ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দু’টি গল্প

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

দু’টি গল্প

এই সময় হাতে প্রচুর টাকা পয়সা থাকে কামালউদ্দিনের। এবার নাই। হাত খালি। খালি মানে একদমই খালি। তবু সে দোকানের ক্যাশবাক্সটা খুলে দেখে কয়টা আধুলি, একটা নষ্ট ম্যাচলাইট কিছু পুরনো মেমো ছাড়া কিছুই নেই। দোকানের অবস্থাও খারাপ। মালঝাল নাই, কাস্টমার নেই। সে বাক্সটা মাটিতে নামিয়ে জলচৌকির উপর গামছা বিছিয়ে জোহরের নামাজ পড়ে শুয়ে পড়ল ওখানেই। বাজারের সবগুলো দোকানই প্রায় বন্ধ। একদম শেষ মাথায় শুধু আক্কাসের চা-স্টলটা সন্ধ্যার আগে আগে খোলে। সন্ধ্যার পর নাকি মুক্তিবাহিনীর লোকজন মাঝে মাঝে আসে, চা সিগারেট খেয়ে চলে যায়। কামালউদ্দিন অবশ্য কোনদিন দেখেনি তাদের। দেখার কথাও না। সে নিরিবিলি সহজ সরল মানুষ। বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে মেয়েটাকে বর্ডার পার করে দেয়ার পর সে ভেবেছিল মুক্তিবাহিনীতে যাবে। কী কারণে যেন আর যাওয়া হয়নি। মা-মরা কিশোরী মেয়েটার কথা মনে করে সে আতঙ্কিত হয়। ভিনদেশে বৃদ্ধ বাপটার সাথে কোথায় কীভাবে আছে কে জানে! তার ভয় করে। মনে মনে স্থির করে সেও চলে যাবে শীঘ্রই। এসব ভাবতে ভাবতে যখন একটু তন্দ্রা চলে এসেছে এমন সময় দোকানের টিনের ঝাঁপে দমাদম বাড়ি পড়ল। আজ বোধহয় আর রক্ষা হলো না। ধরফর করে ওঠে কামালউদ্দিন। আমি হাজরা পাগলি। ডরাইস না। ও কামাল ডরাইছস? দ্যাশের অবস্থা ভালা না কিন্তুক। হিন্দুস্তান থিকা পিঁপড়ার মতো সৈন্য ঢুকতাছে হুনছোস? খানসেনারা পাগলা কুত্তা হইয়া গ্যাছে। সজাগ থাক। দিনদুপুরে ঘুমাইস না। ম্যালেটারি আইসা চান্দি ছেন্দা কইরা দিয়ে যাব গা ট্যারই পাবি না। কামালউদ্দিন বিরক্ত হয়ে বলে তফাত যা হাজরা, জ্বালাইস না। পাগলি বিড়বিড় করতে করতে চলে যায়। হাজরা পাগলি কয়েক বছর থেকে এই বাজারেই থাকে। কোথা থেকে এসেছে কেউ জানে না। নিজেই বলে সে নাকি কামরূপ কামাখ্যায় ছিল চৌদ্দ বছর। মন্ত্রটন্ত্র সব শিখে এসেছে। সারাদিন সেসবই জপ করে। আর কামালউদ্দিনের দোকানের সামনে বটগাছের নিচেই সবসময় পড়ে পড়ে ঘুমায়। সেদিনই সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে মিলিটারি ঢুকে পড়ল বাজারে। বড় রাস্তার ওপর ব্রিজটা পার হয়ে বাজারে আসতে হয়। সেটা মুক্তিবাহিনী আগেই ভেঙ্গে দিয়েছে। তার পরও তারা পার হয়ে এলো কীভাবে কামালউদ্দিন ভেবে পায় না। মিলিটারির দল দেখে পাগলি কোথা থেকে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনেরা কারা? পাকসেনা না হিন্দুস্তানী? শুনেই মেজর একটা লাত্থি মারল পাগলির কোমরে। পাগলি বাবা গো, বলে পড়ে গেল মাটিতে। মেজর এগিয়ে এসে কামালউদ্দিনের কাছে উর্দুতে জানতে চাইল, তুম আকেলে ইহাপে কিউ? অর সবলোক কাহা? বাজারকো ছব দুকান মুকান বন্ধ চুকা গিয়া কিঁউ? কামালউদ্দিন কাচুমাঁচু করতে লাগল। কিছু বলতে পারল না। মিলিটারিদের সঙ্গে কয়েকজন বাঙালী আছে। তাদের একজন বলল, স্যার সবাই ভয়ে পালিয়ে গেছে। মেজর রেগে গিয়ে বলল, লেকিন ইয়ে খানকিকো বাচ্চোছে ডর কিউ নেহি আতা? বাজারের নাম রায়গঞ্জ। এটা শুনে মেজর রেগে গেল আরও। মেজর গোঙগাতে গোঙগাতে উচ্চারণ করল, কয়েকবার মালউনকা মকান। রা-য়-গ-ঞ্জ। তার দোকানের নামটা শখ করে টিনের ওপর বড় বড় করে শহর থেকে লিখিয়ে এনে দোকানের সামনে লাগিয়েছে। রং ওঠে গেছে কোথাও কোথাও সাইনবোর্ডের। ভাল করে খেয়াল না করলে বোঝাই যায় না। মেজরের চোখ পড়ল সেটার ওপর। সে চোখ সরু করে লেখাটা পড়ার চেষ্টা করছে তা বোঝা যাচ্ছে। শুয়োরকা বাচ্চা তেরা দুকান কিসকা? কামালউদ্দিন বিরবির করে বলল, স্যার, হাঁড়ি বাসনের দোকান। নাম ক্যায়া? সে আরও আস্তে করে নামটা বলল। মর্দো ছে বাত নেহি আতা কিউ, জানোয়ার? সে জোরে উচ্চারণ করল, ‘কামনা বাসনালয়’। কামনা আমার মেয়ের নাম। তার নামে রাখছি। কামনা... মতলব ইশক খায়েস!!! ইয়ে মাগিকা বাচ্চা মালাউন হ্যায়! বলেই জোরে একটা লাত্থি মারল। স্যার আমি হিন্দু না, আমার নাম কামালউদ্দিন। ওকে, ওপেন ইওর ক্লোথ। শো ইওর পেনিস। কাপড়া খোলকে নিশানা দেখা উসকা। কামালউদ্দিনের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। দরদর করে ঘামতে লাগল সে। এখনই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তার মনে হলো ব্যাপারগুলো ঘটছে স্বপ্নের মাঝে। স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেলেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কাপড় খোলকে দেখা মাদারচোদ। ঝটপট, জলদি কর। এর মধ্যেই পাগলি আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। ও কামাল কাপড় খুলবি না তুই? খবরদার! ডরাইস না কামাল, আমি আছি। শুনে কামালউদ্দিনের চোখদুটো যেন চিকচিক করে উঠল মুহূর্তেই। মনে হলো কত অবহেলা করেছি পাগলিকে। কতদিন খাবার চেয়ে চেয়ে না খেয়ে পড়ে থেকেছে। দেইনি। আজ মায়ের মতো মনে হলো তাকে। কোনমতে আজকের দিনটা পার হলেই সকালে পাগলিকে নিয়ে চলে যাব মেয়ের কাছে। আর থাকব না এখানে। মেজর এর মধ্যেই একজন সৈন্যকে নির্দেশ দিল কামালউদ্দিনের লুঙ্গিটা খুলে ফেলতে। সে এসে লুঙ্গিটা টান দিয়ে খুলে দিতেই পাগলি দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল কামালউদ্দিনকে। মেজর চিৎকার করে বলল, ফায়ার টু দিস বাস্টার্ড ওমেন। সঙ্গে সঙ্গেই অনেকগুলো শব্দ হলো বিকট। আর সেই শব্দে ‘কামনা বাসনালয়’-এর সামনের বটগাছটা থেকে একঝাঁক সন্ধ্যাপাখি উড়ে চলে গেল কিচমিচ করতে করতে।
×