢাইল্লা দেয়। না খাইয়া মইরা যামু তবু ঢাহাত যামু না বুছছোত নি মা? তোরে তো এমনডাই করণ দরকার। যেমন কুহুর হেমন মুঙ্গুর হারামজাদী কোনহান কার। পাশের ঘর থেকে মধ্য বয়সের শাশুড়ি বলে, ও বউ চোপাত্তা ক্ষ্যান্ত দ্যাও। এই জল্লা পুনাইডারে মুক কইরা শেষ কইরা হালতাছো। দিনে দিনে শইলডা কঞ্চি অইয়া যাতাছে। গতরে ভাত নাগে না তোমার মুহের দুষে। বাবারে বাবা কি মুখ, কি মুখ! কত শখ করি নাম দিছিলাম হালপা হালুক (শাপলা শালুক) তোর মুহের কান্নে হালপার নাহানই টিং টিঙ্গা অইলো শইল্যে আর গুস্ত অইলো না। ... ও – হ-রে দরদ! বুড়ি শয়তানডা, তুমিই নাডাডা, তোমার আসকারায় পুনাইডা মাথায় চড়ছে। শয়তানের খুডি অইতাছে। যহন সামাল দিবার জো পাবানা তহন মাইনষের কান ভারি করবা, মা কিমুন ম্যায়া সামলাবার পারে না। তহন তো মনে থাকবো না আসকারাডা কেডায় দেয়। দিন মান যে ফুলটুঙ্গি অইয়া ফড়িংয়ের লাহান উইড়া ব্যাড়ায়, বুঝ দিয়া বাইত কহাইবার জো পাও না? ও – ও বউ অতা কতা কইস না, সময় অইলে এমনিই ঘরে বইবো। বউ শাশুড়ির কথার মাঝে তাদের চোখে ধুলা দিয়ে কখন যেন হাওয়া হয়ে গেছে শালুক- তাই দেখে মায়ের মুখ আবারও চলতে লাগল ভারি বর্ষণের মতো। সেটা দেখে শাশুড়ি ঘরে গিয়ে কপাট লাগালো চুপিসারে। Ñএক ঝাঁক ছেলেপুলের মাঝে একা মেয়ে সবার সাথে তাল রেখে ঝপাঝপ পলো ঝাঁপিয়ে মাছ ধরছে। ঘরবাড়ি, নাওয়া খাওয়া, দাওয়া ভুলে শুধুই মাছের নেশা। বাবা ইনছার আলী গায়ের শার্ট মাথায় বেঁধে বিলের পাড়ে এসে বলে ওই বান্দরের বাচ্চা বান্দর এই দিকে আয় কতাছি, দেরুং যে না অয়। না-য়া বাজান আমুনা তুমি পিটনি দিবা। তরতরি আইলে পিটনি দিয়াম না। বাজান ঐ যে ডাঙ্গাত খালুইত অতা মাছ আছে বাইত নইয়া যাও। মাস আন্দিবনে, আমি দাদির নেইগা কয়ডা মাছ ধরি নি আই। খাড়া জাউল্লার পয়দা জাউল্লা তোরে মাছ ধরা বার করতাছি। এমুন শিক্ষা দিমু বাফের নাম বুইল্লা সারবি। আর্ট, সাট করে লুঙ্গি কাছামেরে বিলের পানিতে নেমে দৌড়ঝাঁপ করতে করতে অতি কষ্টে ধরে টেনে হিঁচড়ে পানিতে চুবিয়ে ভেজা শালিকের মতো করে ডাঙ্গায় তুলে বলে, আজকা তোর বাঁচন নাই। মাথায় রক্ত তুইল্লা সারছোস। আর কত জালাবি? গেরামের আর কয়ডা মাইয়া তোর মতো ছেরাইনগো লগে দিনমান ঘুইরা ব্যাড়ায়? বেজির বাচ্চা বেজি তোরে আজকা জেতা কবর দিমু ৩য় আমি এক বাফের পয়দা। মাটিতে শুইয়ে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে দুই হাতে বিলের নরম কাদা সরিয়ে তার ভেতর শালুককে শুইয়ে কাদা চাপা দেয়। অনেক দিনের যন্ত্রণা অসহনীয় মাথা চাড়া দিয়ে তাকে দিশা হারা করে তোলে। বড় আদরের মেয়ে, তাই হয়ত মুখটুকুতে কাদা চাপা না দিয়েই বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। বাড়িতে ঢুকতেই শালুকের মা রেবেকা বলে, খালি আতে এলকা এলকা ক্যারে? কুনাইডারে নি আল্যা না? বাফ অইছো না ড্যাঙ্গের মাতা অইছো। দিন মান জুয়া খেইল্লা দিশা পাওনা আবার আইছো সংসারী বনবার। যেমন বাফ তার তেমুন ম্যায়া। পারলে ফু জাইত্যা সংসার ফালাইয়া জাতিলা সংসারে পা-ও দিতাম। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে শাশুড়ি বলে ও-ও বউ ভর দুইফরে জাত-বেজাতের অইলো ডা কি? বাফ-বেডির উদ্ধার করতাছোস ক্যা? ইনছার আলী চড়া গলায় বলে মা, ঐ বালা জাতের বেডির কান্নে পুনাইডারে বিলের পারোত মাডি চাপা দি আইছি। এলা যদি ওর মনোত শান্তি লাগে। বুড়ো দাদি তার ব্যথায় টনটনা মাজায় হাত রেখে কুজো হয়ে পড়ি মরি করে বিলাপ করতে করতে বিলের দিকে ছোটে। তার বিলাপ শুনে পরিচিত জনেরা যে যার কাজ ফেলে তার সঙ্গে পা মেলায়। বুড়ো পায়ের জোর কই? পিছে পিছে দৌড়ানোর চেষ্টা করে, অন্যরা শক্ত পায়ে দৌড়ে যায় বিলের ধারে, দেখতে পায় কতগুলো কাক কা, কা রবে জটলা করে উড়ছে আবার মাটিতে বসার চেষ্টা করছে। সেদিকেই সবাই ছোটে। এ কি অবস্থা! কাকেরা শালুকের চোখ-নাক, মুখ ঠুকরে খাওয়ার চেষ্টা করছে। শালুক তা প্রতিরোধ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। দুদিকে মাথা দোলাচ্ছে সঙ্গে চিৎকার। কাকদের বকাবকি করছে ইচ্ছেমতো সঙ্গে বাবাকেই ডাকছে আব্বা ও আব্বা, আব্বা গো –ও-ও-ও। যারা এসেছিল তারা মাটি সরিয়ে বের করে যখন দাঁড় করায় ততক্ষণে বুড়ি দাদি এসে তাকে জড়িয়ে ধরে মরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। উহ্ হুরে গরমে পিন্দাডা গেল গা। মানুষ জন্ম না লইয়া কুমির জনম লইলেও বালা অইতো। দিনমান পানা পুকুরে চুইবব্যা থাকতাম। বড় নুকগো শীতল ঘরের নাহান আরাম পাইতাম। ঘরের দাওয়ায় বসে রেল লাইনের থেকে কুড়ানো পাথরে ঠাস ঠাস আওয়াজ তুলে পাঁচ ঘুঁটি খেলতে শালুক বলে, মা বালাই কইছেত মাছ অবার চাস নাই। তইলে তো আমিই ধইরা খালুইত কইরা বাড়িত নই আইতাম দাদি কুইট্টা ধুইয়া আইন্দা স্বাদ কইরা মাছ কাটা, শুদ্ধা চাবাই, চাবাই-খাইতো। কেমুন অইতো মা? চোপ শয়তানের পয়দা শয়তান, কুমির অইলেই বালা অইতো দাদি, নাতি, দুইডারেই গিল্যা খাইতাম। গিল্লা খাইও বাদে। ক্যাদায় হিলানের পর থাইহা মাছ ধরবার খাইনা ভরা গুষ্টি হুদা ভাত আর নাইল্যা হাফ (পাটÑশাক) দিয়া মুখ পচাই সারছো। ক্যারে বাজার থেইক্যা মাছ, গুস্ত আনবার জো-পাওনা? গুটি খেলার সাথী ছোট কোন ফুলি বলে ও বু তুমি কাইল থাইহ্যা মাছ ধরবার যাইও। আইন্ন্যা ভাত আর খাবার মন ধরে না। রাতে শাক ভাত দেখে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে ইনছার আলী, পত্তি দিন এই পাতা ছাতা দিয়া ভাত গিলন যায়? সংসারডা ঠিক মতো দেখভালও করবার জো পাস না। এমুন এ্যারা বেডি দিয়া নাভডা কি? নাভ কি হুনবার চাস? আয় হুনাই, এক কথায়, দুই কথায় প্রচ- ঝগড়ার রূপ মারপিটে গিয়ে ক্ষান্ত হয়। দ্যুৎতুরী, সংসারের গুষ্টি কিলাই বলে পরনের লুঙ্গি হাঁটুতে এনে ঝাড়া মেরে গামছা কাঁধে বেরিয়ে পড়ে ইনছার আলী। রেবেকা পরদিন ভোর বেলায় ঘুম ভেঙ্গে কলতলায় গিয়ে দেখে কলের হ্যান্ডেল নেই। কপালে করাঘাতের সঙ্গে বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে এত বড় ডাহাতিডা কোন জাউরার পুতে করল গো কোন জাউরার পুতে...। শাশুড়ি ঘর থেকে বের হয়ে বলে গেছেরে পানি খাওনের কাম সাইরা কাম সাইরা। আজীবন মাইনষের কলের পানি খাইয়া জিউ বাঁচাইছি আর মাইনষের অতা অতা মুখ নছি, নাতি-গুতা খাইছি। বউডার উছিলায় বাড়িত কলের মুখ যাও দেখলাম তাও চুরি অইয়া গেল গা! শাশুড়ি, বউয়ের বিলাপে উঠোন ভরল স্বজন আর পড়শী দিয়ে। কতজনের কত কথা। পাশের বাড়ির বিল্লাল বলে অ-অ ভাবি সাব ফাইন্দা আর কি অব? কলের মাথা তো কাইল আইতোত ইনছার ভাই নি গ্যালগা। অতা কথা কইস না আজার গ্যান্দার নামে কোন্ চোরায় নিছে হেইডা দেখ, বলে বুড়ো মা ইনছার আলীর। হাফ দিয়া মাছ ডাহুইন না যে, মাছটা ম্যালা ডাঙ্গার ঐ জল্লা হাফ দিয়া ডাকপার পার কইন? চোরের মার গলা ইডারেই কয়। ঘরের চোরা বড় চোরা, কাইল গোটা আইত বাইরে রইছে। অহন ও দেহা নাই বুড়ি তোর পুতই জুয়া খেইল্যা কলের মাথা আরাইছে। কবে না ঘরের বউ ও বাজিত রাহে। রাখলেই অইছে এক কাপুড়েই যামু গা ব্যাডাগো লগে। যেই কামান দাগাইবার পারছ না হেই কামান দাগাইবার যাস ক্যারে? ইনছার আলী তিন দিন, তিন রাত পার করে চোরা চোরা ভাব নিয়ে ঘরে ঢুকে বলে ভাত-ভুত দিবিনি কিছু দে। রেবেকা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ঐ ফুলটুঙ্গির পুত ঘরে কুনোডা আইখ্যা গেছিলি? খারাব চাস? তুই এডা মরদ? এতডি মানুষ পানি খামু কইডে একবারও চিন্তা করলি না? আমার পুনাইডির কথা নাই ভাবলি তোর বুড়া মার কথা ডাও ভাবলি না? তোর গুষ্টিতে ডোবার পানি খাইয়া জিউ পার করছে আমার বাফের লাইগ্যা কল দেখছোত তা-ও শেষ করলি? এইবার কল দিব তোর কোন বাফে? আগের বার তো ঘরের কপাট বেইচ্যা খাইছিলি। এইবার কলের মাথা। গর্জে উঠে ইনছার ঐ হারামজাদী চোপা বন্ধ। কল আমি খাইছি আমি দিমু তোর এত জ্বলে ক্যা? কপাট ছাড়া ঘরোতই থাকপি। এক কথায় দুই কথায় ঝগড়া গড়ায় বহু দূর। শেষতক দুই দুটো লাঠি ভাঙে রেবেকার পিঠের পর। কয়েকদিন ঘরে থাকলেও ইনছার আলীর কলের মাথা বিক্রির পর থেকে শুরু হয় শাপুর হাটে, মাঠে জ্বলে, খালে দৌড়ানো। রেবেকা কথা শুনতে না পেরে ইনছার আলীর ভয় দেখায়। শালুক হাসতে হাসতে বলে, আমি তো ছুডোমুডো আকাম করি আর করার তো বড় বড়রা করে, তাইলে আমারে আর কি কইবো, কুন মুহুত কইবো কওদিহি? বলে দৌড়ে যায় বাড়ির বাইরে। সারাদিন খবর নেই। কোথায় গেল, কোথায় গেল? বাড়ির সবার খাওয়া নাওয়া বন্ধ ইনছার আলী ডোবা, নালা, কচুরি পানা, খাল, বিল চষে বেড়ায় আর আল্লাকে বলে আল্লা ওরে তুমি বাঁচাইয়া রাইহো, কার মনে কি শয়তানী কেডায় জানে? শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল বাজার রাস্তার শেষ মাথার জঙ্গলের মাচায়। ঘোষপাড়ার শ্যামল ঘোষের ছেলে বিমল ঘোষই দিয়ে গেল খবরখানা ঘোর সন্ধ্যায়। লিচু বাগানের লিচু পাহারার জন্য যে মাচা পেতেছে শ্যামলরা সেই মাচায়ই শালুক উঠে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। খবর শুনে পড়ি মরি করে সবাই ছুটে গিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে মাচা থেকে নামিয়ে আনে। তার পর থেকে প্রায়ই তাকে সেই মাচায় দেখা যায়। ইনছার আলী শত চেষ্টায়ও ফেরাতে না পেরে নিজের বাড়ির আমগাছে ছোট করে একখানা মাচা পেতে দেয়। সবাই বেশ খুশি। দিনের বেশিরভাগ সময়ই মাচায় কাটায়। কিন্তু নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে ঘরের মধ্যে। মুড়ি মুড়কি বাতাসা বিক্রি করে কত আর আয়? তবু যা পায় সঙ্গে রেবেকা পরের বাড়িতে ফুট ফরমাইশ খেটে যা পায় তা দিয়ে কষ্টে দিন চলছিল অথচ ঘর থেকে এটা সেটা উধাও হচ্ছে সঙ্গে পকেটের টাকা পয়সাও যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। ইনছার আলীর সন্দেহ গিয়ে পড়ে রেবেকার ওপর। প্রথমে জিগ্যাসা করে ভালোয় ভালোয়। পরে গালাগালি, তারও পরে মারামারি। মার খেয়ে রেবেকা বিলাপ করে কাঁদে। বুড়ি শাশুড়ি টিকতে না পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বলে ও-ও চোরের বেটি একুট চোপ থাহন যায় না? কুরিও করস গলাও বাজাস, ক্যারে আমার গ্যান্দাডার কষ্টের কামাই নলা ডুবাইয়া খাস আবার জোলা করম নাগবো ক্যা? বাপের বাড়িতে বেলটিং করবি। গেন্দাডার নগে খাবার দিলিনা জুদা কইরা দিলি এই কান্নেই? (কারণে)? ফহুন্নীর বেটি, নোলাও জোবাবি, গলাও করবি জোলাও করবি সাথোথ মরা কান্দনও কান্দবি। রেবেকার মরা কান্না বিদায় গলা দিয়ে বিশাল বিশাল, বোমা পড়তে লাগল, ওরে ঘার্টের মরা, এমনিতে নড়ার জো পাওনা আমার গেন্দা গেন্দা পুনাইগো দিয়া পানি টানাও, মাছ ধরাও, কুডাও, ইডা করাও হিডা করাও অনকা দি জ্যাতা অইয়া সারছোত। এই ঝগড়া বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয়ার আগেই রোজার ছোট বোন ফুলি এসে মাকে চোখের ইশারায় ঘরে নিয়ে খাটো গলায় বলে মা তুই দাদির লগে ঝগড়া বাদাইছোস ক্যারে? আগে তোর বড় ম্যায়ার কা- হুন। ওডা আবার কি করল? ওডা গেরাম পাড়ানী বাদ দিয়া সাধু সন্ন্যাসী অইয়া গাছোত বইছে, অনকা সাধু বাবাজি গাছোত চইড়া ধুমা খায় এই দেহ বিড়ির পিছা। কস কি? আরে এডি তো তোর বাফে ফালায়। কইছে তুমারে, তুমার এডা কতা, ব্যাঙের এডা মাতা। এডি মাচার থন নই আইছি, আস্তা বিড়ির ঠোস লগে ম্যাচও গুঞ্জাইয়া আকছে (রাখছে), তোমার ঐ মরদ বেডি। বিশ্বাস না অয় আতো নাতো দেহামু। অলস দুপুরে সোনালু গাছের ছায়ায় ঘরের চালে ঘুঘুর ডাকে যখনই চোখে তন্দ্রা আসে তখনই ফুলি এসে ফিসফিসিয়ে বলে মা তরতরি আয়। দেখবি তোর ম্যায়ার কা- কারখানা। চোর ধরার সকল কৌশল অবলম্বন করে। ধীর পায়ে মাচার গোড়ায়- দাঁড়িয়ে মাচার উপরে চোখ রাখে। দেখে এলাহী কা- পায়ের উপর পা রেখে আধ শোয়া হয়ে দাদির পানের বাটার পান চিবুচ্ছে হাতে ধোঁয়া ওঠা বিড়ি ফুকছে সঙ্গে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গুনগুনিয়ে গানও গাচ্ছে। নিজেকে রেবেকা সামাল দিতে পারল না, শালুকের চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে মাটিতে এনে চড়, থাপ্পড়, লাথি দিয়েই চলছে, দিয়েই চলছে। ইনছার আলীর গভীর ঘুমের ভাটা পড়ে লাল দু’চোখ কচলাতে কচলাতে এসে সব দেখে-শুনে মাথায় হাত দিয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে আকাশ দেখে। নিঃসিম আকাশে চিল ডেকে যায় চিলের কান্নায় ইনছার আলীর গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। পরদিন সকালে শালুক ইনছার আলীকে বলে বাজান আমি ঢাহায় যামু কাম করতে। ইনছার আলী মনে মনে এমনটাই চেয়েছিল, মেয়ের মুখ থেকে শুনে দেরি না করে পাশের বাড়ির চাচিকে গিয়ে বলে, ও চাচি তুমি ঢাহা যাবা কবে? ম্যালাদিন কইছো যেই কসাত কাম কর সেইহানে শালুকেরে নিবার চাও। শালুক যাবার চায় নাই। এইবার মত ঘুরছে, নিজেই যাবার চায়। পান খাওয়া লাল কালো মিশেলের দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলে, আমি দুইদিন বাদে জুম্মা করে যামু। চিন্তা করিস না। আমার লগেই থাকবো। দেখশুন কইরাই রাখমু। রাতে দাদির গলা ধরে শুয়ে শালুক বলে বলে ও দাদি তোর মুুহের চাবানি পান খাওয়া তো। আর কবে না কবে খামু ঠিক নাই। ডুকরে ফেঁদে উঠে দাদি বলে ওরে আমার হালকা হালুক তুই-না ঢাহার কথা শুনলে ডরাস? আবার কস ঢাহাত যাবি। এই জল্লাপোনাই তোর কষ্ট অব না? আমার কষ্ট ওক তোরা তো সবাই ভালা থাকপি। আমিও ভালা থাকমু। কান্দিস না, তোরে ফুন দিমু ট্যাহা পাঠামু। সবাইকে ছেড়ে চিরচেনা খাল, বিল, ঘন জঙ্গল, ধানক্ষেত সব কিছু পেছনে ফেলে, বুক ভরা কষ্ট চোখ ভরা জল নিয়ে ঢাকাগামী বাসে উঠে বসে শালুক।
×