ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফিরছে পরিপাটি পরিবেশ বাড়ছে পাঠকের আনাগোনা

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ফিরছে পরিপাটি পরিবেশ বাড়ছে পাঠকের আনাগোনা

মনোয়ার হোসেন ॥ সব সময় শুরুতেই সবকিছু ভাল হয় না। অনেক সময় সুন্দরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তেমনটাই ঘটছে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। বাঙালীর মননের মেলাটি ধীরলয়ে কাটিয়ে উঠছে ত্রুটি-বিচ্যুতি। সোমবার গ্রন্থমেলার চতুর্থ দিনে তেমনটাই মনে হয়েছে। আগের তিন দিনের তুলনায় এদিন কমেছে ধুলোর উৎপাত। কোথাও পড়ে থাকতে যায়নি চোখ কটমট করা বালুর স্তূপ। পুরোদমে চালু হয়েছে স্টলের নির্দেশনা সম্পর্কিত তথ্যকেন্দ্র। পাঠকরা সেখান থেকে জেনে নিচ্ছিলেন মেলার উদ্যান অংশের কোন প্রান্তে রয়েছে কাক্সিক্ষত স্টলটি। মাইকে ভেসে বেড়ানো রবীন্দ্র সুর ভালোলাগার অনুভব ছড়িয়েছে পাঠক-দর্শনার্থীর অন্তরে। দুপুর গড়ানো বিকেলে লেখক বলছি মঞ্চের সামনে বাঁশের বেঞ্চিতে বসেছিলেন পাঠকরা। কৌতূহল নিয়ে শুনেছেন প্রিয় লেখকের সাহিত্যসংক্রান্ত ভাবনা। ইতিবাচক রূপের আলিঙ্গনে এদিন দর্শনার্থীর পাশাপাশি পাঠকের সংখ্যাও ছিল বেশি। প্রকাশকরা বলছেন, ধীরে ধীরে বাড়ছে পাঠকের আনাগোনা। সেই সঙ্গে পরিচ্ছন্ন হচ্ছে পরিবেশ। তবে অনেক ভালর মাঝেও দৃষ্টিকটু লেগেছে জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভির স্টলটির সামনে ইটের স্তূপ। মেলার চতুর্থ দিনেও সম্পন্ন হয়নি উদ্যান অংশের অন্তর্ভুক্ত স্টলটির নির্মাণকাজ। বিকেলে মেলায় ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয় উৎস প্রকাশনীর প্রকাশক মোস্তফা সেলিমের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে এই প্রকাশক জনকণ্ঠকে বলেন, সবে তো মেলা শুরু হয়েছে। এখনই পাঠকের তুমুল ভিড় হবে না। তাই পাঠক আসছে না বিষয়টি এমনও নয়। ধীরে ধীরে পাঠকের পদচারণা বাড়ছে। সেই সুবাদে বইয়ের বিকিকিনিও প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়ছে। আর পাঠকের পাশাপাশি দর্শনাথীর আগমনে মেলার ¯িœগ্ধতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দর্শনার্থীদের এই আনাগোনাই জানান দিচ্ছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই জমজজমাট হবে বইমেলা। ছাড়িয়ে যাবে বই বিকিকিনির পুরনো রেকর্ড। আশাবাদের সঙ্গে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার আক্ষেপ ছিল কাকলী প্রকাশনীর প্রকাশক নাছির আহমেদ সেলিমের কণ্ঠে। বলেন এখন মেলার সূচনালগ্ন। সেই বিবেচনায় পাঠকের আসা শুরু হয়েছে। আগামী শুক্রবার থেকে ক্রমশ বাড়তে থাকবে পাঠকের আগমন। মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির প্রতি অভিযোগ প্রকাশ করে এই প্রকাশক বলেন, কথা ছিল মেলার প্রবেশপথ টিএসসিতে একটি নান্দনিক দরজা থাকবে। অথচ চতুর্থ দিনে এসেও তোরণসদৃশ সেই দরজাটি তৈরি হয়নি। এর ফলে মেলাটি যথার্থভাবে পাঠকবান্ধব হয়ে উঠছে না। এছাড়া এখনও উদ্যান অংশের কিছু স্থানে ইটের রাস্তার তৈরির কাজটি সম্পন্ন হয়নি। বিকেলে শান্ত পরিবেশের ছিমছাম মেলায় বিভিন্ন বই বিতানে ঢুঁ দিচ্ছিলেন অধ্যাপক ড. রওনক জাহান। নেড়েচেড়ে পছন্দসহ বইটি সংগ্রহ করছিলেন আপন মনে। একগুচ্ছ বই নিয়ে চলার পথে কথা হয় তার সঙ্গে। বলেন, প্রথমদিকে মেলায় আসার সুবিধা হচ্ছে ভিড়ভাট্টা কম থাকে। স্বাচ্ছন্দ্যে পছন্দসই বই দেখার সুযোগ থাকে। তাই বই কিনতে গিয়ে ঝক্কি পোহাতে হয় না। সেই সুযোগটি কাজে লাগাতেই এই সময় মেলায় এসেছি। পরবর্তীতে মেলায় ভিড় বেড়ে গেলে অনেক সময় স্টলে প্রবেশ করাই কঠিন হয়ে যায়। সংখ্যায় কম হলেও রওনক জাহানের মতো অনেকেই ছিমছাম পরিবেশে বই সংগ্রহের সুযোগটি লুফে নিচ্ছেন। চতুর্থ দিনের মেলায় ‘লেখক বলছি’ মঞ্চের আয়োজনটি ছিল পাঠকের জন্য প্রাণবন্ত। এদিন নিজের লেখা ও লেখক জীবনে নিয়ে কথা বলেন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার। আলাপচারিতায় এই লেখক বলেন, একজন লেখক যখন মনে করবেন যে নিজের সেরা লেখা বা মাস্টারপিসটি লিখে ফেলেছেন, তখনই লেখক হিসেবে তার মৃত্যু ঘটবে। প্রকৃত লেখকের কাজটি নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখে যাওয়া। শুধু তাই নয়, লেখার সময় তাকে ভুলে যেতে হবে পুরনো লেখার কথা। আগের লেখাকে মাথা থেকে পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে হবে। নইলে লেখকের লেখায় শুধু পুনরাবৃত্তি ঘটবে, নতুন সৃষ্টি বলে কিছু হবে না। একইভাবে চাইলেও ধ্রুপদী বা কালজয়ী সাহিত্য লেখা সম্ভব না। একটা লেখা তখনই ধ্রুপদী হয়, যখন তা বিষয়ের সঙ্গে সময়, কাল ও পাত্রকে সমকালের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে লেখা হয়। চতুর্থ দিনে লেখক মঞ্চে আরও কথা বলেন গিরীশ গৌরিক, তিথি আফরোজ, নাসিমা আনিস ও বিধান রিবেরু। নির্বাচিত বইকথন ॥ একুশে বইমেলায় প্রতিদিন বেরোয় শত শত বই। তবে এই শত বইয়ের মাঝে উৎকর্ষগতভাবে মানসম্মত বইয়ের সংখ্যা থাকে অল্প। বিষয় বৈচিত্র্য ও উন্নত রচনাশৈলীর তেমন কিছু নির্বাচিত বইয়ের তথ্য তুলো ধরা হলো। সময় প্রকাশন থেকে এসেছে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত রচিত গ্রন্থ ‘আমার সিলেট’। বইয়ের তিনটি প্রবন্ধে সংযুক্ত হয়েছে সিলেটের তিন কৃতী সন্তানের জীবনের নানা কথা। বাউলসাধক আবদুল করিম শাহ লেখকের খুব ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তাকে নিয়ে আছে একটি বড় প্রবন্ধ। সুসাহিত্যিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন গুরুজনসম এবং শৈশব থেকেই লেখকের পরিচিত। সিলেটের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, প্রথমে ছাত্রনেতা পরে আওয়ামী লীড় নেতা এবং জাতি গঠনে একজন শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিত্ব আবদুস সামাদ আজাদকে নিয়ে আছে আরেকটি প্রবন্ধ। এছাড়া তিনটি বিষয় নিয়ে আছে আরও তিনটি বিশেষ প্রবন্ধ। সেগুলো হলো সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ এবং সিলেটের আঞ্চলিক ইতিহাস। যারা রম্য রচনা বা জোকস পড়তে পছন্ত বরেন তাদের জন্য এসেছে আহসান হাবীবের ‘১০০ রম্য’ শীর্ষক রম্যগ্রন্থ। অনুপম প্রকাশনী থেকে বেরুনো সংকলটিতে ঠাঁই পেয়েছে ১০০টি রম্য রটনা। মূলত রম্য গল্প প্রাধান্য পেয়েছে বইটিতে। সব মিলিয়ে পাঠকের জন্য রম্য গল্প ও রম্য রচনার ভিন্ন স্বাদ মেলে ধরেছে বইটি। শিবশঙ্কর নামের একজন অধ্যাপককে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে হরিশংকর জলদাস রচিত ‘প্রস্থানের আগে’ শীর্ষক উপন্যাসের কাহিনী। অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটিতে কেবল ব্যক্তিজীবনের শুধু উপাখ্যান নয়, সেই সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে একটা সামগ্রিক কাল এবং কৈবর্তসমাজের কাহিনীও। এই উপন্যাসের পটভূমি গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃত। পতিতাপল্লী, বৈষ্ণব আখড়া, রাতের শহর, স্বামীলাঞ্ছিত মৃত্তিকা, স্খলিত মঙ্গলÑএ উপন্যাসের অনুষঙ্গ ও কুশীলব। শিশুদের প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। পার্ল পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে এই লেখকের শিশুতোষ গ্রন্থ ‘মানুষের ছোট বাচ্চা’। সহজ ও সাবলীল ভাষায় রচিত গ্রন্থটিতে শিশুদের সঙ্গে সমান্তরালে উঠে এসেছে বনের পশুপাখির গল্প। নতুন বই ॥ বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্যানুযায়ী সোমবার মেলায় মেলায় প্রকাশিত হয়েছে ১৪১টি নতুন বই। প্রকাশিত হয়েছে তরুণ লেখক পায়েলের ভ্রমণকাহিনী ‘সুবর্ণগ্রাম থেকে সুবর্ণভূমি’। প্রকাশ করেছে ঠিকানা গ্রুপ অব পাবলিকেশন্স এ্যান্ড মিডিয়া। বইটি পাওয়া যাবে মেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে লিটলম্যাগ চত্বর ২৫ নং ‘পরাগ’স্টলে। মাওলা ব্রাদার্স থেকে এসেছে শাহাদুজ্জামানের ‘গুগলগুরু’। হক ফারুক আহমেদের কাব্যগ্রন্থ ‘নিঃসঙ্গতার পাখিরা’ প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ। সাদাত হোসাইনের ‘নির্বাসন’ এনেছে অন্যধারা। আয়মান সাদিক ও সাদমান সাদিকের ‘স্টুডেন্ট হ্যাকস’ বের করেছে অধ্যয়ন। আয়মান সাদিক ও অন্তিক মাহমুদের ‘ভাল্লাগে না’ এনেছে আদর্শ। সোলায়মান সুখনের ‘মস্তিষ্কের ক্যানভাস’ প্রকাশ করেছে অধ্যয়ন। অনুপম থেকে বেরিয়েছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘যখন টুনটুনি তখন ছোটাচ্চু’। কিঙ্কর আহসানের ‘বিবিয়ানা’ প্রকাশ করেছে অন্বেষা। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি’ বেরিয়েছে বাতিঘর প্রকাশনী থেকে। নিশো আল মামুনের ‘সুখের গহিনে শোক’ প্রকাশ করেছে ইতি প্রকাশন। তাহমিদ রাফির ‘প্রোগ্রামিং এক্সারসাইজ’ বেরিয়েছে দ্বিমিক প্রকাশনী থেকে। মেলামঞ্চের আয়োজন ॥ সোমবার মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গবন্ধু উপাধি অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী’ শীর্ষক আলোচনাসভা। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নূহ-উল-আলম লেনিন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন অর রশিদ, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সুভাষ সিংহ রায়। সভাপতিত্ব করেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন মাকিদ হায়দার এবং ইকবাল আজিজ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাহমুদা আখতার। সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী ফাতেমা-তুজ-জোহরা, খায়রুল আনাম শাকিল, ইয়াকুব আলী খান, লীনা তাপসী খান এবং ক্যামেলিয়া সিদ্দিকা। আজকের আয়োজন ॥ আজ মঙ্গলবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার পঞ্চম দিন। মেলা চলবে বেলা তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত। বিকেল চারটায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘কবি সিকান্দার আবু জাফর : জন্মশতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন কবি নাসির আহমেদ। আলোচনায় অংশ নেবেন রফিকউল্লাহ খান, শিরীন আখতার এবং বায়তুল্লাহ কাদেরী। সভাপতিত্ব করবেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, কবিতা-আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
×