ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সব বয়সী পাঠকের সরব উপস্থিতি, বসন্তের হাওয়া

প্রকাশিত: ১১:২৩, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

সব বয়সী পাঠকের সরব উপস্থিতি, বসন্তের হাওয়া

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ বইমেলাটা, কী অবাক কান্ড, পুরনো হয় না! প্রতিদিন একই স্থানে যাওয়া আসা। ঘুরে বেড়ানো। এরপরও নতুনের মতো লাগে। শুধু নতুন নয়, ক্রমে উৎসবমুখর হয়ে উঠছে মেলা। শুক্রবার থেকেই উৎসবের আমেজ। শনিবারে এসে রংটা আরও যেন গাঢ় হলো। বসন্ত বাতাসে সইগো বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে...। মেলাজুড়ে কাঁচা ফুলের গন্ধ। বসন্তের হাওয়া। অনেকে বলবেন, মাঘ মাসই তো শেষ হলো না। বসন্ত আসবে কী করে? তাদের প্রতি আহ্বান- মেলা ঘুরে যান। একবার ঢুঁ মারলে বই আর আগাম বসন্তে হারিয়ে যাবেন আপনিও। বাংলা একাডেমির কোন একটা গাছে বসে কী মধুর ডাকছে কোকিল! মাঝে মাধ্যেই কানে আসছে কুহু সুর। এ আহ্বান উপেক্ষা করবে, সাধ্য কার? তরুণীরা তাই শাড়ি পরে সুন্দর সেজে মেলায় আসছেন। অধিকাংশের মাথায় মৌসুমি ফুল দিয়ে বানানো মুকুট বা ফ্লাওয়ার ক্রাউন। মনেও একটা পুলক। কখনও বান্ধবীরা মিলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কখনও আবার বন্ধু এবং বান্ধবী। যুগল পায়ে চলতে চলতে স্টল বা প্যাভিলিয়নের সামনে থামছেন। একটা হেলাল হাফিজ তুলে নিচ্ছেন। কিংবা মহাদেব সাহা। কবিতার বইয়ে প্রেম খুঁজছেন। আর হুমায়ূন আহমেদ তো আছেনই। বসন্ত আসছে বলেই দৃশ্যগুলো এমন দেখায়। অথবা দৃশ্যগুলো এমন বলেই মনে পড়ে যায়, বসন্ত আসছে। অপেক্ষাকৃত সিরিয়াস পাঠকরাও মেলায় আসতে শুরু করেছেন। খ্যাতিমান লেখকরা আসছেন। তারও আগে থেকে আসছেন প্রকাশকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অবসর প্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা, টকশো গরম করা বক্তা- কে নেই? ঘুরতে ফিরতে প্রিয় পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে। চলছে কুশল বিনিময়। তবে আসাদুজ্জামান নূরকে দেখে এগিয়ে যেতেই হলো। শনিবার প্রথম মেলায় এসেছিলেন তিনি। অথচ গত কয়েক বছর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে মেলা আয়োজনের মূল দায়িত্ব পালন করেছেন। শুরুর আগে থেকেই ঘন ঘন বাংলা একাডেমিতে আসা যাওয়া ছিল তার। কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত মিটিং করেছেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে প্রস্তুতি দেখেছেন। নানা নির্দেশনা দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের। কথা বলেছেন সাংবাদিকদের সঙ্গেও। সব মিলিয়ে চমৎকার সংশ্লিষ্টতা। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। মন্ত্রীর দায় ভার কাঁধ থেকে নামিয়েছেন তিনি। শুধু আসাদুজ্জামান নূর পরিচয়ে মেলায় এসেছেন। স্বনামে অত্যুজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। মেলা, সত্যি বলতে, মিস করছিল তাকে। আর তাই মেলায় আসতেই বিভিন্ন বয়সী মানুষ তাকে ঘিরে ধরেছিল। অটোগ্রাফ শিকারিরা প্রিয় লেখকের বই কিনে তাতে আরেক প্রিয় অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের অটোগ্রাফ চাইছিলেন। কী আর করা? সই করে যাচ্ছিলেন তিনি। এর ফাঁকে ফাঁকে ছবি তোলার আবদার। সেটিও যথাসম্ভব পূরণ করলেন। তার আগে অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নে একটি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন তিনি। বইয়ের নাম ‘সুন্দর খেলা করে।’ বই বলতে কাব্যগ্রন্থ। কবির নাম আব্দুল মান্নান শিকদার। ছোট্ট আয়োজনে আরও উপস্থিত ছিলেন একুশে পদক প্রাপ্ত লেখক মঈনুল আহসান সাবের, বইয়ের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ। কাব্যগ্রন্থটি সকলকে পড়ে দেখার আহ্বান জানান আসাদুজ্জামান নূর। একই দিন ‘অর্জন’ নামের নতুন একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তিনি। সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য পরে জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেন। এদিনও সেই নরম সুর আর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। আয়োজক বাংলা একাডেমির প্রশংসা করে তিনি বলেন, সুন্দর একটি মেলা হচ্ছে। প্রতি বছরই মেলার শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে। এবারও ঘটেছে। বড় পরিসর মেলা আজকের বাস্তবতা। আগে এটি উপলব্ধি করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আয়োজনটিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে জানান তিনি। নূর বলেন, যতদূর জানতে পেরেছি বই প্রকাশনা এবং বিক্রির পরিমাণও বাড়ছে। এটা খুব ভাল খবর। আমি নিজেও মেলা ঘুরে দেশের প্রথিতযশা লেখকদের বই কিনি। নবীনদের কেউ ভাল কিছু লিখেছে কিনা তার খোঁজ করি। কথা বলার মাঝখানেই নিজেদের প্রকাশিত কয়েকটি বই আসাদুজ্জামান নূরের হাতে তুলে দেন প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। এ সময় নূর বলেন, মেলা আসলে অনেক বই, এই যে দেখছেন, উপহার হিসেবেও পাই। কথা শুনে হা হা করে হেসে ওঠেন সবাই। এভাবে অনেকদিন পর কথায় হাসিতে গল্প আড্ডা জমিয়ে রেখেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। আনন্দঘন শিশুপ্রহর ॥ এর আগে বেলা ১১টায় খুদে পাঠকদের জন্য ছিল বিশেষ শিশু প্রহরের ব্যবস্থা। এদিন একাডেমি প্রাঙ্গণে শিশু-কিশোর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার প্রাথমিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সাধারণ জ্ঞানে ১৪৬ জন এবং উপস্থিত বক্তৃতায় ৪৩ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ বেতারের সঙ্গীত পরিচালক কাজী দেলোয়ার হোসেন, বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী অনিমা মুক্তি গমেজ ও ড. আখতারুজ্জাহান। ২১৮ নতুন বই ॥ মেলার নবম দিনে শনিবার নতুন বই এসেছে ২১৮টি। লেখক বলছি ॥ এদিন ‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন প্রকাশিত গ্রন্থ বিষয়ে আলোচনা করেন মাহবুব সাদিক, মাহবুব আজিজ, মারুফ রায়হান, কুমার চক্রবর্তী এবং পাপড়ি রহমান। মেলা মঞ্চের সেমিনার ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘আবদুল হক : জন্মশতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সৈয়দ আজিজুল হক। আলোচনা করেন অজয় দাশগুপ্ত, সোহরাব হাসান এবং আহমাদ মাযহার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সুব্রত বড়ুয়া। প্রাবন্ধিক বলেন, একজন সার্থক মননশীল প্রাবন্ধিকের চিন্তনপ্রক্রিয়াকে অনিবার্যভাবে যেমন হতে হয় যুক্তিশৃঙ্খলিত তেমনি তার আবেগ-অনুভূতিকেও বাঁধতে হয় বুদ্ধির শাসনে। সাহিত্য ও সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ে বিশ্লেষণে আগ্রহী একজন প্রাবন্ধিককে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হয় সাহিত্যের যাবতীয় গতি-প্রকৃতির পাশাপাশি তার দেশকালের সংকট ও তার উত্তরণমুখী সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনাকে। এভাবে তিনি একটি জাতির সামগ্রিক সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সঙ্গে একাত্ম হন, ব্যাপৃত হন আপন জাতিসত্তার স্বরূপ সন্ধানে। যিনি প্রকৃত মনীষী তিনি কালের কাঠামোর মধ্যে থেকেও হয়ে ওঠেন যুগন্ধর ও কালোত্তর প্রতিভার অধিকারী। ‘কলমসৈনিক’ হিসেবে খ্যাত আবদুল হক বাংলাদেশের সেরকমই শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদের একজন। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘটনারÑ ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে অগ্রণী, দূরদর্শী ও দায়িত্বশীল চিন্তকের পরিচয় দিয়েছেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে অন্য বক্তারা বলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- উভয় ক্ষেত্রেই আবদুল হক প্রদর্শন করেছেন বুদ্ধিজীবীর দায়বোধের চূড়ান্ত আদর্শ। তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা, দূরদর্শিতা ও দেশপ্রেমের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এ বিষয়ক প্রবন্ধাবলি। তার প্রবন্ধসমূহে সর্বদাই অভিব্যক্ত হয়েছে এদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে গভীরতর বিশ্লেষণমূলক অনুভাবনা। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে আবদুল হকের সুগভীর চিন্তাভাবনাকে পাঠককুলের বোধের কাছে যত বেশি পৌঁছে দেয়া যাবে সমাজ ও জাতির জন্য তত বেশি তা ইতিবাচক ও কল্যাণময় ফল বয়ে আনবে। আবদুল হকের বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনার বিস্তার আমাদের একান্তভাবে কাম্য। সভাপতির বক্তব্যে সুব্রত বড়ুয়া বলেন, আবদুল হক একজন সত্যসন্ধ বুদ্ধিজীবী। তাঁর নাট্যরচনা, অনুবাদ, দিনলিপি, প্রবন্ধ গবেষণা-সবকিছুর মধ্যেই বড় করে প্রতিভাত হয়েছে দেশপ্রেম, উদার মানবিকতা এবং নিরাপোষ মনোভাব। জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে নতুন করে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ॥ একই মঞ্চে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি আতাহার খান এবং ফরিদ কবির। আবৃত্তি করেন বেলায়েত হোসেন এবং অনন্যা লাবণী পুতুল। সঙ্গীত পরিবেশন করেন বহ্নিশিখার শিল্পীরা। নৃত্য নিয়ে মঞ্চে ছি ঘুংঘুর সাংস্কৃতিক একাডেমি।
×