ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রুমা সীমান্তে শরণার্থীদের নিয়ে আসে আরাকান আর্মি

প্রকাশিত: ১১:২৩, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

রুমা সীমান্তে শরণার্থীদের নিয়ে আসে আরাকান আর্মি

নিজস্ব সংবাদদাতা, বান্দরবান, ৯ ফেব্রুয়ারি ॥ রুমা উপজেলার প্রাংসা সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায় শরণার্থীদের বাংলাদেশে নিয়ে আসে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি (এএ)। এমন তথ্য জানা গেছে স্থানীয় একাধিক সূত্রে। সূত্রগুলো জানায়, জেলার তিন উপজেলায় খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত করে আলোচনায় আসা আরাকান আর্মি গত তিন বছর তাদের অপরাধ কার্যক্রম সীমিত করে। গত শনিবার প্রথম দফায় মিয়ানমারের চীন রাজ্য থেকে ১৬৩ বৌদ্ধ শরণার্থী বান্দরবানের রুমা উপজেলার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের চক্ষ্যং সীমান্তের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করিয়ে ফের স্থানীয়দের মাঝে আলোচনায় আসে (এএ)। আর মিয়ানমার থেকে তাদের অনেকটা জোর করে বাংলাদেশে নিয়ে আসে আরাকান আর্মি। গত বুধবার আরও ৪০ পরিবার সেখানে অনুপ্রবেশ করায় এ নিয়ে অনুপ্রবেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০৩ জনে। সূত্রে আরও জানা গেছে, মিয়ানমার সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মিসহ বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে মূলত প্রাণে বাঁচানোর জন্য আরাকান আর্মি সমর্থিত মিয়ানমারের এসব নাগরিককে তারা বাংলাদেশে নিয়ে আসে। গভীর অরণ্যঘেরা বান্দরবান-মিয়ানমার সীমান্ত থেকে অন্তত ৩ দিন হেঁটে তারা জেলার চক্ষ্যংপাড়ায় প্রবেশ করে। এ বিষয়ে রুমার রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড মেম্বার ভান লং বম বলেন, তাদের আরাকান আর্মি রুমায় নিয়ে আসে, তবে কি জন্য তাদের এখানে এনেছে আমরা তা এখনও জানতে পারিনি। মিয়ানমার থেকে আসার পর তারা খোলা জায়গায় অবস্থান নিলেও স্থানীয়রা তাদের জন্য তাঁবু ও খাদ্য সরবরাহ করে প্রাংসা ইউনিয়নের স্থানীয়রা গরিব হওয়ায় তাদের যথাযথ ভাবে খাদ্য দিতে পারছে না। ফলে শরণার্থীরা দিনে এক বেলা ভাত, তার সঙ্গে তরকারি হিসেবে পাহাড়ী আলু ও কলাগাছের বাকলসহ বিভিন্ন লতাপাতা রান্না করে খিদা নিবারণ করছে। একজনের খাবার তারা চার-পাঁচজন মিলে ভাগ করে খাচ্ছে। এ বিষয়ে রুমার রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড মেম্বার সাংকিং বম বলেন, বৌদ্ধ অনুসারী এ শরণার্থীদের রুমার চাইক্ষ্যংপাড়ায় অনেকটা গার্ড দিয়ে আরাকান আর্মি নিয়ে আসে, পরে তারা ফের চলে যায়। তিনি আরও বলেন, আপাতত পাড়াবাসীর সামান্য খাদ্য সরবরাহ করছে তাদের। এদিকে পাহাড়ে প্রচ- শীতের কারণে অনুপ্রবেশকারীরা চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন, মিয়ানমারের সেনাদের নির্যাতন আর অত্যাচারের মুখে চীন প্রদেশের পালাটওয়া শহরতলি তরোওয়াইন’ পশ্চিমে খামংওয়া, কান্তালিন গ্রামগুলো থেকে খ্যা, রাখাইন, বম ও খেয়াং সম্প্রদায়ের শিশুসহ অনুপ্রবেশ করে। গত বৃহস্পতিবার সকালে মিয়ানমার থেকে আসা এক রাখাইন নারীর প্রসব বেদনা উঠলে তাকে পাশের একটি পাড়ায় নিয়ে সন্তান প্রসব করান স্বাস্থ্যকর্মীরা। আরও দুজন গর্ভবতী নারী আছেন। দু-একদিনের মধ্যে তাদেরও সন্তান প্রসব হতে পারে।’ রুমায় অনুপ্রবেশকৃত শরণার্থীদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে এ বিষয়ে বান্দরবানের সিভিল সার্জন ডাঃ অংসুই প্রু বলেন, স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে এলাকাগুলোর স্বাস্থ্য কর্মীদের ইতোমধ্যে সজাগ থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রুমা উপজেলা প্রশাসন (সরকারী) সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত শিশুসহ ১৬০ মিয়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ অনুপ্রবেশ করেছে এলাকাটিতে। তবে দেশের ২য় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কেউক্রাডং থেকে উক্ত এলাকায় পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে অন্তত একদিন সময় লাগার কারণে বৃহস্পতিবার সেখানে বিজিবি ও সেনা সদস্যরা পৌঁছেন। তবে শনিবার বিকেলে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাদের ত্রাণসামগ্রী দেয়া সম্ভব হয়েছে কিনা জানা যায়নি। এ বিষয়ে রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাসসুল আলম জানান, এখানে বিজিবি ও সেনা সদস্যদের পাঠানো হয়েছে, তারা ফিরলেই সরকারের নির্দেশনা মতো আমরা শরণার্থীদের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করব। গত ৪ জানুয়ারি দেশটির স্বাধীনতা দিবসের ভোরে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া রাখাইনের চার পুলিশ পোস্টে হামলা চালায় সশস্ত্র আরাকান আর্মি। তাদের হামলায় মিয়ানমারের সীমান্ত বাহিনী বিজিপির ১৩ সদস্য নিহত হন এবং আরাকান আর্মি অনেক বিজিপি সদস্য ও স্থানীয়দের বন্দী করে রাখে। এরপর থেকে মূলত রুমা সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের এলাকাগুলো উত্তপ্ত হয়ে উঠলে নিরাপত্তার জন্যই তাদের অনুপ্রবেশের ঘটনা আরাকান আর্মি। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক মোঃ দাউদুল ইসলাম জানান, তিনি এ ধরনের তথ্য সম্পর্কে অবগত নন। তিনি আরও জানান, আমার কাছে আরাকান আর্মির কোন তথ্য নেই। কারা এই আরাকান আর্মি? ১৭৮৪ সাল থেকে শুরু হওয়া আরাকানি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের একটি বড় দিক হলো এটা মূলত বৌদ্ধ নেতৃত্ব প্রধান। আরাকান আর্মিও তার ব্যতিক্রম নয়। মিয়ানমারের রাজনীতিতে তাদের ‘এএ’ বলে উল্লেখ করা হয়। মূলত আরাকানভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন হলেও এএ’র ঘাঁটি এলাকা কাচিনে এবং সামরিক কার্যক্রম বিস্তৃত বান্দরবান জেলাসংলগ্ন চীন ও আরাকান এলাকায়। ২০০৯ থেকে এদের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। প্রায় চার হাজার যোদ্ধা রয়েছে আরাকান আর্মির। ২০১৫ সালের ২৬ আগস্ট বান্দরবানের থানচি উপজেলার বড় মদক এলাকায় ১০টি ঘোড়া আটক করেন বিজিবি সদস্যরা। এর মধ্যে ৬টি ঘোড়া আটক করে মদকের বিজিবি ক্যাম্প ও ৪টি থানচি ক্যাম্প। এই ১০টি ‘এ্যারাবিয়ান হর্স’ আরাকান আর্মির। বিজিবির সদস্যরা ঘোড়া আটক করায় ক্ষুব্ধ হয় আরাকান আর্মির সদস্যরা। এ সময় বড় মদক, বলিপাড়া ও বাতংপাড়া এলাকায় টহলরত বিজিবি সদস্যদের ওপর গুলি চালায় ‘আরাকান আর্মি’র সদস্যরা। এতে বিজিবির নায়েক জাকির হোসেন আহত হন। এরপর পাল্টা গুলি করেন বিজিবির সদস্যরা। পরে সমন্বিত আক্রমণ পরিচালনার জন্য হেলিকপ্টারে ওই এলাকায় অতিরিক্ত বিজিবি ও সেনাসদস্য পাঠানো ঘটনা ঘটে। খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজির মাধ্যমে জেলার রুমা, থানচি ও লামা উপজেলায় তাদের অবস্থান এখনও জানান দেয়।
×