ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

খুরশীদ আলম বাবু

অন্য জীবনানন্দ

প্রকাশিত: ১২:৩৮, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

অন্য জীবনানন্দ

জীবনানন্দ দাশের শতবর্ষ বেশ কিছুদিন আগে পেরিয়ে গেছে। কবি জীবনানন্দ দাশের ভাতিজা অমিতানন্দ দাশের ভাষ্যানুযায়ী আটশতর মত কবিতা এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ মারা যান ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর, ৫ কার্তিক রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে প-িত শম্ভুনাথ হাসপাতালে। ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যার একটু পরে দেশপ্রিয় পার্কের কাছে (অনেকটা উদাসীন ভাবে) নিবিড় গভীর ভাবে ভ্রমণরত অবস্থায় বালিগঞ্জমুখী ট্রামের ধাক্কায় জীবনানন্দ দাশ আহত হয়ে আট দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হেরে যান। পরের দিন কেউড়াতলা শশ্মান ঘাটে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। শশ্মান যাত্রায় সঙ্গী ছিলেন উপন্যাসিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। মৃত্যু সংবাদ শুনে সুদূর বজবজ থেকে ছুটে এসেছিলেন তৎকালীন তরুণ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। কবি জীবনানন্দ দাশ ধর্মে বিশ্বাস করতেন না। তবে মানুষের নৈতিকতায় বিশ্বাস করতেন। ঠিক এই রকমই বলেছিলেন চল্লিশের অনুজ কবি অরবিন্দ গুহকে। তবুও তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল হিন্দু শাস্ত্রের বিধান মতে। কবি বুদ্ধদেব বসু একবার বলেছিলেন, আমাদের তিন প্রধান কবি কেউই হিন্দু ছিলেন না। এই তিনজন হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশ। শোনা যায় জীবনানন্দ দাশকে দুর্ঘটনার পরে হাসপাতালে দেখতে এসেছিলেন সেই সময়কার মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্দ্র রায়। তবে কবি হিসেবে বিখ্যাত বলে নয়- এসেছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারীদের একজন বলে। জীবনানন্দ দাশ ও নজরুল ইসলাম একই সালে জন্মগ্রহণ করলেও নজরুল ইসলাম যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষচূড়ায় উঠে গেছেন- জীবনানন্দ দাশকে তখন চিনতেন মূলত অনুজ কবিরা। তবে এটা ঠিক যে, কমরেড মুজফফর আহমদ সম্পাদিত ‘গণবাণী’ পত্রিকায় (২৭ শ্রাবণ ১৩৩৩) জীবনানন্দ দাশ কবিতা লিখেছেন। পাঠকের জ্ঞাতার্থে কবিতাটি তুলে দিলাম : নহি আমি উঞ্ছবৃত্তি, উদাসী ভিক্ষুক; দ্বারে দ্বারে যাচ্ঞা মাগি বেড়ায় না মন। মোর তাই নাই শঙ্কা, নাই নিষ্পেষণ; ন¤্র নহে শির মোরÑনত নহে বুক। বিজয়ী সৈনিক আমি, আমার কার্মুক করিতেছে অহরহ অসত্য খ-ন; টঙ্কারে টঙ্কারে ভরি ধরার অঙ্গন ছুটিতেছে চিত্ত মোর উৎসাহী, উৎসুক। কোথায় চকিত ভীত যাত্রিকের দল? নির্জিতা বসুধা কোথা? নিপীড়িত জীব! কোথা হিংসা, অত্যাচার, অসুরের বল! কোথা সিংহাসন জুড়ে জেগে আছে ক্লীব! আছি আমি সব্যসাচী,Ñদৃপ্ত, অচঞ্চল, হস্তে মোর অনিদ্রিত উদ্যত গা-ীব! (বিজয়ী) সেই কবিতাই বোঝা যায় জীবনানন্দ দাশ কোন ভাবেই সমাজ বিছিন্ন কবি ছিলেন না। তবে জীবনের শেষ দিকে তার কবিতার বিরুদ্ধে জনবিছিন্নতার অভিযোগ প্রবলভাবে উঠেছিল। আর সেই কারণে ‘বনলতা সেন’র তন্ময় কবি কিছুটা জোর করে সমাজ সচেতন হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। কবি বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ দাশের সেই প্রচেষ্টাকে সমর্থন দেননি। এমনিতেই জীবনানন্দ দাশের কবিতার ছন্দ নিয়ে নানাবিধ ভুল ব্যাখ্যা ছড়াচ্ছিল সমালোচকরা। যেমন সমসাময়িক আরেকজন খ্যাতমান কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত মনে করতেন জীবনানন্দ দাশ ভুল ছন্দে কবিতা লিখেন। বিশেষতঃ চল্লিশ দশকের বিশাল সমাজবাদী কবিরাই জীবনানন্দ দাশকে শক্তিশালী কবি মেনেও তার বিরুদ্ধে প্রবল জনবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ আনলেন। যেমন সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘বনলতা সেন’ এর সমালোচনায় শানালেন পিলে চমকানো অভিযোগ। শোনা যাক সুভাষের সেই ভাষ্য : “জীবনানন্দের কবিতায় দেশ কাল সংখ্যা বা নামের ব্যবহার কোন কিছু নির্দিষ্টি করে বলার জন্য নয়। বিমূর্ত ভাবের তারা প্রতীক। অলৌকিক জগৎ দেখা দেয় ভৌগোলিক নামে। নিরাকার প্রেমের প্রতিমা হয়ে দেখা দেয় নাটোরের বনলতা সেন, পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যাল, বিলুপ্ত ধূসর কোনো পৃথিবীর শেফালিকা বোস। তুমূলভাবে আন্দোলিত জল যতটা যাথার্থ্যের সঙ্গেই ‘বনলতা সেন’-এর কবি জীবনকে প্রতিফলিত করেন। বস্তুকে তিনি একটা একটা করে বেছে নিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেন শূন্যতার অতল গহ্বরে। প্রত্যেকের মুখে তিনি এঁটে দেন কুয়াশার একই মুখোশ। (সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নির্জনতম কবি, পরিচয়, শ্রাবণ ১৩৬০/১৯৫৩) শুধুমাত্র সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই নয় আরো অনেকেই সমকালীন কবি জীবনানন্দ বিরোধী সমালোচনার রথযাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে যেমন ছিলেন মণিন্দ্র রায়, আলোক সরকার, পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়, এমনকি পঞ্চাশের খ্যাতনামা কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ও। অবশ্য সুভাষ মুখোপাধ্যায় পরে স্বীকার করেছেন যে, জীবনানন্দ দাশ কেন্দ্রিক সমালোচনা ছিলো একটা নিমর্ম ভুল। এবারের তার শতবর্ষ উৎযাপনে পশ্চিমবঙ্গের বামধারার কবি গোষ্ঠীও বাংলাদেশের ঐ চেতনার কবিরা বড় বেশি তৎপর ছিলো। জীবনানন্দ দাশ তিরিশের সেইকবি, তিনি রক্ষণশীল গোষ্ঠী (এদের নেতৃত্বে ছিলেন সজনীকান্ত দাশ।) ও বামধারার কবিদের দ্বারা ক্রমান্বয়ে সমালোচিত হয়েছেন। অথচ লক্ষণীয় জীবনানন্দ দাশ (‘পৃথিবী ও সময়’ শারদীয় সংখ্যা, সোনার বাংলা ১৩৪৪) স্বপ্ন চারিতার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবধারায় ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। এর জন্য লিখিত ক্ষোভ প্রকাশ করছেন কবি বুদ্ধদেব বসু ও অশোক মিত্র। যদিও এই ফিরে আসাকে পাঠকদের কাছে বিশেষ করে বামবাদী লেখকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সেই কারণে জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতা বামধারার পত্রিকাসমূহে প্রকাশিত হয়নি। বামধারার সম্পাদকরা তাঁর কবিতা প্রকাশে গররাজী ছিলেন। অবশ্য জীবনানন্দ দাশ তাতে বিন্দুমাত্র দমে যাননি। এটা স্বীকার করার সময় এসেছে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি প্রকৃতপক্ষে ছিলেন লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। জীবনানন্দ দাশের জীবদ্দশায় সজনীকান্ত দাশের ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার তাঁর কবিতা ছিলো নিয়মিত আক্রমণের বস্তু। আক্রমণের রচনাবলি মূলত লিখিত হতো সজনীকান্ত দাশের হাতে। অবশ্য পরবর্তীকালের পর্যালোচনায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সে সমস্ত লেখক ও কবিদের শক্তি ছিলো সজনীকান্ত দাশ তাদেরই সমালোচনা করছেন। এত করে সেই সমস্ত লেখক কবিরাই উপকৃত হয়েছেন। হয়তো এই কারণে জীবনানন্দ দাশ সমসাময়িক কবি ও লেখিকা বাণী রায়কে বলেছিলেন সজনীকান্ত দাশকে বলবেন, ‘তিনি যেন আমার বিরুদ্ধে আরো লিখেন।’ তবে এই প্রচারণার একটি মাত্র উত্তর আমাদের নজরে এসেছে ‘কালপুরুষের উক্তি’ নামে একটি ছোটখাটো নিবন্ধে, যা প্রকাশিত হয়েছিল ‘ধূপছায়া’ পত্রিকার আশ্বিন ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে। জীবনানন্দ দাশের এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, তিনি আপাতত আলাভোলা ধরনের মনে হলেও, আদৌতে সেই রকমের ছিলেন না। তিনি এসবের খোঁজখবর রাখতেন। তবুও এসব বিরূপ সমালোচনার বিরুদ্ধে কলম ধরতে নারাজ ছিলেন। কবি মণিন্দ্র রায় একবার মাসিক ‘সীমান্ত’ পত্রিকায় তার কবিতার বিরূপ সমালোচনা করলে অনুজ কবি ও প্রাবন্ধিক সুরজিৎ কুমার দাশগুপ্তকে চিঠিতে জানান : সীমান্ত আমি দেখি নি। কী লিখেছে জানি না। কিন্তু এ সম্বন্ধে প্রতিবাদ করে কী লাভ? শুদ্ধসত্ত্ববাবুর নিজের আলোচনায় ঢের ভুল। মণীন্দ্র রায়ের কোনো ধারণা নেই। আমার মনে হয় সঞ্জয়বাবু কিছু লিখলে ভালো হয়। ডক্টর বোস (সমালোচক অমলেন্দু বসু) তো খুব ভালো সমালোচক; কিন্তু তিনি কি এখন লিখবেন? তুমি নিজে কী ভাবে লিখতে চাও? তোমার লেখাটা আমাকে দেখিও তো। আমার কবিতা সম্বন্ধে চারদিকে এত বেশি অস্পষ্ট ধারণা যে আমি নিজে এ বিষয়ে একটি বড় প্রবন্ধ লিখব ভাবছিলাম। কিন্তু শরীর বড় অসুস্থ; কোনো কাজই করতে পারছি না। (শ্রেষ্ঠ জীবনানন্দ, আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত, ঢাকা, পূর্ণমুদ্রণ : ২০১২, পৃ.৬৭১-৬৭২) এর মধ্যে সব সমালোচনারধারা অতিক্রম করে জীবনাননন্দ দাশ ক্রমান্বয়ে আলোচিত হতে থাকেন। তবে সেই সময় কবিতা অনেক বড় বড় পত্রিকায় প্রকাশিত না হলেও তাতে করে খুব একটা বেশি হতাশ হতেন না। অনেক তরুণ কবি তার কবিতাকে তাদের আলোচনার তালিকায় রাখছেন। চল্লিশের বিশিষ্ট কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভক্ত। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে সবসময় তাঁকে (জীবনানন্দ দাশ) মহৎ কবি বলে মনে করতেন। তিনি জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পা-ুলিপি’ পড়ে এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন তার কবিতার ভাষাভঙ্গীই বদলে যায়। জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর আলাপ পরিচয় পরবর্তীকালে গভীর হলে একথা শুনে, জীবনানন্দ দাশ তাকে ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থ উপহার দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নিজেই আমাদের জানাচ্ছেন এই বলে : এর মাস কয়েক বাদে একদিন বার্তা বিভাগে (দৈনিক স্বরাজ) এসে আমার হাতে একটি প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে পরক্ষণেই তিনি দ্রুত পায়ে তাঁর নিজের টেবিলে ফিরে যান। প্যাকেট খুলে দেখি ভিতরে একখানা বই রয়েছে। প্রথম সংস্করণের ‘ধূসর পা-ুলিপি’। ভিতরের পাতায় লিখে দিয়েছেন ‘শ্রী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রীতিভাজনেষু।’ তলায় তাঁর স্বাক্ষর। তার নিচে তারিখ, ৭ ফেব্রুয়ারি’৪৭। (ধূসর পা-ুলিপি, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, জীবনানন্দ স্মৃতি, উজ্জ্বল কুমার দাস সম্পাদিত, সাহিত্যম্, ২০০০, কলকাতা, ভারত।) তবে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মোটেও সমাজবাদী কবি ছিলেন না পাশাপাশি বুদ্ধদেব বসুর নেতৃত্বাধীন ব্যক্তিবাদী কবিদলের মধ্যে নিজেকে একেবারে বিলিয়ে দেননি। চল্লিশের দশকের এই গুরুত্বপূর্ণ কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় হাত গোণা কবিতা লিখেছেন। সেই তুলনায় সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় তার কবিতার উপস্থিতি ছিলো প্রবল। কবি ও সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের প্রতি তার শ্রদ্ধাও ছিলো অপরিসীম। জীবনানন্দ দাশের জীবনের শেষ দিকে খাটি কবি বন্ধু বলতে সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে সমালোচকরা চিহ্নিত করেছেন। এই সঞ্জয় ভট্টাচার্য পরবর্তীতে কবি জীবনানন্দ দাশের উপর প্রথম পূর্ণাঙ্গ সমালোচনাগ্রন্থ ‘জীবনাননন্দ দাশ’ সৃজন করেছিলেন। তবে এই মাখামাখি সম্পর্ক কবিবন্ধু বুদ্ধদেব বসু ও সমালোচক অশোক মিত্রের কাছে ভালো ঠেকেনি। কারণ এই পর্যায়ে জীবনানন্দ দাশের ‘মহাপৃথিবী’ ও ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছিলো, এই দুটি কবিতাগ্রন্থে দেখা যাচ্ছিল জীবনানন্দ দাশ ক্রমান্বয়ে তার সমাজ মনোস্কতার পরিধিকে বাড়িয়ে তুলছেন। সঞ্জয় ভট্টাচার্য অনেকটা তাই মনে করতেন। তবে এটা ঠিক যে, সমাজবাদী কবিদের অধিকাংশের কবিতায় যে ধরনের মারদাঙ্গা আশাবাদীতার স্তরে উঠে গিয়ে নতুন সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখছিলেন, তার কবিতায় সেই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল না। সেটাইতো আবার সমাজবাদীদের মনঃপূত হচ্ছিল। অবশ্য তার জন্য জীবনানন্দ দাশের কোন দুঃখবোধ ছিলো না। আর এই সমস্ত কবিতার মননশীলতা তার কবিতার রীতি প্রকরণকে আলাদা করে তুলছিল। জীবনানন্দ দাশের এই মনোভঙ্গী কবিতায় কেন আসলো সেটাও গবেষণার বিষয়। ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থের সমালোচনায় বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্যের খানিকটা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। বুদ্ধদেব বসু লিখলেন : ইতিহাসের চেতনাকে তার সাম্প্রতিক রচনার বিষয়ীভূত-করে তিনি এইটেই প্রমাণ করার প্রাণন্তকর চেষ্টা করছেন যে, তিনি পেছিয়ে পড়েননি। করুণ দৃশ্য ও শোচনীয়। এর ফলে তার প্রতিশ্রুত ভক্তের পক্ষে তার কবিতার সম্মুখীন হওয়া সহজ আর দুর্বোধ্য বলে আপত্তি নয়, নিরসুর বলে আপত্তি, নিরস্বাদ বলে। (‘কবিতা’ চৈত্র, ১৩৫০, সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু) এত সমালোচনা হওয়া সত্ত্বেও জীবনানন্দ দাশ খুব কমই সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটালেন তার অনুজ কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বেলায়। কি ঘটনা ঘটেছিল সেটাই আগে উল্লেখ করা জরুরী। চল্লিশ দশকে বিশাল সমাজবাদী কবি গোষ্ঠীর একজন ছিলেন রামেন্দ্র দেশমুখ্য। চল্লিশ দশকেই শ্রীহট লেখক ও শিল্পী সংঘ থেকে ‘ধানক্ষেত’ নামে তার একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থটির পুরনো কপি অনেক চেষ্টা করেও জোগাড় করা যায়নি। হয়তো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এই কাব্যগ্রন্থের সমালোচনায় কবি ও সমালোচক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী অহেতুক মন্তব্য করে বসেন ‘রামেন্দ্র দেশমুখ্যের কবিতা জীবনানন্দ দাশের আত্মঘাতী ক্লান্তি থেকে মুক্ত।” (উল্লেখ্য, সেই আলোচনার শিরোনাম ছিল ‘ধানক্ষেত’। রামেন্দ্র দেশমুখ্য। শ্রীহট্ট লেখক ও শিল্পী সংঘ প্রকাশিত। আলোচনা : নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।) এই অভিযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য “আট বছর আগে’র মত বহুল আলোচিত কবিতাটিকে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেন। এই সমালোচনাটি প্রকাশিত হয় ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৩ সংখ্যায়। মূলত এই আলোচনাটি পড়ে জীবনানন্দ দাশের মত রোমান্টিক কবি স্ফুলিংয়ের মত জ্বলে উঠলেন। তিনি এবারই অনুধাবণ করলেন এই আলোচনার প্রতিবাদ করা দরকার। আমাদের সৌভাগ্য তিনি বেশ নাতিদীর্ঘ উত্তরপত্রে তার কাব্যিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ও বিশ্বাস পাওয়াটা সহজতর হয়ে যায়। যেমন পাওয়া যায় শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় (প্রথম প্রকাশ বৈশাখ ১৩৬১/১৯৫৪, প্রকাশক : নাভানা)। উত্তরটা সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের হাতে পড়লে তিনি সেটা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা শিরোনামে আলাদা করে ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার আষাঢ় ১৩৫৩ সংখ্যাটিতে প্রকাশ করেন। এই আলোচনায় দীপ্র ভাবে তার কবিতা কেন্দ্রিক মনোভাব পাওয়া যায়, যা পরবর্তীকালের জীবনানন্দ দাশের কবিতার উপর আলোচনার কালে একরকম প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জীবনানন্দ দাশ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন- তিনি সমাজ সচেতন ছিলেন। তবে সমাজবাদীদের মত উগ্র ছিলেন না। আরো স্মরণ করিয়ে দিলেন কবির কবিতা নিয়ে আলোচনা করলে তার কবির ব্যক্তিগত মানসিকতা জড়ানোটা অপসমালোচনার লক্ষণ। বলা বাহুল্য : জীবনানন্দ দাশের এই দীপ্র তেজস্বী মতামত এর আগে কখনো পাওয়া যায়নি। বোঝা যায় যে, জীবনানন্দ দাশ বেশ ক্ষিপ্তই হয়েছিলেন। শোনা যাক সূত্রকারে তার উত্তরের বেশ কয়েকটি চুম্বক অংশ:Ñ রামেন্দ্র দেশমুখ্যের বই রিভিউ করতে গিয়ে নীরেনবাবু বলেছেন : ‘জীবনানন্দ দাশের আত্মঘাতী ক্লান্তি থেকে তিনি মুক্ত। ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ আমার কবিতার প্রধান আবহাওয়া নয়, কোনো দিনই ছিল বলে মনে পড়ে না। ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’র অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করবার জন্য তিনি লাসকাটা ঘরের কবিতাটি বেছে বের করেছেন। এ কবিতাটি প্রায় ১২/১৪ বছর আগে রচিত হয়েছিল। কবিতাটি ংঁনলবপঃরাব নয়, একটা ফৎধসধঃরপ ৎবঢ়ৎংবহঃধঃরড়হ মাত্র; কবিতাটি পড়লেই তা বোঝা যায়। ঐধসষবঃ বা খবধৎ বা গধপনবঃয এর ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’র সঙ্গে শেক্সপীয়ারের যা সম্পর্ক ও কবিতার ক্লান্তির সঙ্গে লেখকের সম্পর্কটুকুও সেই রকম। ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ বা আজকের যুগের যে-কোনো রকম ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু ‘আশাবাদী মনোভাব’ কবচের মতন যে- কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞানালয় থেকে কিনে আনলে চলবে না। সে মনোভাব আশাবাদী হতে পারে, কিন্তু তা আরোপিত ও আড়ষ্ট-স্বাভাবিক ও সার্বজনীন নয়। তবে তার সমসাময়িক বামধারার কবিদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে কটাক্ষ করে বলেছেন : জ্ঞান-বিজ্ঞানালয়ের প্রাচুর্য আজকাল অনেক। ওরা প্রত্যেকেই বিজ্ঞানী ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির মালিক। কবি তা জানেন। নিজেও সে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি মেনেই চলে; না হলে সে কবি হিসাবে দাঁড়াতে পারত না। শেষাবধি তিনি বাম-মনা সমালোচকদের সমালোচনা করেছেন এই বলে : আধুনিক অনেক সমালোচকই কতকগুলো শব্দ, বাক্য ও শ্লোগানের দাস মাত্র, যুক্তিবিচার ও অন্তর্দৃষ্টির ধার ধারেন না। ‘আশাবাদ’, ‘আশাবাদী মনোভাব’, ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি’ ইত্যাদির ছেলেমানুষি বাজারি অর্থ ঘুচিয়ে প্রত্যেক বিশিষ্ট কবির সম্পর্কে-তাদের কবিতার প্রতিভানুষঙ্গে ব্যবস্থিত হয়ে এদের যথার্থ সত্য সংজ্ঞালাভ করা প্রয়োজন। এর মানে এ নয় যে কবিতার ভাবপ্রতিভাই সব, বৈজ্ঞানিক চেতনা অবান্তর; তা নয়; বৈজ্ঞানিক ও অন্যান্য নানা শ্রেষ্ঠ চেতনার ভিতর থেকেই মহৎ কবিতা জন্মলাভ করছে। শেষবধি কবিদের সফলতা সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন এই বলে : ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ বা আজকের যুগের যে কোনো রকম ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু ‘আশাবাদী মনোভাব’ কবচের মতন যে কোন জ্ঞান-বিজ্ঞানালয় থেকে কিনে আনলে চলবে না। সে মনোভাব আশাবাদী হ’তে পারে, কিন্তু তা আরোপিত ও আড়ষ্টÑস্বাভাবিক ও সার্বজনীন নয়। ‘প্রচুর হয়েছে শস্য, কেটে গেছে মরণের ভয়’ বালভাষিত, কিন্তু কবিতা নয়; শস্য প্রচুর হলেই কি ‘মরণের ভয়’ কেটে যায় না আজকের এই জটিল শতাব্দীকে, শিশুকে এ কথা বোঝাবে? নীরেনবাবু হয়তো মনে করেন এরকম কতগুলো লাইন লিখতে পারলেই কবিতা হয়, আশাবাদী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় এবং আত্মঘাতী ক্লান্তির থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব; বৈজ্ঞঅনিক দৃষ্টিভঙ্গিরও উদয় হয়। কিন্তু স্বর্গের সিঁড়ি এতো সোজা নয়। (‘পূর্বাশা,’ আষাঢ় ১৩৫৩) সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য বিষয়টা এখানেই সমাপ্ত করেছিলেন। আসলে বির্তক বাড়াতে চাননি। পরবর্তী সময়ে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কোন মতামত দিয়ে ‘পূর্বাশা’ পত্রিকা বরাবর প্রতিবাদ লিপি পাঠননি। তিনি জীবনাননন্দ দাশের এই উত্তর উপভোগ করেছেন কিনা তাও জানা যায়নি। তবে এই বিষয়টাকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ভুলে যাননি। কারণ তিনি এই সমালোচনার পরও তিনি মনে করতেন জীবনানন্দ দাশ একজন মহৎ কবি। পাশাপাশি তিনি এও মনে করেন তিনি সেই মন্তব্যে তার কোন ভুল ছিল না। এখানে পাঠকদের জানিয়ে রাখা ভালো হবে যে জীবনানন্দ দাশ ‘দৈনিক স্বরাজ’ পত্রিকায় বেশ কয়েকমাস সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছিলেন। সেই হিসাবে জীবনানন্দ দাশকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। আর সেই সময় জীবনানন্দ দাশের কিছু মানবিক দোষও চোখে পড়েছিল। জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি কেন্দ্রিক তার প্রথম লেখায় পাওয়া যাচ্ছে। রামেন্দ্র দেশমুখ্যের ঐ কাব্যগ্রন্থের সমালোচনায় ক্যানো অযাচিত ভাবে জীবনানন্দ দাশের নাম উল্লেখ করেছিলেন তারও ব্যাখ্যা দেননি। আর এটাও ধারণা করে নিতে পারি তিনি হয়তো ভেবেছিলেন জীবনানন্দ দাশ ব্যাপারটাকে এতটা গুরুত্ব দেবেন না। তবে পাঠক হিসাবে আমরা খুশি এই কারণে যে, এই অগ্রজ ও অনুজ কবির মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পেয়ে। শোনা যাক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সেই মতামত : মনে থাকবার আরও একটা কারণ অবশ্য ছিল। জীবনানন্দ কলকাতায় এসে পৌঁছবার কিছুকাল আগে ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৩) রামেন্দ্র দেশমুখ? একটি কবিতার বইয়ের সমালোচনা বার হয়। সেটি আমারই করা। প্রসঙ্গত সেখানে জীবনানন্দের কথা এসে যায় এবং একই সঙ্গে এসে যায়-তাঁর কবিতায় যা মাঝে-মাঝেই উঁকি মারে, সেই ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ কথাও। সেই ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ কথাটা জীবনানন্দের ভাল লাগেনি। প্রতিবাদ করে তিনি যে পত্র লেখেন, পূর্বাশা’র পরবর্তী সংখ্যাতেই সেটি ছাপা হয়। (এখানে বোধহয় একটা কথা বলে রাখা ভাল। ‘পূর্বাশা’য় ওই সমালোচনা যখন ছাপা হয়, আমার বয়স তখন মাত্রই একুশ বছর। তারপরে তো প্রায় পঞ্চাশ বছর কেটে গেল। ইতিমধ্যে জীবনানন্দ সম্পর্কে আমার ধারণা কিছুমাত্র পালটায়নি। তখনও তাঁকে রবীন্দ্রপরবর্তী কালের প্রধান কবি বলে জানতুম, এখনও তাই জানি। কিন্তু ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ কথাটা যে ভুল লিখেছিলুম, এমন আমার আজও মনে হয় না। পরন্তু ওই ক্লান্তিকে এই মহৎ কবির রচনার এক অমোঘ ও অনিবার্য চরিত্রলক্ষণ বলেই আমার মনে হয়।) (ধূসর পা-ুলিপি, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, জীবনানন্দ স্মৃতি, উজ্জ্বল কুমার দাস সম্পাদিত, সাহিত্যম্, ২০০০, কলকাতা, ভারত।) তবে প্রখ্যাত জীবনানন্দ দাশ বিশ্লেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ এই প্রতিক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করেছেন তার অনবদ্য গদ্যে। শোনা যাক : হ্যাঁ, জীবনানন্দও স্বর্গের সিঁড়ি খুঁজে পেয়েছিলেন, কিন্তু অনেকত ঘুরে। জীবনানন্দের উপান্ত কবিতাবলি প্রসঙ্গত স্মরণীয়, যা গীতিকবিতার মতোই নির্ভার ও স্বচ্ছ। উদ্যমের ব্যথা, মননের জটিলতা, আশা-নিরাশার দোলাচল এইসব ক’মে যাবার সঙ্গেÑসঙ্গে তাঁর কবিতার দীর্ঘ জটিল শব্দ-বাক্য-পঙক্তির গঠন ও কারুকুশলতা ঝ’রে যায়, ভাষা হ’য়ে ওঠে অন্তর্গত বাণীর মতোই স্বচ্ছ। ‘তরু’, ‘আলো’, ‘জল’-এর প্রতীক ঘুরে-ফিরে আসে বারবার, জীবনের ক্ষণিকত্ব জীবনের অনন্ত অস্তিতে শান্তি পেতে চায়। আর নারী বা প্রেমও হ’য়ে ওঠে এক প্রতীকের মতো, জীবনের আনন্দ ও কল্যাণের এক সুদর্শন সুচেতন প্রতিমার মতো। অনেক খানাখন্দ পেরিয়ে, বনÑজঙ্গল উত্তীর্ণ হ’য়ে জীবনানন্দ বিশাল খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়ান, সময়ের সমুুদ্রকে বারবার মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে যেতে ব’লে। (আবদুুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত কবিতা সমগ্র, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা, ২০০৫, পৃ. ৭৬২) তবুও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা জীবনানন্দ দাশের ভালো লাগতো সাক্ষ্য দিয়েছেন কবিপত্নী লাবণ্য দাশ। জীবনানন্দ দাশ এই ঘটনার আট বছর পরেই ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যান। জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে তিনি আজীবন সম্মানের মণিকোঠায় রেখেছিলেন। তার উজ্জ্বল উদাহরণ ছড়িয়ে আছে ‘কবিতার কী এবং কেন’ প্রবন্ধগ্রন্থে। (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বিদ্যাসাগর-বক্তৃতামালা (১৯৭৫) নিয়ে এই সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছে।) এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের কবিতার পরেই জীবনানন্দ দাশের কবিতার উদাহরণ তিনি বারবার টেনেছেন। সেই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এখন বেশ অসুস্থ। আমরা তার দ্রুত সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
×