ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লুৎফে তাহেরা

পেশাগত জীবনটা তৈরি হয় নারীবান্ধব কর্মযজ্ঞে

প্রকাশিত: ১২:০৬, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

পেশাগত জীবনটা তৈরি হয় নারীবান্ধব কর্মযজ্ঞে

নাজনীন বেগম ॥ সমাজের অর্ধাংশ নারী জাতির সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া সার্বিক উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। একজন সচেতন নারী যেভাবে নিজেকে তৈরি করে পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক অবস্থাকেও সমানভাবে গড়ে তুলতে কার্যকরী ভূমিকা পালনেও অবদান রাখে। লুৎফে তাহেরা সে মাপেরই একজন কর্মজীবী নারী যিনি এই পর্যন্ত চলে আসা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে নারী বিষয়ক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বিবেচনায় রেখেছেন। যেখানে মা, শিশু স্বাস্থ্যই শুধু নয় বয়োসন্ধিকালের উদীয়মান কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা উত্তরণের ওপরও তার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ বর্ণাঢ্য কর্মজীবনকে উজ্জীবিত করে। নারীদের নানাবিধ সমস্যা, সঙ্কট এবং অতিক্রমের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা এই নারী কর্মীর বিভিন্ন জরিপে দৃশ্যমান হয়ে এর যথার্থ গন্তব্যে পৌঁছাতেও দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করে। নারীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় মনে হয়েছে তাদের চারপাশে যে সামাজিক শৃঙ্খল সেটা ভাঙতে গেলে শুধু নিজেদের সচেতনতাই যথেষ্ট নয়। বরং বেশি প্রয়োজন পাশে থাকা পিতা, স্বামী কিংবা পুত্রের ও সহনশীল মনোবৃত্তি এবং সার্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা। গোষ্ঠীবদ্ধ পরিবার আর সমাজে বাস করতে হলে একে অন্যের সহযোগী হতে না পারলে সম্মুখ সমরে অনেক সমস্যাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। লুৎফে তাহেরা, পিতা এটিএম শফুরুজ্জামান এবং মাতা ফখরুহ জাহান বেগম। বাবা অবিভক্ত বাংলার কো-অপারেটিভ ব্যাংক ইন্সপেক্টর। লুৎফে পৃথিবীর আলো দেখার ৩ মাস আগেই পিতৃহীন হন। দুই বাই-বোনের মধ্যে তিনি ছোট। মা একজন সফল গৃহিণী। বাবা হারানো দুই সন্তানকেই লেখাপড়ায় সুশিক্ষিত করে সমাজের একজন যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সবটাই করেছেন তিনি। ফলে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার এক ছোট গ্রাম থেকে এসে ঢাকা শহরে বসতি স্থাপন করতে হয়। শান্তি নগরের পৈত্রিক বাড়িতে থেকে তাহেরা তার শিক্ষা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় পার করতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে সিদ্ধেশ্বরী লার্গস হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং বখশীবাজার সরকারী কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। সময়টা ছিল ’৬০-এর দশকের উত্তাল রাজনৈতিক পালাক্রম। সেই সময়ের ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হয়ে বাম ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা আজও ফেলে আসা জীবনের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। এর পর শুরু হয়ে যায় ’৬৯-এর সেই অগ্নিঝরা গণঅভ্যুত্থান যার একজন সচেতন অংশীদার তাহেরা নিজেই। বিভিন্ন প্রোগ্রামে কামাল লোহানীর সঙ্গে শান্তি নগরের ডন স্কুলে আন্দোলন, সংগ্রামের অনুষঙ্গ হওয়া জীবনের এক অনন্য স্মৃতি। একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে (সম্মান) স্নাতক কোর্সে ভর্তি হওয়া ও শিক্ষা জীবনের এক অবিস্মরীণয় অধ্যায়। পরবর্তী স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন ও জ্ঞানচর্চার এক অনবদ্য সম্প্রসারিত ক্ষেত্র। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী পথযাত্রায় বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন আলম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সচিব ফজলুল হকের সঙ্গে। ১৬ বছরের বিবাহিত জীবনে দুই পুত্র সন্তানের মা হন। যারা আজ নিজ নিজ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। এরই মধ্যে জীবনের আর এক দুর্যোগ মোকাবেলায় এই অদম্য নারী বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। ১৯৮৯ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হলেও দুই সন্তানের দিকে তাকিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেও সময় লাগেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ১৯৭৫ সালে কর্ম জীবনের যাত্রা শুরু করলেন। ৬ মাসের একটি জরিপ প্রকল্পে কাজ করেন মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মসূচীতে। যেখানে জরিপ জালানো হয় একজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সক্ষম নারী কত বার গর্ভধারণ এবং সন্তান জন্ম দিতে পারেন। শুধু তাই নয় সুস্থ এবং স্বাস্থ্যসম্মত শিশু পরিচর্যায় মায়েদের সচেতনতাও বিশেষভাবে নজরদারিতে থাকে। তথ্য-উপাত্ত প্রমাণ করে একজন সক্ষম মা পাঁচ থেকে ছয় বার গর্ভধারণ করে সন্তান ভূমিষ্ঠ করার ক্ষমতা রাখেন। এই যে নারীদের নিয়ে কাজ শুরু করলেন আজ অবধি সেখানে থেকে নিজেকে সরিয়ে আনেননি। মা ও শিশু বিষয়ক এই প্রকল্পটির আর্থিক অনুদানে ছিল বিশ্বব্যাংক। পরবর্তীতে তার পেশা গত জীবন সম্প্রসারিত হয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ‘পরিবার পরিকল্পনা আত্মনিবেদিত প্রকল্পে।’ টানা ১৩ বছর ‘এখানে মায়েদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতায় তার মনে হয়েছে জন্ম নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে শুধু মেয়েদের সচেতন কিংবা উদ্যোগী করলে চলবে না সঙ্গে যদি তার স্বামীকেও সম্পৃক্ত করা না যায়। সামাজিক ঐতিহ্য অনুযায়ী ছেলেরাই সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ও অধিকার প্রয়োগ করতে পারে। গতানুগতিক সামাজিক মূল্যবোধ পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র স্ত্রীদের সচেতন করা থেকে বেশি জরুরী তার কর্তা ব্যক্তিকেও অধিক সন্তান জন্মদানের নেতিবাচক প্রভাব ভালভাবে বুঝিয়ে দেয়া। দু’জনের সম্মিলিত মতবিনিময় এবং অভিন্ন সিদ্ধান্তে সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিবেচনা করা সঙ্গত। ১৯৮৮ সালে ইউএসএ আইডিতে বিসিকের মহিলা উদ্যোক্তা তৈরির প্রকল্পে কর্মজীবনের আরও এক অনন্য ধাপে সম্পৃক্ত হলেন। প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী হিসেবে এমন কর্মদ্যোতনা শুরু করে নারীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে নজর দিতে নতুন প্রকল্প হাতে নিলেন। ১৯৮৯ সালে লায়ন থেকে এই পথিকৃৎ নারীকে পুরস্কৃত করা হয় নারীদের অগ্রযাত্রার সফল অবদানের জন্য। ইতোমধ্যে নিজেকে জড়িয়ে নেন অন্য এক গণমাধ্যম প্রকল্প যেখানে নারীদের জীবন, পুষ্টি কথা এবং মায়েদের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীকে বিবেচনায় আনা হয়। ১৯৮২ থেকে ২০০২ সাল দীর্ঘ ২০ বছর বিটিভিতে এমন নারীবান্ধব অনুষ্ঠানের সমন্বয়কারী হিসেবে নিজের কর্মক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করেন। আর এই ধরনের নারী সম্পৃক্ত কাজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা থেকে সংশ্লিষ্টদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেয়া নিজের পেশাগত জীবনের উজ্জ্বলতম অধ্যায় বলে তিনি মনে করেন। অন্য অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ ও বিমুগ্ধ করতে পারার স্পর্শকাতর অনুভব এখনও তাকে আনন্দ দেয়। ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পথকন্যা শিশুদের নিয়েও তার মহৎ কর্মযোগ রাস্তায় বাস করা এসব মেয়ের অনেক বাস্তব ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতাও জন্মায়। বাস্তুচ্যুত, গৃহহীন এসব পথকন্যা। সারাদিন এখানে ওখানে কাজ করে রাতের বেলায় কোন এক পারিবারিক আঙিনায় জীবনটা কাটায়। আবার এমনও মেয়েশিশু আছে যারা দিনরাত রাস্তায় কাজই শুধু করে না তাদের বিশ্রাম এবং ঘুম হয় পথের আনাচে কানাচে, রেল স্টেশনের ধারে কিংবা কোন এক গৃহস্থের দরজার বাইরে। অদ্ভুত তাদের জীবন এবং জীবিকা নিরাপত্তাহীন অনিশ্চিত জীবনের দায় বহন করতে করতে কোন এক সময় হয়ত স্থিতি আসে কিংবা ভাসমান অবস্থায় দিন কাটে। এদের পেশা যেমন বিচিত্র, ঘর ছাড়ার কারণেও কোন নির্দিষ্ট মাত্রা নেই একইভাবে বয়ে চলা বিপন্ন জীবনের গতিতেও তেমন কোন সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। সত্যিই লুৎফে তাহেরা একেবারে শিশু বয়স থেকে বয়োসন্ধিকাল এবং শেষ অবধি বিয়ে, মাতৃত্বের বিপন্ন সময় এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় হরেক রকম কর্মসূচীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যেভাবে বিচিত্র কর্মজীবনকে সমৃদ্ধ করেন ও সংশ্লিষ্টদেরও সমস্যা, সঙ্কট দিকনির্দেশনা এবং অতিক্রমের উপায়ও সে মাত্রায় চিহ্নিত করতে সক্ষম হন। ২০১৩ সালে সর্বশেষ যে সব কিশোরী নিয়ে কাজ শুরু করেন এখনও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন। বয়োসন্ধিকালে (১২-১৮ বছর) উদীয়মান কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক সঙ্কটের মাত্রায় তার সচেতন দৃষ্টি আরোপ করে এদের প্রতি তার বিশেষ দায়বদ্ধতাকে দৃশ্যমান করে তোলেন। নারী সম্পৃক্ত এমন ঘনিষ্ঠ কার্যক্রমের সঙ্গে যিনি তার কর্মজীবনকে উৎসর্গ এবং উপহার দিয়েছেন। এমন মানবিক মাতৃশৌর্যের প্রতি অনমনীয় শ্রদ্ধা এবং প্রাণঢালা অভিনন্দন।
×