ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সোহেল মেহেদী, রাশেদ-আল-মাহফুজ

সুশাসন ও আগামীর বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:০২, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 সুশাসন ও আগামীর বাংলাদেশ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় প্রমাণ করে বাংলাদেশের মানুষ সবসময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চায়। তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে কি-না এটা নিয়ে যে শঙ্কা ছিল, সেটি এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দূর হয়েছে। কারণ, এই নির্বাচনে সংখ্যার বিচারে তরুণ ভোটারদের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথেই হাঁটবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন এবং বাংলাদেশের মানুষকে তারুণ্যনির্ভর একটি মন্ত্রিসভা উপহার দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ এমন একটি চমকপ্রদ তারুণ্যনির্ভর মন্ত্রিসভার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বিগত সরকারের সময়ে যথেষ্ট অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও সুশাসনের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। বর্তমান সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুশাসন নিশ্চিত করা এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়া। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে এটা চাউড় হচ্ছে যে, বর্তমান সরকার সুশাসন নিশ্চিত করার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক এবং নতুন মন্ত্রিসভা ইতোমধ্যে সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে তাদের কর্মপ্রচেষ্টা শুরু করেছেন। তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয়টি ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধান প্রয়োজন। বাংলাদেশের জনগণ যে স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরে হলেও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে চলেছেন। পঁচাত্তরপরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতা স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে থাকায় রাষ্ট্রের মৌলিক অবস্থানের বিচ্যুতি ঘটে। যে মূল্যবোধ, নীতি ও বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই নীতি ও বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানা হয়। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন, এদেশের দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্তের কারণে দীর্ঘদিন সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। দীর্ঘদিন ধরে সুশাসনের অনুপস্থিতির কারণে সমাজব্যবস্থায় মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়। রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি- সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়নি। ফলে রাষ্ট্রের সাংগঠনিক কাঠামোগুলো ছন্দহীন ও দুর্বল হয়ে যায়, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ, ইনডেমনিটি বিল পাসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধসহ অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসার কারণে মানুষের মাঝে নীতি ও মূল্যবোধের চর্চার বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি। এতে করে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গের সদুদ্দেশ ও আন্তরিক সেবার মানসিকতা গড়ে উঠেনি। ফলে সমাজের সর্বস্তরে অসুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয় এবং দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের ছায়া বিস্তার লাভ করে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। তবে শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও সাহসী নেতৃত্বই কেবল এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারে। বিশ্বাস করি আমাদের প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রে সফল হবেন। তবে মন্ত্রিপরিষদের সকল সদস্যসের সম্মিলিত প্রয়াস ও আন্তরিকতা প্রয়োজন। প্রতিটি বিভাগ ও অণুবিভাগের কাজে গতিশীলতা আনয়নের ক্ষেত্রে তাঁদের একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশ যে বর্তমানে একটি ভাল অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সকল সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান ভাল। তবে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যদি দুর্নীতি প্রতিরোধ করে সুশাসন নিশ্চিত করা যেত তাহলে আরও দুই শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারত। দুর্নীতির মূলোৎপাটন কিভাবে করা যায় সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। বর্তমান কর্মপরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন দুর্নীতির আওতামুক্ত রাখতে হবে। অতীতে যে সমস্ত ব্যক্তি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, তাঁদেরকে অবশ্যই বর্তমান কর্মপরিকল্পনার বাইরে রাখতে হবে। তাছাড়া দুর্নীতির বহুমাত্রিক ক্ষেত্র রয়েছে, তাই দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগতভাবে এগুতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানে গবেষণায় ব্যবহৃত ইনস্টিটিউশনাল থিওরির প্রয়োগের কথা ভাবা যেতে পারে। এই তত্ত্বটির তিনটি উপাদান- রেগুলেটিভ প্রেসার, নরমেটিভ প্রেসার ও মিমেটিক প্রেসার কোনব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আচরণগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে কনটেক্সট বিবেচনায় একেকটি প্রেসার একেক ক্ষেত্রে ভাল ফল প্রদান করে। সাধারণত সীমিত সম্পদে সীমাহীন চাহিদার কারণে নরমেটিভ প্রেসার স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যথাযথভাবে কাজ করতে পারে না। তাছাড়া ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থায় মিমেটিক প্রেসারের কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে একমাত্র রেগুলেটিভ প্রেসারই উন্নয়নশীল দেশের সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর। চীনা গবেষক ইয়াং এ্যান্ড ফারলে (২০১৬) তাঁদের গবেষণা কর্মে দেখিয়েছেন যে- কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর রেগুলেটিভ প্রেসার প্রয়োগের ফলে অবস্থার দ্রুত উন্নয়ন ঘটে। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে দুর্নীতির মূলোৎপাটনে অবশ্যই রেগুলেটিভ প্রেসারের প্রয়োগ প্রয়োজন। আমরা সেই পথেই হাঁটছি বলে মনে হচ্ছে। সম্প্রতি হাইকোর্ট নদী দখল ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধে আদেশ দিয়েছেন। নদীর দুই পাশ থেকে অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদ অভিযান চলছে। নদী রক্ষায় যে আইন রয়েছে, সেটির প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে নদী দখল না হয়। তাছাড়া দুদুকের অভিযান অব্যাহত আছে, তবে অসাধু ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার যোগ্যতা যে তিনি রাখেন তার প্রমাণ আমরা গত দুই মেয়াদে শত প্রতিকূলতার মাঝে দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করে সার্বিক অগ্রগতি সাধন করা দেখে খুব সহজেই আঁচ করতে পারি। সুশাসন প্রতিষ্ঠাকরণে স্বচ্ছতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্য সরকারের বিভাগ ও অনুবিভাগগুলো জবাবদিহিতার আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরী। যদি রেগুলেটিভ প্রেসার প্রয়োগ করা যায় তবে সরকারের বিভাগ ও অনুবিভাগগুলোর মধ্যে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাবে খুব সহজেই। কারণ, এক্ষেত্রে আইন ও আইন প্রয়োগের যথাযথ সমন্বয় ঘটবে। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার পাশাপাশি জনপ্রশাসনকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ একটি ইস্যু যা দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাক্সিক্ষত সেবাসমূহ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। তবে সেটি অবশ্যই রেগুলাটিভ প্রেসার প্রয়োগের মাধ্যমে জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আস্থার একটি সঙ্কট বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত। সেক্ষেত্রে দুর্নীতির বহুমাত্রিকতা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায় থেকে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতি নির্মূল ও সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে একটি সেল গঠন করা যেতে পারে। যেটি আস্থার সঙ্কট নিরসন করবে, পাশাপাশি রেগুলেটিভ প্রেসারের মতো কাজ করবে। বাংলাদেশের মানুষের আস্থার জায়গা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নিশ্চয় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ উপহার দিবেন। লেখকদ্বয় : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক
×