ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার উড়াল সড়কের নিচেই- ॥ পরিচ্ছন্ন রাখুন

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ঢাকার উড়াল সড়কের নিচেই- ॥ পরিচ্ছন্ন রাখুন

রাজন ভট্টাচার্য ॥ উড়াল সড়কের নিচের অংশ থাকবে সংরক্ষিত। মাঠের আদলে থাকবে সবুজ ঘাস। ফুলবাগান। রকমারি গাছাপালা। এক কথায় বললে একদম পরিপাটি প্রাকৃতিক পরিবেশ। যা প্রথম দর্শনেই যে কাউকে মুগ্ধ করার কথা। বিশ্বের যে কোন দেশের উড়াল সড়কের নিচের অংশ সাধারণত এ রকমই হয়ে থাকে। এতে একটি দেশের প্রতি পর্যটকসহ সাধারণ মানুষের ধারণা একেবারেই পাল্টে যায়। যা অন্য দেশের সঙ্গে তুলনামূলক বিবেচনায় উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, রাজধানীর বুকে যত উড়াল সড়ক নির্মাণ হয়েছে এর একটিরও কোন পরিচর্যা নেই। যেমন ফ্লাইওভারের নিচের অংশের সৌন্দর্যবৃদ্ধির কোন উদ্যোগ নেই, তেমনি ওপরের অংশও বেহাল অথচ সংশ্লিষ্ট সরকারী দফতরের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল ব্যক্তি থাকলেও এ নিয়ে কারও কোন মাথাব্যথা নেই। নগরীর আটটি উড়াল সড়ক ও ওভারপাসের প্রতিটির চিত্র প্রায় একই। প্রকৃতির হাতছানি না থাকলেও দূষণে কেন্দ্র হয়েছে উড়াল সড়কের নিচের অংশ। ওপর অংশে বালু আর আবর্জনার স্তূপ জমেছে। রক্ষণাবেক্ষণে নেই প্রয়োজনীয় তদারকি। নগরীর ব্যস্ততম এলাকা খিলগাঁও রেলগেট। চার রাস্তা মোড় থেকে সোজা মালিবাগ রেলগেটমুখী এলে হাতের ডানপাশের দৃশ্য দেখলে চোখ আটকে যাবে। দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এই স্থানটির হলো উড়াল সড়কের নিচের অরক্ষিত অংশ। মল, মূত্রত্যাগের স্থান। দেখলে মনে হবে এটি একটি উন্মুক্ত পাবলিক টয়লেট। এর মধ্যে থাকে কয়েকজন ভাসমান মানুষও। যেখানে তাদের রাতদিন খাবার খেতেও দেখা যায়। এখানে মাদকসেবীদের আড্ডাও বসে জমজমাট। আশপাশের ময়লা-আবর্জনা ফেলে উঁচু করা হয়েছে পুরো অংশটি। এর পাশের অংশে রাখা হয় ব্যবসায়ীদের কাঠের ফার্নিচার। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী জানালেন, উড়াল সড়কের নিচের অংশে মল, মূত্রের গন্ধে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত কষ্টসাধ্য। বর্জ্যরে দুর্গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে যায় পুরো এলাকায় অথচ দিনের পর দিন এই অবস্থা চলমান। সিটি কর্পোরেশন থেকে কারও কোন নজরদারি নেই। খিলগাঁও থেকে বাসাবো অংশের চিত্র একই রকমের। প্রতিটি পিলারের দু’পাশের খালি অংশে থাকে ভাসমান মানুষ। শাজাহানপুর অংশে আছে ভাসমান ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। ছাগল, মুরগি রাখা হচ্ছে উড়াল সড়কের নিচে। খিলগাঁও উড়াল সেতু ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যস্ত একটি উড়াল সেতু। এটি একদিকে রাজারবাগকে সংযুক্ত করেছে, অন্যদিকে মালিবাগকে এবং তৃতীয় দিকে সায়েদাবাদকে। ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ উড়াল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০১ সালে এবং সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় ২০০৫ সালের মার্চ মাসে। ১৪ মিটার চওড়া খিলগাঁও উড়াল সেতু নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ৮১ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা। এটি নির্মাণের ফলে খিলগাঁও রেল ক্রসিংয়ের যানজট কমেছে। ঘোড়ার আস্তাবল! ॥ মেয়র হানিফ উড়াল সড়কের চানখাঁরপুল অংশের চিত্র দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। উড়াল সড়কের নিচের অংশ যেন ঘোড়া রাখার আস্তাবল। দেখলে বোঝার কোন উপায় নেই এটি পুরোপুরি অবৈধ। দিব্যি পশু পালন করা হচ্ছে এখানে। রাতদিন পশুর মলমূত্র পড়ছে মূল রাস্তায়। ফ্লাইওভারের নিচের কিছু অংশ নেট দিয়ে ঘিরে রাখা হলেও বাকি অংশ খোলা। খোলা অংশে চলছে পশু পালন কাজ। অন্তত ২০টি ঘোড়া দেখা গেছে এই এলাকায়। ঘোড়া ব্যবসায়ী মালেক জানালেন, আমাদের কখনই এখানে ঘোড়া পালনে নিষেধ করা হয় না। কেউ যদি কখনও নিষেধ করত তাহলে আমরা ঘোড়া সরিয়ে নিতাম। তাছাড়া সিটি কর্পোরেশনের জমিতে ঘোড়া পালন করা নিষেধ তাও তিনি জানেন না বলে জানান। এই উড়াল সড়কের টিকাটুলি ও গুলিস্তান অংশের চিত্রও সন্তোষজনক নয়। কোথাও সৌন্দর্যবর্ধনে কোন রকম ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উড়াল সড়কের নিচের অংশের ধুলোবালি গোটা পরিবেশকে নষ্ট করছে। যেখানে ইচ্ছা করলেই ফুলবাগান আর ঘাস লাগানো সম্ভব। যাত্রাবাড়ী অংশের দু’পাশে নেট দিয়ে ঘিরে রাখা হলেও সৌন্দর্যবর্ধনে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পানি ছিটিয়ে ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণেরও কোন ব্যবস্থা নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিউটিফিকেশন কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা শুরু থেকেই চেষ্টা করি উড়াল সড়কের নিচের অংশগুলো সৌন্দর্য ধরে রাখতে। কিন্তু দেখা যায়, উচ্ছেদের পর আবারও পরিবেশ নষ্ট হয়। খাঁচা দিয়ে বেড়ার মাধ্যমে এই স্থানগুলো সংরক্ষণ করে প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন তারা। মহাখালী উড়াল সেতু ॥ সর্বপ্রথম খিলগাঁও উড়াল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হলেও মহাখালী উড়াল সেতুর নির্মাণ কাজ আগে শেষ হয় এবং খিলগাঁও উড়াল সেতুর আগেই উদ্বোধন হয়। যে কারণে মহাখালী উড়াল সেতুকেই দেশের প্রথম উড়াল সেতু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যায়। মহাখালী উড়ালপথের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০১ সালের ডিসেম্বরে এবং যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় ২০০৪ সালের নবেম্বরে। ১৯টি শক্তিশালী স্তম্ভের সাহায্যে নির্মিত এ উড়াল সেতুর দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ১২ কিলোমিটার। যানবাহন চলাচলের জন্য উভয়পাশে ৭ দশমিক ৫ মিটার চওড়া রাস্তা এবং শূন্য দশমিক ৬ মিটার ফুটপাথ রয়েছে। প্রায় ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে উড়াল সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে প্রায় তিন বছর। কিন্তু মহাখালী উড়াল সড়কটি নির্মাণের পর মহাখালী রেলগেট, বনানী ও কাঁচাবাজার অংশে কিছুটা সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নেয়া হলেও এখন সবকিছুই ভেস্তে গেছে। উড়াল সড়কের নিচে এখন কাঁচা মাটি। সেখানে ভাসমান মানুষের বসবাস। বিজয় সরণি উড়াল সেতু ॥ রাজধানীর বিজয় সরণিতে বহুল আলোচিত র‌্যাংগস ভবন ভাঙ্গার কাজ শুরুর মাধ্যমে ২০০৭ সালে বিজয় সরণি তেজগাঁও সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ সড়কের শূন্য দশমিক ৭ কিলোমিটার অংশে রয়েছে উড়াল সেতু। তেজগাঁও রেলক্রসিং থেকে যানবাহনকে মুক্ত করতে এবং ঢাকার পূর্ব দিকের সঙ্গে কেন্দ্রের যোগাযোগ স্থাপন করতে এই উড়াল সেতু বানানো হয়েছে। সড়কটি নির্মাণে সর্বমোট ব্যয় হয়েছে ১১৪ কোটি টাকা। ২০১০ সালের এপ্রিলে এটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। উড়াল সেতুটি বিজয় সরণির সঙ্গে গুলশান, তিব্বত এবং সাত রাস্তাকে সংযুক্ত করেছে। কিন্তু সড়কের নিচের অংশের অবস্থা একেবারেই খারাপ। পুরো অংশে ভাসমান মানুষ আর বাজার। একের পর দোকান ঘর তৈরি করা হয়েছে সেতুটির নিচের অংশে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ইচ্ছা করলেই এই এলাকার সৌন্দর্যবর্ধনে উড়াল সড়কের মাটি কাজে লাগানো যেত। কিছু অংশে গাড়ি পার্কিং করা হয় আর কিছু অংশে ভাসমান মানুষের আবাসন। সবুজের ছোঁয়া নেই...॥ মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়কের সাতরাস্তা অংশে শুরুর দিকে সবুজ ঘাস দেখা গেলেও এখন আর তা নেই। শুধুমাত্র পরিচর্যা আর রক্ষাণাবেক্ষণের অভাবে ঘাস মরে মাটিতে মিশে গেছে। মগবাজার অংশে বুক খুলে পড়ে আছে মাটি। কোন রকম গাছাপালা লাগানো হয়নি। ইস্কাটন অংশে উড়াল সড়কের নিচে রীতিমতো জমজমাট বাজার। কয়েক দফা বাজার উচ্ছেদ করা হলেও আবারও ব্যবসায়ীরা বাজার বসিয়েছে। হলি ফ্যামেলি হাসপাতাল অংশে কিছু সবুজায়ন করার চেষ্টা হলেও এখন তা থেমে গেছে। সবুজ গাছগুলো ভাসমান মানুষের আবাসনের অত্যাচারে মৃত্যুর দিন গুনছে। ছোট্ট একটি জলাধার নির্মাণের চেষ্টা হলেও তা এখন শুকিয়ে মরুভূমিতে রূপ নিয়েছে। মৌচাক অংশে গাড়ি পার্কিং করে রাখা আছে। রয়েছে ভাসমান মানুষের আবাসন, চা স্টল ও পুরনো ইলেক্ট্রনিক পণ্যের দোকান। মালিবাগ মোড় অংশে রয়েছে লেগুনাস্ট্যান্ড, গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। আবুল হোটেল অংশে সবুজের কোন সমারোহ নেই। নেই প্রকৃতির কোন ছোঁয়া। মজার বিষয় হলো, এই উড়াল সড়কের ওপরের বেশিরভাগ অংশের বিদ্যুতের তার চুরি হয়ে গেছে প্রায় এক বছর হলো। রাতে সড়কের বেশিরভাগ অংশে বাতি জ্বলে না। নষ্ট হয়েছে ইলেক্ট্রনিক সিগন্যালগুলোও। তাই সিগনাল থেকে তুলে নেয়া হয়েছে ট্রাফিক। যে কোন সময় দুটি সিগন্যাল পয়েন্টে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এর বাইরে উড়াল সড়কের ওপরের অংশের দু’পাশে বালুর স্তূপ, এর মধ্যে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের বালাই নেই। কুড়িল উড়াল সেতু ॥ চারটি লুপের সমন্বয়ে তৈরি কুড়িল উড়াল সেতু ঢাকার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন একটি সড়ক। বিশেষ করে রাতের ঝলমলে আলোতে কুড়িল উড়াল সেতুর সৌন্দর্য বাড়ার কথা। ওপরে নিচের সৌন্দর্য মিলিয়ে উড়াল সড়কটি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছে না। ৩ দশমিক ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে কুড়িল উড়াল সেতুর চারটি লুপ দিয়েই ওঠানামা করা যায়। এই লুপগুলো হলো বনানী, কুড়িল, খিলক্ষেত ও পূর্বাচল প্রান্তে। প্রথমে এর নির্মাণ ব্যয় ২৫৪ কোটি টাকা ধরা হলেও নির্মাণকাজ শেষে ব্যয় বেড়ে ৩০৩ কোটি টাকায় গিয়ে থামে। এর সম্পূর্ণ অর্থায়ন করা হয় রাজউকের নিজস্ব তহবিল থেকে। ৬৭টি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এ উড়ালসেতুর উচ্চতা ৪৭ দশমিক ৫৭ ফুট এবং প্রস্থ ৩০ দশমিক ১৮ ফুট। ২০১০ সালের মে মাসে শুরু এই উড়াল সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১৩ সালের আগস্টে। সরকারীভাবে এটি কুড়িল বহুমুখী উড়াল সেতু নামে পরিচিত। এই সেতুর দু’পাশের মূল সড়ক সরু হওয়ায় নিচের রাস্তা খুব একটা নেই। তবুও যতটুকু আছে তাতে সবুজায়ন সম্ভব। বিশেষ করে বিশ্বরোড পয়েন্ট লাল মাটি খাঁ খাঁ করছে। যেখানে ভাসমান মানুষের বসবাস আর ট্রাকসহ বিভিন্ন প্রকারের যানবাহন রাখা হয়। সড়কটির ওপরের অংশের দু’পাশে প্রায় হাঁটু সমান বালু আর ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনাটি দেখভালের কেউ নেই বলেই মনে হতে পারে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই এলাকার ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উড়াল সড়কে অনেক সময় মল-মূত্র দেখা যায়। দুর্ঘটনায় জীবজন্তু মারা গেলেও তা ফেলার কেউ থাকে না। দুর্গন্ধে পরিবেশ নষ্ট হয়। ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে জিল্লুর রহমান উড়াল সেতুর মাধ্যমে। আগে মিরপুর থেকে এয়ারপোর্ট যাতায়াত করতে গেলে বিজয় সরণি ঘুরে মহাখালী হয়ে তারপর এয়ারপোর্ট যেতে হতো। মিরপুর থেকে এয়ারপোর্টগামী একজন যাত্রীর ন্যূনতম দু-তিন ঘণ্টা সময় লেগেই যেত। এই উড়াল সেতু দিয়ে একই দূরত্ব যেতে সময় লাগছে মাত্র ২০-২৫ মিনিট। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এই উড়াল সেতুটির কাজ শুরু হয়। নির্ধারিত সময়ের প্রায় তিন মাস আগেই ২০১৩ সালের মার্চে এর নির্মাণকাজ শেষ হয় এবং এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। উড়াল সেতুর দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৭৯৩ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৫ দশমিক ৫২ মিটার। উড়াল সেতুটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তথা সবুজায়নের অবস্থা এখানেও প্রায় একই ধরনের। তবুও তুলনামূলকভাবে এই উড়াল সড়কটি অনেক পরিচ্ছন্ন।
×