ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যখন সব চোখ ছিল বাংলাদেশে

প্রকাশিত: ১২:২৮, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

যখন সব চোখ ছিল বাংলাদেশে

শুরুটা শেষের থেকেই বলি। শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। শাহ্বাগ থেকে একটু ভেতরে বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে চলছে অমর একুশে বইমেলা। এর কিছুদূর এগিয়ে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা। সময় উত্তরে যাওয়ায় বাণিজ্যমেলার ক্রান্তিপর্ব চলছিল। যে কারণে, মেলা ছিল লোকারণ্য। এরও কিছুদুর এগিয়ে মিরপুর দশ নম্বর। শেরে-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম। সকাল থেকেই অজস্র মানুষ মিরপুর দশ নম্বর এলাকায় জড়ো হতে থাকে। সবারই মাঠে বসে খেলা দেখার টিকেট চাই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়তে থাকে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে, দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে বহু মানুষ টিকেটের আশা ছেড়েছে। সঙ্গত কারও কারও মনে ক্ষোভ ও বিদ্রোহের উল্কি ঝরেছে। সে খবরও আমরা পেয়েছি। এই দিন রাজধানী শহর ঢাকাসহ সারাদেশে অন্যতম আলোচনা ছিল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের ষষ্ঠ আসরের ফাইনাল খেলা। প্রতিপক্ষ টুর্নামেন্টের দুই শক্তিশালী দল। ঢাকা ডায়নামাইটস বনাম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের মধ্যকার খেলা। কে জিতবে সাকিব না তামিম। কার দল কতটা শক্তিশালী। কোন্ কোন্ বিদেশী চৌকস খেলোয়াড় আছে ফাইনালের দুই দলে। টর্চ জিতে কি করা উচিত। কে কার হয়ে বাজি ধরবেন। ক্রিকেট নিয়ে এমন শত বিষয় ছিল গত শুক্রবারের টক অব দ্য কান্ট্রি। খেলা শুরু হয় সন্ধ্যে সাতটায়। নির্ধারিত সময়ের আগেই অনেকে টিভি সেটের সামনে ছুটির দিনের ফুরফুরে মেজাজে অপেক্ষমাণ। কখন আসবে ফাইনালের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যদিও কেউ কেউ রিমোটের বাটন চেপে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করেছেন। কিন্তু, সাতটা বাজার আগেই সন্ধ্যার খবরকে ইস্তফা জানিয়ে খেলা দেখানোর চ্যানেলটি ধরেছেন। শুরুতেই টর্চ পর্ব। মধ্য মাঠে পিচের ওপর ফাইনালের দুই ক্যাপ্টেন সাকিল আল হাসান এবং ইমরুল কায়েসের ‘হেটস-টেল’র পর্ব শেষ। ঢাকার ক্যাপ্টেন টর্চ জিতে বল করার সিদ্ধান্ত জানায়। সঙ্গত কুমিল্লার দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও এভিন লুইস ইনিংস উদ্বোধনীতে আসে। শুরুতে ঢাকা ডায়নামাইটসের বোলাররা তাদের শাসন করেছে। এক পর্যায় শাসনে টিকতে না পেরে হাইভোল্টেজের কাছে হেরে যান ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যান লুইস। সাকিব তখনও নিজের সিদ্ধান্তে মিষ্টি হেসে বোলারদের আরও চড়া হতে বলেন! দ্বিতীয় উইকেটে তামিমের সঙ্গে যোগ দেন দলের উইকেট কিপার ও টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান এনামুল হক বিজয়। এদিকে ঢাকার ব্যাটিং শিবিরে মনোযোগ রেখে কুমিল্লার রান তোলার গতি বোধকরি সে সময়ে তাদের সমর্থকদের খুব একটা আশ্বস্ত করতে পারেনি। যখন ঢাকার দুই স্টাইক বোলার তাদের দুই দুই চার ওভার শেষ করে, তখন কুমিল্লার সংগ্রহ ১ উইকেটে ১৭ রান। ৫ ওভারে ২৫ রান। এমনি করে দশ ওভার শেষ হয় ৭৩ রান সংগ্রহ করে। তামিমের আসল জাদুটা অপেক্ষা করছিল শেষ দশ ওভারে। তামিমের যুতসই ড্যাশিং ব্যাটিং পুরো ল-ভ- করে দেয় ঢাকা ডায়নামাইটসের বোলিং শিবির। একের পর এক ছয়। বিদ্যুত গতিতে মাঠ অতিক্রম করা বাউন্ডারি। গ্যালারি তখন কুমিল্লার সমর্থকদের লাল জার্সির আভায় দিশাহীন উল্লাসে মাতোয়ারা। তামিম খেলছেন- হাফ সেঞ্চুরি, সেঞ্চুরি... কে রোধে তারে! ভক্ত থেকে বোদ্ধা সবাইকে তিনি নতুন করে চিনিছেন- গেইল, ডিভিলির্য়াস কিংবা আন্দ্রে রাসেরা যা পারেন তামিমও তা পারেন। তার খেলায় মুগ্ধ দেশের সকল ক্রিকেট অনুরাগী। তামিম যখন বাউন্ডারি, ওভারবাউন্ডারি খেলতে আরও বেশি মরিয়াÑ সে সময় তাদের ইনিংসের নির্ধারিত ওভার শেষ। খেলার শেষ অবধি তার ব্যাট থেকে আগুনের ফুলকি ঝরেছে। গ্যালারি ভর্তি দর্শক, টেলিভিশনের দর্শক তার অগ্নিমূর্তি ব্যাটিংয়ের আগুনে মাঘের শীতে শরীর গরম করেছে। হয়ত আরও কিছুক্ষণ তার ব্যাটিং দেখের বিতৃষ্ণায় ভুগেছেন অগণিত অনুরাগী। তামিম থামেনি তাকে থামানো হয়েছে! যখন তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ ৬১ বলে ১৪১ আর দলের সংগ্রহ ১৯৯ রান। অন্যদিকে ঢাকার ডায়নামাইটসের ক্যাপ্টেন সাকিব আল হাসন স্মৃতি মন্থন করছিলেন গেল বারের ফাইনালের। পঞ্চম বিপিএলের ফাইনাল সাকিবের দল-ঢাকা খেলেছিল। সে বার প্রতিপক্ষ ছিল রংপুর রাইডার্স। ফাইনালে ক্যারিবিয়ান দানবীয় ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইলের ১৪৬ রানের দানবীয় ইনিংস ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। অতীত সাকিবের জানা ছিল। হয়ত দলের অন্য সদস্যরা মনে রাখেনি! দ্বিতীয় ইনিংসে যখন ঢাকার ওপেনাররা ব্যাট করতে নামে তখন কুমিল্লার খেলোয়াড়রা বেশ উজ্জীবিত। হবেই বা না কেন? যা করার তামিম তো করেই দিয়েছে। এদিকে ইয়াং ওপেনার রনি তালুকদার এবং ক্যারিবিয়ান অল রাউন্ডার সুনীল নারিন প্রতিশোধের আগুন নেভাতে পিচে পৌঁচ্ছেছেন। ২০০ রান চেজ করা টি-টুয়েন্টিতে মুশকিল কিছু না। কিন্তু ম্যাচটা যে টুর্নামেন্টের ফাইনাল। যে কারণে মাঠের খেলোয়াড় থেকে গ্যালারির দর্শক-হাইভোল্টেজের কাছে জবুথবু। ইনিংস শুরু ঢাকা ডায়নামাইটসের। কোন বল না খেলেই সাইফুদ্দিনের ফিনিক্স পাখির মতো দুরন্ত এক থ্রোতে আউট হয়ে যান ড্যাশিং ওপেনার সুনীল নারিন। ঢাকার ডাক আউটে শুরুতেই মনভাঙ্গা বিষন্নতার ছায়া সঙ্গে সমর্থকদেরও। তরুণ রক্ত বলে কথা। রনি মরার আগে বাঁচতে চায়। প্রতিশোধের শেষ না দেখে এই তরুণ কেমন করে সাজঘরে ফরে! সঙ্গে তার লঙ্কান দেশের রাবণরূপী উপল থারাঙ্গা। দু’জনে সমানে ব্যাট চালিয়েছেন। জয়ের জন্য। ঢাকার ভক্তদের জন্য। দু’জনে মিলে করে ফেলে ৫২ বলে ১০২ রান। কুমিল্লার ক্যাপ্টেন এবং অন্য খেলোয়াড়দের কপালে তখন চিন্তার ভাঁজ। তামিম দাঁত দিয়ে আঙ্গুলের নক কেটে হয়ত মনে মনে ভাবেছে, তবে কি জয়ের জন্য রানটা কম হয়ে গেল! যাই হোক ‘আমরাই জিতব’। তামিম আত্মবিশ্বাসী। এমন সময় লঙ্কান বোলার থিসারা পেরেরা আসল- তারই সতীর্থ উপল থারাঙ্গার বিরুদ্ধে বল করতে। উপল তখন ২৭ বলে ৪৮ রানের ঝড়ো ইনিংসের মালিক। দলের রান রেট আরও বাড়াতে উপল ভুল শট খেল বসেন। অর্ধশত না করেই বিরোহী বিদায় নিতে হয় তাকে। থেকে যাওয়া রনির সঙ্গে ব্যাট করতে আসে ক্যাপ্টেন সাকিব আল হাসান। এসেই ক্যাপ্টেন বিচলিত এক শর্ট খেললেন আর তারই অপেক্ষায় ছিলেন ম্যাচের সুপার হিরো তামিম। অনেকটা দূর দৌড়ে ভাল ক্যাচ লুফে নেন। এরপর দ্রুত রনি, রাসেল এবং কাইরান পোলাডের বিদায়ে ম্যাচের ভাগ্য মোটামুটি নির্ধারিত হয়ে যায়। শেষে ১৮২ রানে থামে ঢাকার ইনিংস। কুমিল্লা জয় পায় ১৭ রানে। এত রানের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ উপভোগ করে। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৪০ ওভারে আসে ৩৮১ রান, যার আশি শতাংশ এসেছে দেশী ব্যাটসম্যানদের ব্যাট থেকে। ম্যাচ শেষে তামিম সংবাদ সম্মেলনে এক বিস্ময়কর তথ্য জানায়। নিজের আত্মবিশ্বাস এবং ম্যাচ জেতার মূলমন্ত্র পেয়েছিল ক্যাপ্টেন মাশরাফির কাছে থেকে। আর তা হলো ‘আমি বা আমরা জিতব।’ এই বাক্য মাথায় নিয়ে মাঠে নামে তামিম। ম্যাচের আগে মাশরাফি তামিমকে বলেছিল এমন বিশ্বাস নিজের মধ্যে ধারণ করতে। আসলেই কেবল খেলা নয় এমন আপ্তবাক্য যে কোন কাজের শুরুতে নিজের ভেতর ধারণ করা মানে ভেতরে ভেতরে অনেক এগিয়ে থাকা। এদিকে খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে তামিমকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কি ভাবে করলেন এমন অবিশ্বাস্য ব্যাটিং? উত্তরে তামিম বলেন, ‘আমি এখনও স্বপ্নের ঘোরে আছি। নিজেও জানি না কি ভাবে ব্যাট করলাম। পরে গিয়ে খেলার হাইলাইটস দেখে বলতে পারব কীভাবে কী হলো! অন্যদিকে টুর্নামেন্ট সেরা সাকিব বলেন; গেল ফাইনালে এক গেইলের সেঞ্চুরির কাছে হেরেছি। এবার তামিমের কাছে হারলাম। ভবিষ্যতে ফাইনালে কেউ সেঞ্চুরি করতে না পারে সে দিকে খেয়াল করব। যাই হোক তামিমের সুপার হিরোর ভূমিকা, সাকিবের চৌকস অধিনায়কত্বের সুবাদে দেশের মানুষ তথা ক্রিকেট অনুরাগীরা চমৎকার একটা ম্যাচ নিশঃসন্দেহে উপভোগ করেছে, ছুটির দিনে শীতল আবহাওয়ায় উষ্ণ আমেজে। বিপিএল ২০১৯ একে একে পাঁচটা সিজন শেষ করে সম্প্রতি শেষ হলো বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের ষষ্ঠ আসর। বিপিএলের বিগত সব আসর ছিল ক্রিকেট অনুরাগীদের কাছে বেশ কৌতূহলের। এবারের আসরও ছিল অনুরূপ। বিশেষ করে, যখন দল ঘোষিত হয়। তখন দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা অধীর আগ্রহে জানতে অপেক্ষা করে নিজের বা সমর্থিত দল কাকে কাকে নিয়ে গঠিত হয়েছে। বিদেশী খেলোয়াড় কে বা কারা আসছে। ভেন্যু কোথায় কোথায়। এমন অনেক বিষয় আমাদের ভীষণ ভাবে মনোযোগী করে তোলে। এ কথা নতুন করে বলার কিছুই নেই জাতি হিসেবে আমরা অনেক আগেই নিজেদের প্রমাণ করেছি রাজকীয় খেলা ক্রিকেট আমাদের ধ্যান-জ্ঞান এবং ভালবাসা। কাজেই আইপিএল, সিপিএল, বিগব্যাস, কিংবা ইংলিশ কাউন্ট্রির মতো বৈশ্বিক আদলে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ সে তো আমাদেরই আগ্রহ ও ভালবাসার ফসল। ৫ জানুয়ারি ২০১৯ শনিবার দুপুর বারোটায় শুরু হয় বিপিএলের ষষ্ঠ আসর। রংপুর রাইডার্স এবং চিটাগং ভাইকিংসের মধ্যকার উদ্বোধনী ম্যাচের মধ্য দিয়ে টুর্নামেন্টের পর্দা ওঠে। এরপর ডবল রাউন্ড-রবিন ও প্লে অফ এবং চূড়ান্ত পর্বসহ মোট ৪৬টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। বিপিএল চলকালীন গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। শরীর অসুস্থ ছিল। সন্ধ্যায় বাজারে আসতাম। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের বদৌলতে বাড়ি থেকে বাজারÑ সব জায়গায় টেলিভিশন, স্মার্ট ফোন সচরাচর। আমাদের বাজারের বেশিরভাগ দোকানে টেলিভিশন আছে। স্যাটেলাইট সংযোগ প্রায় সব টেলিভিশনে। ঢাকাই বাংলা সিনেমা নয়ত তামিল মারদাঙ্গার সিনেমা এখনকার নিত্যদিনের বিনোদনের রসদ। কিন্তু যখন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ চলছিল তখন খেলা চলাকালীন অন্য কিছু দেখতে দেখিনি। অন্য সময়ের তুলনায় এই সময় বাজারে লোক সমাগম ছিল বেশি। নিজেদের মধ্যে চ্যালেঞ্জ। কে কত রান করতে পারে। কার কোন দল। কখন কখন নগদ অর্থের বাজি- এভাবেই ক্রিকেট খেলা একটি মাস আমাদের উজ্জীবিত করে রেখেছিল গ্রামীণ জনপদ থেকে শহুরে ব্যস্ত এলাকা। ঢাকা, সিলেট এবং চট্টগ্রাম তিন ভেন্যুতে খেলা অনুষ্ঠিত হয়। যে কারণে, দেশের বেশিরভাগ অঞ্চল এই টুর্নামেন্টের সঙ্গে যুক্ত ছিল। টুর্নামেন্টের সেরা খেলা এবারের আসরে বেশিরভাগ খেলাই দর্শকদের আমুদিত করেছে। রান উৎসবের পাশাপাশি লো স্কোরিং ম্যাচেও দুরন্ত উত্তেজনা দেখা গিয়েছে। আলাদা করে উল্লেখ করলে একাধিক ম্যাচের কথাই বলতে হয়। আসরের ৩৯ তম ম্যাচ। আগে ব্যাট করে ১২৭ রান সংগ্রহ করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। সহজ লক্ষ্য ভেবে ঢাকার ব্যাটসম্যানরা নিশ্চিন্তে ব্যাট করছিল। কিন্তু খেলার শেষ প্রান্তে এসে ঢাকার জন্য জয় কঠিন হয়ে যায়। শেষ ওভার। উইকেটে আন্দ্রে রাসেল ও রুবেল হোসেন। বোলার সাইফউদ্দিন। ছয় বলে দরকার ১২ রান। প্রথম বলেই রুবেল আউট। শেষ বলে দরকার ৬ রান। স্ট্রাইকে আন্দ্রে রাসেল গ্যালারির দর্শক থেকে টিভি সেটের দর্শক নির্বাক দৃষ্টিতে অপেক্ষা করছে শেষ বলের। সাইফউদ্দিন বল করলেন। রাসেল স্বজোরে মারলেন কিন্তু, ছয় না চার! ঢাকা ডায়নামাইটস ১ রানে হেরে গেল। আপসোস ঢাকার খেলোয়াড়দের, সমর্থকদের। বিতৃষ্ণা জাগিয়ে রাখল উভয়ের মাঝে এবং আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো এই দুরন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচটি। চমক নম্বর দুই; নাম আলিস আল ইসলাম। বাংলাদেশ ক্রিকেটের নবীন পেসার। ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে নিজের প্রথম ম্যাচে চমকে দেন সবাইকে। ১৮ তম ওভারে এসে হ্যাটট্রিক করে নিজের নাম উজ্জ্বল করে এবং দলকে জেতান দুই রানে। চমক নম্বর তিন; শুরু থেকে ভাল খেলেও ফলাফল নিজেদের করতে পারেনি মাহমুদুল্লার দল খুলনা টাইটানস। টুর্নামেন্টের ২০তম ম্যাচ। খুলনা আগে ব্যাট করে ৭ উইকেটে ১৮১ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর করে। কুমিল্লা যখন ব্যাট করতে নামেÑ প্রথম থেকেই পেন্ডুলামের কাঁটার মতো ম্যাচ একবার এদিক দোলে তো আর একবার ওদিক দোলে। পুরো ম্যাচই ছিল দারুণ উত্তেজনার। শেষ ওভারে জয়ের জন্য কুমিল্লার দরকার ৬ বলে ৮ রান। এই রান করা মোটেও কঠিন কিছু নয়। কিন্তু প্রথম তিন বলে ব্যাটসম্যানরা তোলে দুই রান। বাকি তিন বলে দরকার ৬ রান। খেলার মোড় আরও একবার ঘুরে যায় একেবারে শেষ মুহূর্তে। পর পর দুই চার মেরে কুমিল্লাকে ম্যাচ জিতিয়ে দেয় তিসারা পেরেরা। চমক নম্বর চার; টুর্নামেন্টের ১১তম ম্যাচ। মিরপুর শের-ই-বাংলায় টস জিতে খুলনাকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানায় চিটাগং ভাইকিংসের দলনেতা মুশফিকুর রহিম। খুলনা ২০ ওভারে সাড়ে সাত রান রেটে ১৫০ রান করে। খুলনার নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের কাছে ভাইকিংসের রান ১৫০ এসে থামে। সঙ্গত কারণে খেলা গড়ায় সুপার ওভারে। সুপার ওভারে আগে ব্যাট করে খুলনার সংগ্রহ ১২ রান। জবাবে চিটাগং ¯œায়ুঠাসা মুহূর্তে এবং দুরু দুরু কাঁপনে জয় পেয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে সুপার ওভারের যে অপূর্ণতা ছিল তা সম্পন্ন হয়। চমক নম্বর পাঁচ; ২০১৩ সালে গ্রুপ পর্বের এক ম্যাচে ২১৭ রানের বিশাল সংগ্রহ করেছিল ঢাকা। যেটা ছিল গত ছয় বছর বিপিএলের সর্বোচ্চ সংগ্রহ। এবার অর্থাৎ ষষ্ঠ আসরে সেই রেকর্ড ভাঙে রংপুর। চিটাগং ভাইকিংসের বিরুদ্ধে আগে ব্যাট করতে নেমে রংপুর রাইডার্স তোলে ২৩৯ রান। তাও আবার ৪ উইকেটে। মুহুর্মুহু চার-ছয়ের বন্যায় এই দিন গ্যালারি এবং টিভির দর্শকরা ম্যাচটা ভীষণভাবে উপভোগ করে। এ ছাড়াও আরও বেশকিছু ম্যাচের কথা উল্লেখ করা যায়। যেগুলোও ছিল বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। আর যদি বিশেষ চমকের কথা উল্লেখ করি তবে তা হবে এবারের আসরের ফাইনাল খেলা। ক্রিকেট ও আমাদের জাতিসত্তা অপ্রিয় হলেও কথাটা যে ক্ষাণিক সত্য! আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম খুব একটা দেখা যায় না। বিদেশপ্রীতি তাদের মধ্যে বর্তমান। কিন্তু যখন থেকে বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলা মায়ের বীর ছেলেরা উজ্জ্বল আলো ছড়াতে শুরু করে। তখন থেকে বাংলাদেশ বা নিজের দেশ সম্পর্কে প্রজন্মে বুকের ভেতর একটু একটু করে দরদ বাড়াতে থাকে। ক্রিকেট খেলা তাদের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি উস্কে দিয়েছে তা কিন্তু বলা যায়। আসলে ভিনদেশী কোন দেশের সঙ্গে যখন আমাদের দেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তখন বোঝা যায় আমাদের দেশপ্রেম। বিশেষ করে যখন কোন বড় টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ জয়ী হয় তখন সারাদেশের মানুষদের অনুরাগ দেখে বোঝা যায় কেন আমরা বুকের রক্ত দিয়ে এই ভূখ- স্বাধীন করেছিলাম। দেশটা নিজেদের করে নিয়েছিলাম। কাজেই ক্রিকেট এখন আর আমাদের কাছে কেবল একটা খেলার নাম নয় বরং একটা সত্তার নাম। সাঙ্গ হলো ক্রিকেটের মিলনমেলা ক্রিস গেইল, এবিডি ভিলিয়ার্স, লুক রাইট, স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার, আন্দ্রে রাসেল, শাহিদ অফ্রিদি, ওহাব রিয়াজদের সঙ্গে আমাদের মাশরাফি বিন মর্তুজা, তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মেহেদী মিরাজ রুবেল হেসেন, তাসকিনদের চমৎকার বোঝাপড়ার ক্রিকেট খেলা বিশ্ব ক্রিকেটের সঙ্গে ঐক্যতান সৃষ্টির যে সুযোগ তা সত্যিইÑ আমাদের ভবিষ্যত ক্রিকেটের জন্য মঙ্গলকর। আপাত বিবেচনায় এমনটাই ইঙ্গিত ইতোমধ্যে আমরা পেয়েছি। বিশেষ করে যখন জাঁকজমক ভাবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ শুরু হয়। এরপর থেকে ইন্ডিয়ান জাতীয় ক্রিকেটের গতি পথ বদলে যায়। আজ ইন্ডিয়া বিশ্বসেরা দল। যার অবদানের পেছনে অনেক ক্রিকেট বোদ্ধাই তাদের পিমিয়ার লীগকে উল্লেখ করে থাকেন। প্রতি বছর যখন বিপিএলএর জন্য দল ঘোষণা হয়। তখন থেকেই আমাদের দেশের ক্রিকেটাররা আটঘাট বেঁধে নিজেদের প্রস্তুত করতে নেমে পড়ে। তরুণ ক্রিকেটাররা অপেক্ষা করে বিশ্ব ক্রিকেটের মিলনমেলার। এর ফলাফলও আমরা দেখেছি, কাজী অনিক, রনি তালুকদার, আলিস আল ইসলামদের দৃষ্টিনন্দন পারফর্মেন্স আমাদের মুগ্ধ করেছে একই সঙ্গে ভবিষ্যত ক্রিকেটের রাস্তাটাও তারা প্রশস্ত করেছে।
×