ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সামরিক বাহিনীতে নারীর অগ্রযাত্রা

প্রকাশিত: ১২:০৮, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 সামরিক বাহিনীতে নারীর অগ্রযাত্রা

সময় এখন বাংলাদেশের। উন্নয়নের পথে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলছে লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত লাল সবুজের সোনার বাংলা। নারীর ক্ষমতায়ন থেকে শুরু করে যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, বিদ্যুতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি এখন বিশ্বের এক বিস্ময়। আর এই উন্নয়নে রুধির ধারার মতো এদেশের কর্মজীবী নারী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। পুরুষের পাশাপাশি নারীও সমাজে নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতায় কাজ করে যাচ্ছেন, যা এক শক্তিশালী নারী সমাজ গঠনের পাশাপাশি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী নারী সমাজ গঠনেও সহায়ক। গৃহস্থালীর কাজ থেকে শুরু করে গোটা দেশ চালানোর কাজে আমাদের নারী সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। নারী যে দশভুজা, তার নিদর্শন দিন দিন নারীর কর্মেই প্রকাশ পাচ্ছে। বেশিরভাগ কর্মজীবী নারীকে অফিসের কাজ শেষে বাসার কাজও করতে হয়। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আমাদের দেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৯১ লাখ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত নারীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দুই কোটিতে। অর্থাৎ এক অর্থবছরে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়েছে নয় লাখ। অন্যদিকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কর্মজীবী পুরুষের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৩১ লাখ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের শ্রমশক্তিতে কর্মজীবী পুরুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ কোটি ৩৫ লাখ। অর্থাৎ এক অর্থবছরে শ্রমশক্তিতে পুরুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে মাত্র চার লাখ। অপর এক বেসরকারী গবেষণা সংস্থার তথ্যমতে, একজন নারীকে গড়ে প্রতিদিন ১৬-২০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। পারিবারিক কাজের ৮০ শতাংশই নারী সমাধা করে থাকে। এসব বিষয় থেকে নারীর অধিক দায়িত্বশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে নারীর যে মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা সহজে গড়ে ওঠেনি। এর পেছনে রয়েছে তাদের কঠোর সংগ্রাম,রয়েছে সুদৃঢ় প্রত্যয় ও সামনে এগিয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা। আর এসবই সম্ভব হয়েছে নারী শিক্ষার প্রসারের ফলে। শিক্ষার প্রসারের ফলে নারী নিজেকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে এক বলিষ্ঠ সামাজিক অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন, নিজের যোগ্যতায় হতে পেরেছেন সামাজিক মর্যাদার আসনে সমাসীন। অথচ আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে নারী শিক্ষার প্রথম দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই,্ উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ, বিধবাবিবাহ এবং নারীর অধিকার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। সে সময় কিছু খ্রীস্টান মিশনারির উদ্যোগে নারী শিক্ষার সূচনা হয়। তৎকালে প্রাবন্ধিক, প্রকাশক ও সমাজ সংস্কারক যারাই লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের প্রায় সবাই নারী শিক্ষার বিষয়টি অতি উৎসাহের সঙ্গে পর্যালোচনা করেছিলেন। তাছাড়া নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের অবদানের কথা তো আমাদের কারো অজানা নয়। এর মাধ্যমেই অন্তঃপুরের নারী শিক্ষার সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন। আর আজ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে খুঁজে নিতে পারছেন তাদের জীবনের মুক্তির পথ তথা সঠিক পথ। বাধাবিপত্তির দেয়াল ভেঙ্গে সামাজিক মর্যাদা ও জীবনের বিকাশ ঘটাতে পারছেন, নতুন জীবনবোধে জাগ্রত হয়ে সামনে চলার শক্তি ও সাহস অর্জন করতে পারছেন। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। আজ কোন্ ক্ষেত্রে নেই আমাদের নারীরা? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি,রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলা,সামরিক ও বেসামরিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবদান উল্লেখ করার মতো। তীব্র প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নারী নিজেদের অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশা যেমন ট্রেন চালনা থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীতে নিজেদের দক্ষতা ও মেধার স্বাক্ষর রাখছেন। বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টে আরোহণকারী বাংলাদেশের নিশাত মজুমদার, প্রথম নারী ট্রেন চালক সালমা খাতুন, এমআই -১৭ হেলিকপ্টার উড্ডয়নকারী নারী বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাইমা হক ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তামান্না -ই-লুৎফি ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে প্রথম নারী মেজর জেনারেল সুসানে গীতির নাম এখন আমাদের সকলের কাছেই পরিচিত। সম্প্রতি এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত চার নারী অফিসারের নাম। গণমাধ্যমে প্রকাশিত, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে দীর্ঘমেয়াদী কোর্সের চার নারী অফিসারকে মেজর থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেলে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। পদোন্নতিপ্রাপ্তরা হলেন সানজিদা হোসেন (আর্টিলারি), সৈয়দা নাজিয়া রায়হান (আর্টিলারি), ফারহানা আফরিন (আর্টিলারি) ও সারাহ আমির (ইঞ্জিনিয়ার্স)। নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন সেনাবাহিনীতে দীর্ঘমেয়াদী কোর্সের নারী অফিসারদের লে. কর্নেলে পদোন্নতি প্রদানের মাধ্যমে সেই পদক্ষেপের আরও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। উল্লেখ্য, প্রধানন্ত্রীর নারীর ক্ষমতায়নের অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দীর্ঘমেয়াদী কোর্সে নিয়মিত নারী অফিসার নিয়োগ করা হচ্ছে। ৪৭ তম দীর্ঘমেয়াদী কোর্স থেকে শুরু হওয়া এসব নারী অফিসার এরই মধ্যে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে পেশাগত দক্ষতা প্রদর্শনে সফল হয়েছেন। তাদের এই সক্ষমতার অংশ হিসেবে চার নারী অফিসারকে মেজর থেকে লে. কর্নেলে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। লে.কর্নেল সারাহ আমিরের গ্রামের বাড়ি বরিশাল। বাবা কর্নেল (অব.) আমির হোসেন। মা মাহমুদা খাতুন। স্বামী লে. কর্নেল মাহমুদ হাসান। তিনি স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি এ্যান্ড ট্যাকটিসের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। লে. কর্নেল সানজিদা হোসেনের গ্রামের বাড়ি ফেনী। বাবা এটিএম দেলোয়ার হোসেন একটি বেসরকারী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মা বিলকিছ আরা চৌধুরী। স্বামী লে.কর্নেল কামরুল হাসান। তিনি রংপুরের খোলাহাটিতে সাত ফিল্ড রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করবেন। লে.কর্নেল ফারহানা আফরিনের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। বাবা মৃত আমিনুল ইসলাম সাবেক ডিআইজি-প্রিজন। মা নিলুফা ইসলাম। স্বামী লে. কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি আর্মি এভিয়েশন গ্রুপের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। লে.কর্নেল সৈয়দা নাজিয়া রায়হানের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতি। বাবা সৈয়দ আবু রায়হান অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব। মা রিমা খান। স্বামী লে.কর্নেল মোঃ তানভীর হোসেন। তিনি ময়মনসিংহের ৪ ফিল্ড রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। একদিন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান হিসেবে নারী নেতৃত্বে আসবেন; সামরিক বাহিনীতে নারীর উত্তরোত্তর সফলতায় আমরা এখন সেই স্বপ্ন দেখি। আমাদের নারীরা দিন দিন শুধু দেশেই নয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নানা সফলতার স্বাক্ষর রেখে আসছেন। বিষয়টি সত্যিই গর্বের। নারীর এই অগ্রসরতার পথটি এখনও যে সম্পূর্ণ কণ্টকমুক্ত তা নয়। নানা শঙ্কা আজও কোন কোন নারীকে তাড়া করে বেড়ায়। এতদসত্ত্বেও থেমে নেই তাদের পথচলা। নারীর এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে নিরন্তর করতে চাই নারীর প্রতি সহিংস মনোভাবের পরিবর্তন, চাই সমাজের সৃজনশীল সকল কর্মকা-ে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি। কেননা একটি আদর্শ পরিবার, সমৃদ্ধ ও আলোকিত সমাজ গঠনে, পারিবারিক আবহে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে, সর্বোপরি একটি সভ্য জাতি গঠনে নারীর ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
×