ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বইমেলা ঘিরে দায়বদ্ধতা

প্রকাশিত: ১১:৫০, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বইমেলা ঘিরে দায়বদ্ধতা

অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাঙালীর প্রাণের মেলা। বিশেষ করে লেখক, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও সংস্কৃতিকর্মীদের মিলনমেলা। বইমেলায় প্রাণ খুঁজে পায় বাংলা ভাষাভাষী। লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে অচ্ছেদ্য সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে। নতুন নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় মুখর হয়ে ওঠে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বর্ধিত অংশ। বইমেলা মূলত পাঠকের মেলা হওয়া উচিত। পাঠক অগণিত লেখকের মাঝে খুঁজে নেবেন তার প্রিয় লেখককে। হাজারো বইয়ের ভিড়ে খুঁজে নেবেন তার প্রিয় বইটি। পার্থক্য করতে শিখবেন ভাল-মন্দের। ভাল লেখার যেমন প্রভাব থাকে, তেমনি মন্দ লেখারও প্রভাব কিন্তু থেকেই যায়। লেখক-প্রকাশক থাক অলক্ষ্যে। পাঠক হয়ে উঠুক মুখ্য। তারা খুঁজে নিক তাদের স্বপ্ন ও সফলতার দিক-নির্দেশনা। বইমেলায় বই কিনতে হবে। বুকসেল্ফ ভরে রাখব। সৌন্দর্য বাড়ল। অথচ একটা পৃষ্ঠাও তার পড়ে দেখা হয়নি। এমন ক্রেতার খুব বেশি প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বই পড়া কিংবা বই কেনা প্রসঙ্গে অনেক প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। তবুও আমাদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠেনি। অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যথেষ্ট সময় নষ্ট হয়। এক্ষেত্রে অনেকের সহমতও রয়েছে। এসব মাধ্যমে আমরা অনেক শিক্ষণীয় বিষয় জানতে পারি। আমি স্বীকার করছি-তবে, আমরা ইতিবাচক দিকগুলোর চেয়ে নেতিবাচক দিকগুলোই গ্রহণ করি বেশি। হয়ত এমনও সময় আসবে যখন কাগজে ছাপা বই বাজারে পাওয়া যাবে না। ই-বুক আকারে তা ঘুরবে মানুষের হাতে-হাতে। শিল্পের প্রসার হোক। শিল্পের ধরন পরিবর্তন হোক। তবু শিল্প হয়েই টিকে থাকুক শিল্প। এখন হয়ত হাজার-হাজার কপি বিক্রি করে লেখক-প্রকাশকের লাভ হয়। তখন ব্লু-টুথ ও শেয়ারইটের মাধ্যমে বিনামূল্যে পৌঁছে যাবে সবার ল্যাপটপ, মোবাইল কিংবা ট্যাবে। সে যা-ই হোক, তবে আমার প্রশ্ন হচ্ছে-জাতির লাভ হবে কিসে? সে ব্যবস্থাই জরুরী। বর্তমানে প্রচুর লেখকের আনাগোনা। হাজার বিশেক টাকা হলেই একটা বই বের করা যায়। প্রকাশনীও মুখিয়ে থাকে লেখকের টাকায় বই বের করতে। বই বিক্রি হলো কিনা-এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। এছাড়া, বর্তমান ফেসবুকের কল্যাণে বইমেলার আগেই প্রচ্ছদ জাহির করে অসংখ্য লাইক-কমেন্ট পেয়ে নিজেকে আহামরি লেখক ভাবতে শুরু করেন অনেকেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এত লাইক-কমেন্ট যারা দিচ্ছেন, তাদের শতকরা দশজনও বই কিনছেন না। বস্তাপচা গল্প, উপন্যাস আর খিচুড়ি মার্কা কবিতার ছড়াছড়ি দেখে দ্বিধায় পড়ে যাই। তাই এখনও প্রকাশনা ও লেখার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এর থেকে উত্তরণ দরকার। সচেষ্ট হতে হবে লেখক ও প্রকাশকদের। প্রকাশনার মানোন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। লেখক-প্রকাশক উভয়ের আন্তরিক প্রয়াসে দেশের প্রকাশনা জগতকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে হবে। গুণীজনরা বলছেন, ‘যে বই জনপ্রিয়তার কাছে দাসত্ব করছে সে বই খারাপ। যে বই মননকে স্পর্শ করে, ঋদ্ধ করে সে বই ভাল। ফলে ভাল বইয়ের সংজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু আজেবাজে প্রকাশনার ভিড়ে ভাল বই হারিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সম্পাদনা ও পা-ুলিপি যাচাই-বাছাইসহ মানসম্পন্ন লেখকদের বই প্রকাশ ও লেখক সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সেইসঙ্গে পুস্তকের মানোন্নয়নে সরকার, লেখক-প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে।’ তবে, মানসম্পন্ন লেখা পেলেই মানোন্নয়নের প্রশ্ন আসে। আমাদের প্রকাশনা শিল্প অনেক দূর এগিয়েছে। একটু যত্নবান হলেই ভুল দূর করা সম্ভব। তাই লেখার মানের দিকে নজর দেয়া ছাড়া উপায় নেই। লেখক-প্রকাশকরা নিজেরা যদি সচেতন না হন, তাহলে বাজে বই প্রকাশ বন্ধ হবে না। তবে আশার কথা হচ্ছে-কিছু ভাল বই বের হয়। খারাপ বই নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ভাল বই যেন প্রকাশিত হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। বইমেলা এলে কোন কোন লেখক একটা রিভিউ লিখে দিতে বলেন। পান্ডুলিপির সফট কপি মেইল করেন। পড়া শেষে মনে হয়-এমনভাবে লিখি যেন পাঠক লেখককে খুঁজে-খুঁজে পেটাবে সাহিত্য নিয়ে তামাসা করার জন্য। গতানুগতিক রিভিউও কম ছাপা হয় না। সেখানে প্রচ্ছদের প্রশংসা, লেখকের ব্যক্তিগত যোগ্যতা, ক্ষমতা, দক্ষতা উঠে আসে। লেখার কতটুকু ক্ষমতা যোগ্যতা দক্ষতা আছে-তা আর আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারে না। গত বছর পর্যন্ত বইমেলার নজরুল মঞ্চে বা উদ্যান অংশে মোড়ক উন্মোচনের হিড়িক পড়ে যেত। উন্মোচনের জন্য বড় মাঝারি ও ছোট মাপের সেলিব্রেটিরাও পাঞ্জাবি-পাজামা পড়ে উপস্থিত হতেন। অথচ তিনিও হয়তো লেখকের বইটির দুটি পাতা উল্টে পড়ে দেখেননি। অথচ একগাল প্রশংসা আর সাহিত্যের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করে বইগুলো বগলদাবা করে বিদায় নিতেন। তবে এ বছর মেলা কর্তৃপক্ষ মোড়ক উন্মোচনের বদলে ‘লেখক বলছি’ কার্যক্রম শুরু করেছে। পাঠকের মুখোমুখি হবেন লেখক। নানা প্রশ্নের জবাব দেবেন। সময় পাবেন বিশ মিনিট। আশা করি উদ্যোগটি সফল এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে। আশার কথা হলো-এত-এত হতাশার মাঝেও ভাল বই আসছে। সারা বছরই আসছে। তবে হৈচৈ পড়ে বইমেলায়। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।’ কথা সত্য। কিন্তু এখন কথাটা একটু পাল্টে যাচ্ছে। এখন বলা যায়, ‘বই প্রকাশ করে কেউ কেউ দেউলিয়া হয়।’ ভাল মানের লেখক যারা; তাদের সেই ভয়টা থাকে না। ‘বইমেলা এলো, বই না এলে কেমন লেখক তুমি?’ ‘আমাকে লেখক হতে হবে-তাই বই বের করছি।’ এমন মনোভাব না রেখে ভাল লেখক হতে হবে-এর জন্য ধৈর্য ধারণ করতে হবে। বেশি-বেশি পড়ার-জানার চেষ্টা করতে হবে। কথায় আছে-‘দেশে কাক আর কবির সংখ্যা সমান।’ আমি কবিকে কখনোই কাকের সঙ্গে তুলনা করব না। কবির সংখ্যা বৃদ্ধি পাক। তাতে জাতির জন্যই মঙ্গল। জাতীয় জীবনে কিছু স্বপ্নদ্রষ্টার আবির্ভাব হবে। কিন্তু আশ্চর্য়ের বিষয় হলো-‘আকাশে উড়িয়া চলে একপাল হাতি’ মার্কা কবিতার সংখ্যাই দিন দিন বাড়ছে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দের অনুসারী দরকার। শেলি, বায়রন, কিটসের ভাবাদর্শ লালন করা জরুরী। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ নুরুল হুদা, সৈয়দ শামসুল হকরা তাদের যোগ্য উত্তরসূরি কি তৈরি করতে পেরেছেন? একজন বিদগ্ধ পাঠক হিসেবে এটা আমার ব্যক্তিগত প্রশ্ন। লেখালেখিতে বরাবরই তরুণের সংখ্যা বেশি। পরে হয়তো সে সংখ্যাটা কমে আসে। অনেকেই নানাবিধ জটিলতায় পড়ে কাব্য বা সাহিত্যচর্চার মতো জটিল বিষয়টি ধরে রাখতে পারেন না। হয়তো এই বহুসংখ্যক লেখক-কবির মধ্য থেকেই আগামীর পথপ্রদর্শক কেউ বেরিয়ে আসবেন। জাতি সেই অপেক্ষায় আয়োজন করে বইমেলার। ফসলের মাঝে কিছু আগাছা থাকে। তাই বলে তো আর ফসল ফলানো বন্ধ হবে না। আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। কবি ফকির ইলিয়াস একটি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, বছরজুড়েই বই প্রকাশিত হওয়া দরকার। ইউরোপ আমেরিকায় সেটাই হয়। তাড়াহুড়োর মাঝে ভাল বই পাঠক বাছাই করতে পারেন না। এরজন্য সময় দরকার। আলোচনাবহুল রিভিউ দরকার। মেলার এক মাসে কি সেই সুযোগ হয়? না হয় না। হয়তো কিছু ব্যবসা হয়। ব্যবসা আর পরিশুদ্ধ সাহিত্যের প্রসার কিন্তু এক নয়।’ মানোন্নয়ন সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বলেছিলেন, ‘প্রকাশনা সংস্থাগুলোয় শিক্ষিত রুচিশীল সম্পাদক নিয়োগ দিতে হবে। সারাদেশে প্রচুর ভাল লেখক রয়েছেন, তাদের খুঁজে বের করতে হবে।’ আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেছিলেন, ‘বইমেলা একটা আলতু-ফালতু বিষয়।’ জানি না তিনি কেন এ কথা বলেছিলেন। হয়তো যুক্তিযুক্ত কোন কারণও থাকতে পারে। শুধু এক মাসকে ঘিরে সাহিত্যচর্চা হবে তা নয়-সাহিত্যচর্চা সর্বকালের সর্বসময়ের। তাকে কোন গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। বা ঠিকও নয়। কিন্তু বইমেলাকে ঘিরেই আমাদের প্রকাশের প্রসব বেদনা অতিমাত্রায় ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। বইমেলা ঘিরে প্রচার-প্রচারণা চলে বছরের শুরু থেকেই। জানুয়ারি এলেই বইয়ের প্রচ্ছদে ছেয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। লেখকরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রচার চালান নিজের বইয়ের। প্রকাশকরা প্রকাশ করেই হাত গুটিয়ে থাকেন। কেননা সিংহভাগ বইয়ের প্রকাশনার খরচ জোগাতে হয় লেখককে। এটা একটা সাধারণ রীতিতে পরিণত হয়েছে। শর্ত সাপেক্ষে বইগুলো প্রকাশ করেন প্রকাশকরা। প্রকাশের পর বিক্রির ভাল-মন্দও জানা হয় না লেখকের। লাভের একাংশও আসে না লেখকের পকেটে। শুধু আত্মতৃপ্তি এই-‘আমার বই এবার বইমেলার স্টলে পাওয়া যাচ্ছে’। লেখক স্বত্ব নিয়ে আমাদের দেশের লেখকদের খুব বেশি মাথাব্যথা বা জানা শোনা আছে বলেও মনে হয় না। এক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রকাশকদের। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যতিক্রম নিয়ম রয়েছে। প্রবীণদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকের নমনীয়তা রয়েছে। যত নিয়ম-কানুন কেবল তরুণ বা নবীন লেখকদের ক্ষেত্রে। কোন কোন ক্ষেত্রে শুধু টাকার জোরেই বই আসছে মেলায়। পুরো খরচটাই বহন করেন লেখক। অতপর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ধরে-ধরে বিক্রি করা হয় সেই বই। কিংবা সৌজন্য সংখ্যা দিতেও সমস্যা নেই। এতে লেখকের প্রচার বাড়ে। প্রচারসর্বস্ব সাহিত্যকর্মের ফলে সাহিত্যের মান অবশ্যই কমছে-এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। প্রতিবছর যে হারে বই প্রকাশ হয়; সে হারে বিক্রির খবর পাওয়া যায় না। তবু কেউ কেউ স্বঘোষিত ‘বেস্ট সেলার’ তকমা নিয়ে বাসায় ফেরেন। আবার অনেককে দেখা যায় পান্ডিুলিপি তৈরি থাকা সত্ত্বেও ভাল প্রকাশক না পেয়ে বই বের করছেন না। অথবা কোনো প্রকাশক পা-ুলিপি না চাওয়ায় এ বছর বই বের হচ্ছে না। অর্থাৎ প্রকৃত লেখকের বই প্রকাশের আগ্রহের চেয়ে বইয়ের বা প্রকাশনীর মান নিয়ে বেশি ভাবতে হয়। তিনি তো আর পা-ুলিপি নিয়ে প্রকাশনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে পারেন না। বা ঘোরাটা সমীচীন নয়। তবে আশার কথা হচ্ছে- প্রতিবছরই বই বিক্রির হার বাড়ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে-তাতে কারা লাভবান হচ্ছেন? প্রকাশকরা নাকি লেখকরা? অবশ্যই প্রকাশকরা। লেখকের মধ্যে লাভের আশা বরাবরই কম থাকে। তারা প্রকাশের আনন্দ নিয়ে মাসজুড়ে দিব্যি বগল বাজিয়ে ঘুরে বেড়ান। এমনও অনেক নামকরা প্রকাশনী আছে; যারা বিক্রির শতকরা আট ভাগ লেখককে দিচ্ছেন। আর তাতেই লেখক খুশি। এ যাত্রায় বরাবরই নবীন লেখকরা বঞ্চিত হন। প্রতিষ্ঠিত লেখকরা হয় পান্ডুলিপি একেবারে বিক্রি করে দেন; নয়ত চুক্তিনামা করে রয়্যালিটি পেতে থাকেন। আবার কেউ কেউ নিজে বিনিয়োগের মাধ্যমে বই প্রকাশ করে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশন এবং রেডিওতে বিজ্ঞাপন দিয়ে আলোচনার ঝড় তোলেন। কখনও কখনও প্রসিদ্ধ কবি-লেখকের সাহচর্য লাভ করে তার সন্তুষ্টি (বিভিন্নভাবে) অর্জন করে প্রচারণার ব্যবস্থা করেন। তিনি কোন আলোচনা বা সেমিনারে শিষ্যের গুণকীর্তন করে দিলেন। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে-গত বছর যার ৬টি বই (উপন্যাস, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও অন্যান্য) বের হয়েছে; এ বছর তার ১২টি বই আলোর মুখ দেখছে। হচ্ছে বিশাল প্রকাশনা উৎসব। আলোচনা করছেন প্রথম সারির লেখক-কবিরা। অথচ তারা হয়ত ওনার ১২টি বইয়ের একটি বইও পড়ার সুযোগ পাননি। শুধু প্রচ্ছদ উল্টেপাল্টে ‘সাহসী লেখক’ উপাধী দিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করলেন। সম্মানিত প্রকাশকগণ, এক বছরে ১২টি উপন্যাস লেখার সাহস ক’জনই রাখতে পারে বলুন? শুধু আপনাদের মতো প্রকাশকের কৃপায় এক প্রকাশনী থেকেই ৪টি বই প্রকাশ হচ্ছে। বইয়ের সংখ্যা বাড়ুক আপত্তি নেই; লেখার মান কি বেড়েছে? সে ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন কি? আমরা জানি, প্রকাশকের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। বেশির ক্ষেত্রেই তো লেখকের টাকায় বগল বাজাচ্ছেন তারা। তাদের কর্তব্য শুধু পেজ সেটআপ, প্রেসে পাঠানো এবং বাঁধাই শেষে বইমেলার স্টলে তুলে দেয়া। যাবতীয় খরচ তো লেখকই দিচ্ছেন। তাই লেখকদের প্রতি আমার জোরালো দাবি, চুক্তিনামা ছাড়া কোন বই প্রকাশ করবেন না। নিজেদের অর্থায়নে বই প্রকাশ করবেন না। অপেক্ষা করুন। পত্র-পত্রিকায়, ছোটকাগজে লিখুন; প্রকাশকই আপনার কাছে পান্ডুলিপি চাইবে। আর প্রকাশকদের কাছে বিনীত আবেদন, মানবিচার না করে বই প্রকাশ করবেন না। প্রয়োজনে বিজ্ঞ লেখক-কবির সমন্বয়ে বাছাই কমিটি করে পান্ডুলিপি নির্বাচন করুন। লেখকদের সম্মানীর ব্যবস্থা করুন। তাদের রয়্যালিটি সময়মতো পৌঁছে দিন। কেননা লেখক বেঁচে থাকলে আপনার প্রকাশনী এমনিতেই টিকে থাকবে। নিজেরা লেখক সৃষ্টিতে এগিয়ে আসুন। নবীন লেখকদের মধ্যে খুঁজে নিন আগামীর নক্ষত্র। তাকে তৈরি করুন মানসম্মত উপায়ে। যেহেতু লেখকের কারণেই প্রকাশনী বিখ্যাত হয়। এও জানি-নবীনদের কাঠখড় পোড়াতে হয়। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্র পাড়ি দিয়েই তাদের এগোতে হয়। তবে প্রকাশকের বঞ্চনা তো কাম্য নয়। লেখককে বাঁচিয়ে রাখলে প্রকাশনী বাঁচবে। তাই লেখককে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নবীনদের প্রণোদনা দিতে হবে। সঠিক পরিচর্যায় আগামীতে ভাল একজন লেখকের সৃষ্টি হতে পারে। তা না হলে অকালেই ঝরে যেতে পারে সাহিত্য আকাশের উজ্জ্বল একটি নক্ষত্র। তাই লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে ভাল একটি বোঝাপড়া দরকার। হ্যাঁ, ব্যবসা আপনি করবেন। কারণ ব্যবসা করাই আপনার কাজ। তবে লেখককে বঞ্চিত করে কেন ব্যবসা করবেন? এছাড়া যেসব প্রকাশক নিজেও লেখক; তিনিও তো উপলব্ধি করতে পারেন লেখক হওয়ার যাতনা। এসব কারণের বাইরে আরও অনেক কারণ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। তাতে আলোচনা দীর্ঘায়িত হবে। আমার দাবি, টাকার বিনিময়ে যার-তার বই প্রকাশ করে তার নামের আগে লেখক তকমা জুড়ে দেবেন না। তাতে আপনার লাভ হলেও লেখক সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই প্রতিবছর চার হাজার বই নয়; মান বিচার করে এক হাজার বই প্রকাশ করুন। তাতে সাহিত্যচর্চা আরও বেগবান হবে। উটকো লেখকের চাপে মূলধারার লেখকরা কোণঠাসা হবেন না। পাশাপাশি বিজ্ঞ পাঠকও তাতে উপকৃত হবেন। তাদের বইকেনার প্রতি আগ্রহ ফিরে আসবে। নামসর্বস্ব লেখকের বই কিনে প্রতারিত হওয়ার চেয়ে সবাই মানসম্মত বই কিনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলুক। তাই বলতে চাই-পাঠকের মতো পাঠক বাড়ুক। লেখকের মতো লেখক বাড়ুক। বইয়ের মতো বই বাড়ুক। বাড়ুক ভালবাসা, বাড়ুক উচ্ছ্বসিত প্রাণ। দীর্ঘ-দীর্ঘ বছর বেঁচে থাকুক প্রিয় গ্রন্থমেলা। বেঁচে থাকুক লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের ভালবাসায়। বেঁচে থাকুক প্রাণের ছোঁয়ায়। জয়তু গ্রন্থমেলা। সাহিত্যের জয় হোক। বাংলা সাহিত্য প্রসারিত হোক।
×