ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জহুরুল আলম

‘জয় বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, বীর বাঙালীর স্লোগান

প্রকাশিত: ০৯:৪৪, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

‘জয় বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, বীর বাঙালীর স্লোগান

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বা তারও অনেক আগে থেকেই পাকিস্তানী বংঢ়রড়হধমব বা গুপ্তচরচক্র বাঙালীর সকল সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ছিল এবং ঘটনা পরম্পরায় এরা সেখানে আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়, যার নেতিবাচক প্রভাব মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকে শুরু করে পরবর্তী আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যমান থেকে দেশকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা আমাদের জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলন, সংগ্রাম, যুদ্ধসহ প্রায় সব গর্বের অর্জনগুলো সম্পর্কে পড়েছিলাম প্রায় অজ্ঞতার অমানিশায়, আর আমাদের চোখের সামনে আমরা বেড়ে উঠতে দেখেছি একটি প্রায় অজ্ঞ প্রজন্ম, যে প্রজন্ম এখন মধ্য বয়সের দ্বারপ্রান্ত থেকে প্রায় শেষ পর্যায়ে উপনীত। এরা না জানে দেশের প্রকৃত ইতিহাস, না জানে জয় বাংলার বিজয়গাথা। এরা জানে ড্রামতত্ত্ব ও হঠাৎ করে যুদ্ধ শুরুর হওয়ার কল্পকাহিনী। জয় বাংলা কেবলমাত্র একটি স্লোগান নয়, এটি একটি আদর্শের নাম। স্লোগান সাময়িক। পরিস্থিতি অনুযায়ী ও মানুষের চাহিদা অনুযায়ী তা প্রস্তুত হয়। কিন্তু আদর্শ চিরঞ্জীব। জয় বাংলা শব্দটি যখন নজরুল ব্যবহার করেন তিনিও ভাবেননি, একদিন এই শব্দটি এক মহামানবের মাধ্যমে এক মহান জাতিকে কেমন করে নুতন জীবনের পথ দেখাবে, কেমন করে এটি একটি জাতির মুক্তির মন্ত্রে রূপান্তরিত হবে, কেমন করে, কত গভীরভাবে এই শব্দ মৃত্যুকে জয় করার মন্ত্রে পরিণত হবে। জয়বাংলা বাঙালীর স্লোগান, একটি জাতির স্লোগান। যারা বিভেদ, মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে, যারা বাংলাকে ঘৃণা করে বিজাতীয় রাজনীতি, ভাষা ও কৃষ্টিকে বাংলার মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়, যারা মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রকে অস্বীকার করে তাদের গাত্রদাহ হয় এই স্লোগান শুনলে, ঠিক যেমনটি হতো পাকিস্তানীদের। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সকল মুক্তিযোদ্ধাকে বন্দী করা হতো, তাদের ওপর আমৃত্যু পাশবিক অত্যাচার চালানো হতো শুধু জিন্দাবাদ বলানোর প্রচেষ্টায়। কিন্তু হাজারো মুক্তিযোদ্ধা জয় বাংলা স্লোগানে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করত, ঘৃণা ভরে বিজাতীয় স্লোগানকে প্রত্যাখ্যান করে, সে কি কেবলমাত্র একটি স্লোগানকে উচ্চারণ করার জন্য না আরও বেশি কিছু, যার জন্য তারা জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল। ‘জয় বাংলা’ ছিল এমনই এক উজ্জীবনী নিনাদ, যা শত্রুর বন্দুকের নলকেও অবজ্ঞা করেছে হেলাভরে। জয় বাংলার মাহাত্ম্য এখানেই যে এটি বাংলার রাজনীতিতে আসন গেড়েছে এমন একটি সময়ে যখন জাতি স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। সকল পথ পরিক্রমা শেষে আসন্ন যুদ্ধের স্লোগান হিসেবে, বাঙালীর অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এই স্লোগান। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে মাধ্যমে মুক্ত হন বাংলার স্বাধীনতা সনদ ৬ দফা নিয়ে সামনে এগিয়ে চলা মুজিব ভাই। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ছাত্র-জনতা পাকিস্তানীদের বাধ্য করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে। এ উপলক্ষে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২২ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্সে আয়োজন করে ছাত্র-জনতার বিশাল গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠান, যেখানে বাংলার জনতা তাদের মহান নেতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে। এই গণসংবর্ধনার আয়োজকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা ও ডাকসুর ভিপি, ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা তোফায়েল আহমেদ, ছাত্র ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দ। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে উপস্থিত লাখো জনতার কণ্ঠে বার বার ধ্বনিত হতে থাকে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলার আকাশে বাতাসে যেন ছড়িয়ে দিল সেদিনের এই আয়োজন, এই বার্তা যে জনগণের নেতা আবির্ভূত তাঁর সমস্ত শক্তি, বুদ্ধি, সাহস ও প্রজ্ঞা নিয়ে জনগণকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে চিরতরে মুক্তি দেয়ার জন্য। তাই জয়বাংলা-মুজিব-মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতা সেই মুহূর্ত থেকে হয়ে গেল সমার্থক, একে অপরের পরিপূরক। পরবর্তী ইতিহাস যুদ্ধের ইতিহাস। কিন্তু বীর বাঙালী তখন থেকেই নিজের করে নিয়েছে আসন্ন যুদ্ধের মন্ত্র : ‘জয় বাংলা’, যুদ্ধের নেতা : বঙ্গবন্ধু, যুদ্ধের ফসল : স্বাধীনতা ভিন্ন আর কিছু নয়। জয় বাংলা এসেছে বাংলার মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় বিজাতীয় জিন্দাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে। ঠিক তেমনিভাবে যেমন করে বাংলার স্বাধীনতা এসেছে অবৈজ্ঞানিক-উদ্ভট দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অঙ্গীভূত থেকে সকল অবিচার, অত্যাচার, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি লাভের প্রবল বাসনা থেকে। তাই জয় বাংলা যখন আমাদের সকল বাঙালীর- এ দেশের সব মানুষের প্রাণের কথা বলে, গর্বের ও সাফল্যের গান গায়, জিন্দাবাদ ধ্বনি তখন টেনে নিয়ে আসে পুঁতিগন্ধময় পাকিস্তানী প্রেতাত্মাদের উল্লাস, বাঙালীর অপমান অর হতাশার গ্লানি, আর শোষণ ও বঞ্চনার অতীতকে। আর তাই এ দেশে জয় বাংলা ও জিন্দাবাদ একসঙ্গে চলতে পারে না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর জিয়াউর রহমান-মোশতাক গং পুনর্প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় ব্যাপৃত হয় এই বাংলায় ধিকৃত ও প্রত্যাখ্যাত জিন্দাবাদের রাজনীতি। এদের এই ষড়যন্ত্রে এরা সঙ্গে পায় অন্ধকার গহ্বর থেকে একে একে বেরিয়ে আসা স্বাধীনতাবিরোধী, গণহত্যাকারী রাজাকার, আলবদর আলশামস, জামায়াত ও উগ্র বামপন্থী শক্তিগুলোকে। এই তথাকথিত উগ্র বামেরা তখনও স্বাধীন বাংলাদেশের পরিবর্তে নিজেদের পূর্ব পাকিস্তানের তথা পাকিস্তানের দল হিসেবে জাহির করত। এরা রাজাকারদের ও গণহত্যাকারীদের সঙ্গে মিলে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কেবল নয়, তার আগে ও পরে প্রকাশ্যে ও গোপনে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে গেছে অবিরত। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিভ্রান্ত বাম শক্তি, যারা মার্কসবাদের প্রথমিক ধারণাগুলো সম্পর্কেও ছিল অনবগত। এদের কাঁধে সওয়ার হয়ে পাকিস্তানী দালালের দল নির্বাসিত করে বাঙালীর রণনিনাদ : ‘জয় বাংলা’; রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে বিজাতীয় ‘জিন্দাবাদ’। দেশের সংবিধানকে ছিন্নভিন্ন করে একে একটি পাকিস্তানী দলিলে পরিবর্তিত করা হয়, এমন কি দেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। দেশকে পাকিস্তানী আদলে বাংলাস্তান নাম দেয়ার পাঁয়তারা শুরু করে জিয়া-মোশতাক গং। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব জয় বাংলা স্লোগানকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এটাই হবে লাখো শহীদদের প্রতি প্রকৃত ভালবাসা ও সম্মান জানানোর এবং মুক্তিযুদ্ধের নামাবলী পড়ে থাকা রাজাকারদের মোনাফেকির সবচেয়ে বড় শাস্তি। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট কর্তৃক রুল জারি করা হয়েছে এই মর্মে যে, কেন জয় বাংলাকে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করা হবে না। আমাদের মতো প্রতিটি বাঙালীর মনের অভিব্যক্তির বহির্প্রকাশ ঘটেছে সর্বোচ্চ আদালতের এই রুলিংয়ের মাধ্যমে। যে স্লোগান দিয়ে লাখো মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করার জন্য পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করেছে, যে বাণী বক্ষে ধারণ করে বিপুল রণনিনাদে আকাশ বাতাস কাঁপিয়েছে সারা বাংলার মুক্তিকামী জনতা, যে বজ্রনিনাদ ধ্বনিত হয়েছে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতার কণ্ঠে তাঁর প্রতিটি ভাষণে, দেশে ও বিদেশে, এমন কি জাতিসংঘে, যে কথামালা বক্ষে ধারণ করে বাংলার রাজপথ, মাঠ, ঘাট প্রান্তরে প্রাণ দিয়েছে লাখো মানুষ, যে কথাগুচ্ছ আজও বুকে নিয়ে মাটির নিচে শুয়ে আছেন লাখো শহীদ, সেই বাণী আজ এই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জয়জয়কারের দিনে আর অবহেলিত পারে না থাকতে এ দেশে। জয় বাংলা অচিরেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্লোগানের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হোক, ভাষার মাসে, স্বাধীনতার মাসের প্রাক্কালে এটাই দেশবাসীর আকাক্সক্ষা। লেখক : অধ্যাপক ও সভাপতি গবর্নেন্স এ্যান্ড রাইটস সেন্টার ঢাকা
×