বইমেলার আলাদা টান অনুভব করেন তারাই যারা ভালবাসেন বই, পাঠাভ্যাস যাদের কাছে নেশার মতো এবং বই যে আনন্দ আর জ্ঞানের উৎস- এই কথাটি যারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি জুড়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলা জাতীয় পর্যায়ে এক অনন্য আয়োজন। এই মেলা আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবে অভিষিক্ত হয়েছে বর্তমান সরকারের উদ্যোগ গ্রহণের ফলে। অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনীতে ভাষা সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতির চর্চা বেগবান করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বাঙালীর ভাষা শিল্প সংস্কৃতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার তাগিদও দেন বারবার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কেবল একজন একনিষ্ঠ পাঠক নন, তিনি লেখকও। ক্ষমতায় থাকার কারণে তাঁর পক্ষে আগের মতো যে বইমেলায় আসা হয় না, মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানো হয় না- এটি তাঁর জন্যে কষ্ট ও আক্ষেপের। কারণ তিনি মেলায় এলে তার নিরাপত্তার কারণে যে ব্যবস্থা অনুসৃত হবে তাতে বইমেলায় আগতরা একটু অসুবিধায় পড়বেন। মানুষের ঝামেলার কথা ভেবেই তিনি আর বইমেলায় আসেন না, যদিও মন তার পড়ে থাকে বইয়েরই সাম্রাজ্যে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির এই যুগে মুদ্রিত বই কি হারিয়ে যাবে? এমন প্রশ্ন পুরনো। মেলার উদ্বোধনী আসরে নতুন করে প্রসঙ্গটি সামনে এলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যতই আমরা যান্ত্রিক হই না কেন, বইয়ের চাহিদা কখনও শেষ হবে না। নতুন বইয়ের মলাট, বই শেলফে সাজিয়ে রাখা, বইয়ের পাতা উল্টে পড়ার মধ্যে যে আনন্দ আছে, আমরা সবসময় তা পেতে চাই। তবে একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সব বই অনলাইনে দেয়া এবং ডিজিটাল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার ওপরও জোর দেন প্রধানমন্ত্রী।
দিন দিন বইমেলায় পাঠক বাড়ছে। শুধু বইমেলা এলেই বই প্রকাশ করতে হবে এটা ঠিক নয়। সারাবছর গুণগত মানের বই প্রকাশ করা দরকার। পাঠকের কাছে ভাল মানের বই পৌঁছে দিতে হবে। বইয়ের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করতে ও বই বিক্রি বাড়াতে দেশব্যাপী গ্রন্থাগার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সবার কাছে বই পৌঁছে দিতে বইয়ের সামষ্টিক সংরক্ষণাগার দরকার। গ্রন্থাগার আন্দোলনকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে পারলেই আমাদের স্বপ্ন সার্থক হবে। গ্রন্থমেলা পাঠক সৃষ্টি করতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। আমরা আক্ষেপ করে বলে থাকি, বাংলা সাহিত্যের অন্তত পাঁচ-সাতজন নোবেল পেতেন যদি ভাল ইংরেজী অনুবাদ হতো। ১৯২৫ সালে জর্জ বার্নার্ড শ নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পান। তিনি সেই অর্থ ব্যক্তিগতভাবে খরচ করেননি। ওই টাকায় এ্যাংলো সুইডিশ লিটারারি ফাউন্ডেশন গঠন করেন। সেই সমিতির উদ্দেশ্য ছিল সুইডিশ সাহিত্যের ভাল ভাল বই ইংরেজীতে অনুবাদ করা। বাংলা একাডেমি অনুবাদ সাহিত্যের দিকে আরও মনোযোগী হোক, এটাই প্রত্যাশা। ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলায় গিয়ে প্রকাশনা শিল্পের নেতৃবৃন্দ অনুধাবনে সক্ষম হয়েছেন বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। পৃথিবীর বইমেলায় বাংলাদেশকে ‘থিম কান্ট্রি’র মর্যাদা পেতে হবে। তার জন্য দরকার বাংলা সাহিত্যের বড় বড় সৃষ্টিগুলো ইংরেজীতে অনুবাদ করে বিশ্বসভায় উপস্থাপন করা।
জ্ঞানই যদি মুক্তি হয় তাহলে জ্ঞানার্জনের সর্বোত্তম মাধ্যম গ্রন্থ মানুষের মুক্তির দিশারী। আর এই লক্ষ্যমাত্রা নিয়েই প্রতিবছর নতুন বইয়ের বিরাট আয়োজনে গ্রন্থমেলার যে উৎসবমুখর আবেদন সেটাই দর্শনার্থীদের বিভিন্নভাবে আকৃষ্ট করে। মুখরিত এই বর্ণাঢ্য আবহে দর্শকরা নিজেদের একাত্ম করে নেয়। যা নতুন বইয়ের প্রতি আগ্রহ আর আকাক্সক্ষায় পুরো পরিবেশকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। বই হয়ে ওঠে আরও গ্রহণযোগ্য, পাঠের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এবং প্রয়োজনীয় সম্পদ। বিশ্বসভায় বাঙালীর বই আলো ছড়াক- এটাই প্রত্যাশা।
শীর্ষ সংবাদ: