ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাহফুজুল ইসলাম শামীম

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও জাতীয় আইসিটি নীতিমালা

প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

  চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও জাতীয় আইসিটি নীতিমালা

দশম মন্ত্রিসভার সর্বশেষ বৈঠকে নির্বাচনী ডামাডোলের ভেতরে অনেকটা নিঃশব্দে পাস হয়ে গেছে জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা- ২০১৮। নির্বাচনী ইশতেহারে সরকার যে ডিজিটাল বাংলাদেশ পর্ব-২ এর ঘোষণা দিয়েছে তার সুবিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এ নীতিমালায়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা; দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন; সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিতকরণ এবং সরকারী ও বেসরকারী খাতের অংশীদারিত্বে সরকারী সেবাসমূহ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোসহ ২০২১ সালের মধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে জ্ঞানভিত্তিক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এ নীতিমালাটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এবারের ইশতেহারে যেমন বলা হয়েছে প্রতিটি গ্রাম হবে শহর তেমনি বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির সকল কর্মকাণ্ডের মূলে রয়েছে গ্রামীণ জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন এবং প্রতিটি স্তরে অবারিত অভিগমনের সুযোগ। নীতিমালাটির সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারের সকল কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সেবাসমূহ সহজে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর উল্লেখ করা হয়েছে। এজন্য কারিগরি ও দক্ষ তথ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এতে ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। সকল ক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত করতে ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়গুলো এখানে উঠে এসেছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বস্তরে সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রের তথ্য প্রবাহে সার্বজনীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার ওপর তাগিদ দেয়া হয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণা কাজে তথ্যপ্রযুক্তির সফল প্রয়োগ ও পরিচর্যার মাধ্যমে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করা এবং উদ্ভাবনী কার্যক্রমকে সমর্থন ও প্রণোদনা প্রদানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ নীতিমালার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনবল গড়ে তোলা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। স্থানীয়ভাবে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিল্প স্থাপন ও সেবা প্রদানে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এক্ষেত্রে বিনিয়োগ উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্য, কৃষি, যোগাযোগ, বাণিজ্য ও আর্থিক খাতসহ সব খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং ডিজিটাল এ্যান্ট্রাপ্রেনিউরশিপ উৎসাহিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়েছে। আর সকল ক্ষেত্রেই জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট ঝুঁকি হ্রাসকল্পে আইসিটি খাতে পরিবেশবান্ধব সবুজ প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও আত্মীকরণ, ইলেক্ট্রনিক বর্জ্যরে নিরাপদ ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ মোকাবেলা এবং জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ নীতিমালার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ভবিষ্যতের ভাবনা। কেননা, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় অদৃষ্টপূর্ব প্রক্রিয়ায় পুরো বিশ্ব এখন বদলে যাচ্ছে। আমরা এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মুখোমুখি। বদলে যাচ্ছে স্থানীয় ও বৈশ্বিক বাজারের চাহিদা। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, দক্ষতাও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। এ জন্য সরকারকে বাস্তবানুগ সমস্যার সমাধানে উদ্ভাবনের সকল বাধা অপসারণ ও ইনকিউবেশন নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে পাবলিক-প্রাইভেট-একাডেমিয়ার মধ্যে শক্তিশালী সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের জীবনযাপনের সকল ক্ষেত্রে অনেক ডিসরাপশন নিয়ে এসেছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লক চেন, ডাটা, রোবেটিক্স, আইওটি, জৈব প্রযুক্তি, ন্যানো প্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বা এ ধরনের যুগান্তকারী ডিজিটাল প্রযুক্তি শিক্ষা, বাণিজ্য, সরকার ব্যবস্থাসহ সব খাতেই প্রথাগত কাঠামো ভেঙ্গে ফেলছে। এ বাস্তবতায় আইসিটি নীতিমালা কতটা মানুষের কল্যাণে বিকাশমান প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করবে এবং ভবিষ্যত প্রযুক্তির উপযোগী দক্ষ জনবল তৈরিতে ভূমিকা রাখবে তা সময়ই বলে দেবে। এ নীতিমালার দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়নকাল হিসেবে ধরা হয়েছে ২০৪১ সালকে। কিন্তু আমরা যদি ২০৪১ সালের চাহিদার সঙ্গে নিজেদের যোগ্য করতে ব্যর্থ হই তা হলে ২০৪১ সাল আমাদের বিপর্যস্ত করে ফেলবে। আজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে শিশুটি প্রবেশ করছে সে শিশুটি ২০৪১ সালে শ্রমবাজারে প্রবেশ করবে। আজকের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী যারা কর্মজীবনে প্রবেশ করছে ২০৪১ সালে তারা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে থাকবেন। আজ যারা সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করবেন তারা ২০৪১ সালে নীতিনির্ধারক হবেন। ২০২১, ২০৩০ ও ২০৪১ সালের জন্য সময়োপযোগী জাতীয় লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালার দক্ষ বাস্তবায়ন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ পরিকল্পনার মধ্যে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি লক্ষ্যগুলো সঠিক সময়ে সঠিক কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য বেসরকারী খাত, নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজসহ সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। এছাড়া ভবিষ্যতের বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে জনগণের অংশগ্রহণ, গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, দুর্নীতি হ্রাস, দারিদ্র্য দূরীকরণ, সরকারী সেবা প্রদান প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে। পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত এ নীতিমালায় একটি রূপকল্প, আটটি উদ্দেশ্য, চুয়ান্নটি কৌশলগত বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নীতিমালা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য করণীয় বিষয়সমূহকে কর্মপরিকল্পনায় লিপিবদ্ধ করে পরিশিষ্ট আকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রূপকল্প ও উদ্দেশ্যকে জাতীয় লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়েছে। কৌশলগত বিষয়বস্তুসমূহ নির্ধারণ করা হয়েছে বৃহত্তর উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিল রেখে, যার সুফল পাওয়া যাবে ডিজিটাল প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের মাধ্যমে। ১৭৬০ সালে প্রথম শিল্পবিপ্লবের সূচনা হলে উৎপাদন প্রক্রিয়ায়যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। ১৮৭০ সালে বিদ্যুতের আবিষ্কারে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের গতি ত্বরান্বিত হয়। ১৯৬০ সালে শুরু হওয়া তৃতীয় শিল্পবিপ্লব ইলেক্ট্রনিক্স এবং তথ্যপ্রযুক্তির সার্থক ব্যবহারের মাধ্যমে যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। এর ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় বহুগুণ এবং সেবা প্রদান সহজ হয়। এর পর পৃথিবীকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দেয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। সর্বাধুনিক ডিজিটাল, ফিজিক্যাল ও বাইওলজিক্যাল প্রযুক্তির সম্মিলনে বিকাশমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে মানবসভ্যতার গতিপথ আজ যুগসন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছে। বিকাশমান এসব প্রযুক্তি একদিকে যেমন মানুষের যাপিত জীবনকে বদলে দেবে, তেমনি অন্যদিকে কায়িক শ্রম চলে যাবে জাদুঘরে। কিন্তু তখন বাংলাদেশের মতো কায়িক শ্রম নির্ভর জনবহুল দেশের কী হবে! আশার কথা হলো দেশের বিরাট তরুণ জনগোষ্ঠীকে নতুন প্রযুক্তি জ্ঞানসমৃদ্ধ করে দক্ষভাবে কাজে লাগিয়ে উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা তৈরি করবে এসব প্রযুক্তি। ইতোমধ্যেই মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, পুরো দেশে ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন, ৪জির প্রবর্তন, সরকার ও শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর, বিকাশমান প্রযুক্তিতে মানব সম্পদ উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ ও রফতানির ক্ষেত্রে ডিজিটাল শিল্পের বিকাশ ও জনগণের জীবনযাপনের মান উন্নয়নে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। নতুন এ নীতিমালায় ২০২১ সালের মধ্যে একটি সেন্টার ফর ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলিউশন প্রতিষ্ঠাকরণের কথা বলা হয়েছে। অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী এ চিন্তা বাস্তবায়িত হলে কর্মসংস্থানের আসন্ন মহাবিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। নীতিমালার প্রতিটি কর্মপরিকল্পনা দেশের শিল্পের সার্বিক বিকাশ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও রফতানি আয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এর সুচারু বাস্তবায়ন। সরকারের বিদ্যমান কাঠামোয় সব বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন হবে নতুন নতুন অনেক প্রকল্প গ্রহণের। আর নতুন ইশতেহার অনুযায়ী ২০২৩ সালের মধ্যে ৭ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় করতে হলে এ খাতে সরকারকেই বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে এখনই। লেখক : চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর পলিসি এ্যান্ড প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট। [email protected]
×