ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি ছাড়ার ধুয়া জামায়াতের অপকৌশল

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বিএনপি ছাড়ার ধুয়া জামায়াতের অপকৌশল

শরীফুল ইসলাম ॥ চরম রাজনৈতিক বেকায়দায় থাকা জামায়াত নানা কৌশলে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন হারানো দলটি নতুন করে নিবন্ধন পাওয়ার জন্য বিএনপি ছাড়ার ধুয়া তুলেছে। এরই অংশ হিসেবে নানা মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছে তারা বিএনপির সঙ্গত্যাগ করছে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন- কোন অবস্থাতেই বিএনপি ছাড়ছে না জামায়াত ! আবার বিএনপিও জামায়াতকে হারাতে চায় না। তাই প্রকাশ্যে বিএনপির সঙ্গে তেমন মেলামেশা না করলেও গোপনে ওই দলের সঙ্গে সার্বিক যোগাযোগ রক্ষা করেই চলছে জামায়াত। যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জামায়াতের কতিপয় সিনিয়র নেতার ফাঁসি কার্যকরের পর জামায়াতের তরুণ নেতারা এখন দলের শীর্ষ পর্যায়ে নেতৃত্ব দিতে চাচ্ছে। আগে সিনিয়র নেতাদের একগুঁয়েমির কারণে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করা সম্ভব না হলেও তরুণ নেতারা এখন চাচ্ছে ইসির যাবতীয় শর্তপূরণের জন্য যা যা দরকার তা দলের গঠনতন্ত্রে রেখে নতুন করে জামায়াতের নিবন্ধন নিতে। এজন্য তারা দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নতুন প্রজন্মের কাছে জামায়াত আর স্বাধীনতা বিরোধীদল হিসেবে পরিচিত থাকতে চায় না। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা নতুন ধারার রাজনীতি করতে চায়। তবে ধর্মীয় রীতিনীতিকে প্রাধান্য দিলেও তারা আর মৌলবাদী দল হিসেবে চিহ্নিত হতে চায় না। আর এ কারণেই তারা নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে দলের নিবন্ধন পেতে চায়। আর এ নিবন্ধন পেতে গিয়ে যাতে রাজনৈতিকভাবে কোন সমস্যায় পড়তে না হয় সে জন্যই বিএনপি ছাড়ার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করছে। পর্যবেক্ষকদের মতে জামায়াতের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া কোন উপায় নেই। তবে বাস্তবতার আলোকে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেই জামায়াত কিছু কৌশল গ্রহণ করেছে। এ কৌশলের একটি হচ্ছে বিএনপি ছেড়ে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার চালানো। তবে জামায়াতের এ কৌশল বর্তমান সরকারসহ দেশের সচেতন মানুষও বুঝে গেছে। তাই এ কৌশলে তারা সফল হতে পারবে না বলেই দেশের সচেতন মানুষ মনে করছে। অভিজ্ঞ মহল মনে করছে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপিকে ছেড়ে দেয়ার কথা শুনলে আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকার খুশি হবে এমন একটি চিন্তা থেকে জামায়াত তা করছে। কিন্তু বাস্তবে জামায়াত ও বিএনপি কেউ কাউকে ছাড়বে না। কারণ এ দু’টি দল পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হলে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাবে আওয়ামী লীগ। আর এ কারণেই এ দু’টি দল নিজেদের স্বার্থেই এক সঙ্গে থাকার চেষ্টা করবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির ওপর দেশ-বিদেশের নানা মহলের চাপ ছিল জামায়াত ছাড়ার। কিন্তু এত চাপের পরও বিএনপি জামায়াত ছাড়েনি। বরং আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে জামায়াতের ২৪ প্রার্থীকে বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ দেয় বিএনপি। এ কারণে জামায়াত বিএনপির প্রতি চরম খুশি হয় বলে জানা যায়। নির্বাচনের আগেই জামায়াতকে খুশি রাখতে বিকল্প ধারার সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ বি চৌধুরীকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করে বিএনপি। তা না হলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বি চৌধুরীকেও রাখতে হতে পারত বিএনপি। আর তাহলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমন ভরাডুবি হতো না বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মাঠের এবং ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত ছাড়া কার্যত অচল বিএনপি। আবার বিএনপি ছাড়া জামায়াতও অচল। তাই এ দু’টি দলের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঘাটছাড়া সম্পর্ক। জোটসঙ্গী জামায়াত ছাড়া বিএনপির কোন কর্মসূচীই সফল হয় না তা বিগত ১০ বছরে প্রমাণিত হয়েছে। আর এ জন্যই জামায়াতকে খুশি রাখতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক বি চৌধুরীকে বাদ দিয়ে গণফোরাম সভাপতি ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছে বিএনপি। আবার জামায়াতও বিএনপির সহযোগিতা নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় শরিক হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে বি চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোট হলে জামায়াত ছাড়া ২০ দলীয় জোটের অধিকাংশ শরিক দলই মেনে নেয়ার পক্ষে ছিল। তবে বি চৌধুরীর শর্ত অর্থাৎ জামায়াত বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করলে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত বেকে বসতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে বিএনপি বি চৌধুরীকে বাদ দিয়েই জোট করে। আর এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে ন্যাপ ও এনডিপি। বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মী ও দলীয় বুদ্ধিজীবীরা চেয়েছিলেন জামায়াতকে বাদ দিয়ে ড. কামাল হোসেন ও অধ্যাপক বি চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠন করতে। কিন্তু বিএনপির শীর্ষ নেতারা কিছুতেই জামায়াত ছাড়ার পক্ষে ছিলেন না। তাই এমন একটি বড় জোট গঠন করতে জামায়াত প্রশ্নে প্রথমেই হোচট খায় বিএনপি। তবে জামায়াত রেখে বৃহত্তর জোট গঠনের বিষয়ে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মতামত নেন দলের সিনিয়র নেতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, মাঠের রাজনীতি ও ভোটের রাজনীতির কথা চিন্তা করে দলীয় হাইকমান্ড জামায়াত ছাড়তে চাননা। আর জামায়াতও কোন অবস্থাতেই বিএনপি থেকে দূরে সরে যেতে চায় না। বিএনপি রাজপথে যে কোন কর্মসূচী দিলে জামায়াতের নেতাকর্মীরা স্বতস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় এবং কর্মসূচী শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঠ ছাড়েন না। এছাড়া সারাদেশের প্রতিটি সংসদীয় আসনে জামায়াতের ভোট ব্যাংক রয়েছে। বাস্তবতার কারণেই এসব কিছু বিবেচনায় না রাখতে হয়েছে। আর বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় বিএনপিও রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পায়। জামায়াতের ওপর আক্রমণ এলে বিএনপি তাদের সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে। এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় জামায়াতের নিবন্ধন না থাকায় তারা কিভাবে নির্বাচন করবে তা নিয়ে দলটির চিন্তামগ্ন ছিল। বিএনপি হাইকমান্ড জামায়াত নেতাদের ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ করে দিয়েছে। এতে জামায়াত বিএনপির প্রতি খুশি হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পর থেকেই চরম বেকায়দায় পড়ে বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াত। তারা এখন প্রকাশ্যে দলীয় কর্মকা- পরিচালনা করতে পারছে না। তবে গোপনে সারাদেশের সকল পর্যায়ে নিয়মিত বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করছে দলটি। ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জামায়াতের সঙ্গে মিলে ৪ দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। এ জোটের অধীনে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে গিয়ে জামায়াতকেও ২টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেয় বিএনপি। এর ফলে তৎকালীন জামায়াতের আমির রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগানোর সুযোগ পান। আর বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কথা বলে কিভাবে ২ জন চিহ্নিত রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীকে মন্ত্রী বানায় এ নিয়ে চরম সমালোচনার মুখে পড়ে দলটি। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতের ওই ২ শীর্ষ নেতাসহ বেশ ক’জনের ফাঁসি হওয়ায় বিএনপি ও জামায়াত দেশে-বিদেশে চরম সমালোচনার শিকার হন। তারপরও এ দু’টি দল নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক দিন দিন আরও জোরদার করে।
×