ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাট থেকে পলিথিন ব্যাগ

প্রকাশিত: ১১:৫৪, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

পাট থেকে পলিথিন ব্যাগ

প্লাস্টিকের কোন উপকরণ ছাড়াই পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব পলিথিন ব্যাগ। এটি বাজারে প্রচলিত পলি ব্যাগের মতোই, তবে পচনশীল। পাট থেকে পলিথিন ব্যাগ উদ্ভাবন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড. মোবারক আহমদ খান। তিনি এই ব্যাগের নাম দিয়েছেন ‘সোনালি ব্যাগ’। পাট কলে ফেলে দেয়া পাটের আঁশ থেকে প্রথমে সূক্ষ্ম সেলুলোজ আহরণ (এক্সট্রাকশন) করে আলাদা করে নেয়া হয়। পানিতে অদ্রবণীয় এই সেলুলোজ কে পরে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে পরিবর্তন (মডিফিকেশন) করা হয়। দ্রবণীয় সেলুলোজের সঙ্গে ক্রসলিঙ্কার মেশানো হয়। বিশেষ তাপ মাত্রায় রাসায়নিক বিক্রিয়ায় দ্রবণটি ড্রায়ার মেশিনের ভেতরে পরিচালিত হয়। তাতে তা শুকিয়ে প্লাস্টিকের শিটের আকারে যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসে। পরে শিট কেটে চাহিদা মতো পলি ব্যাগের আকার দেয়া হয়। তা থেকেই তৈরি হয় ব্যাগ। প্রচলিত পলিথিনের তৈরি ব্যাগের চেয়ে অধিক কার্যকর। এ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করার পর ফেলে দিলে সহজেই মাটির সঙ্গে মিশে যায়। উপরন্তু তা মাটিতে সারের কাজ করে। সহজলভ্য উপাদান এবং সাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি এ পলিথিন ব্যাগ বিদেশে রফতানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ সোনালি ব্যাগ আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রাথমিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে দৈনিক ৩ টন। সরকারীভাবে এ ব্যাগ উৎপাদন হলেও বাণিজ্যিকভাবে এর উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। পাট কলগুলোতেই এর উৎপাদন হতে পারে। তাছাড়া যে কেউ ক্ষুদ্র পরিসরে এর কারখানা স্থাপন করতে পারে। স্বল্প পরিমাণে সোনালি ব্যাগ উৎপাদিত হওয়ায় এর বিপণন এখনও সীমিত। প্রতি ব্যাগের দাম ৩ থেকে ৪ টাকা। অধিক পরিমাণ উৎপাদিত হলে দাম প্রতিটি ৫০ পয়সায় নামিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন অনেকে। যে পলিথিন ব্যাগ আমরা বাজারে দেখতে পাই, তার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু“হয় ১৯৮২ সালে। কিন্তু যে ইথাইলিন (মলিকিউলাস) থেকে পলিথিন বা পলিথাইলিন উৎপাদিত হয় তা পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক। এ পলিথিন ব্যাগ কোনভাবেই এমন কি পুড়িয়ে ও ধ্বংস করা যায় না। ফলে জমিতে, পানিতে, ড্রেনে যেখানেই ফেলা হোক না কেন, তা অক্ষত থাকে । বিশেষজ্ঞদের মতে , জমিতে এই পলিথিন ব্যাগ পড়ার কারণে জমির ফসল উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। নদ নদী ও জলাশায়ে পতিত হওয়ার ফলে সেগুলোর বুক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর জলা বদ্ধতার যে সঙ্কট, তার পেছনেও রয়েছে এই পলিথিন ব্যাগ। তা ড্রেনে পড়ে তার পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা অকর্যকর করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে তোলার পেছনে এর বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। ভূমিকল্প, বজ্রপাত, আট্রাভায়োলেট রেডিয়েশন ইত্যাদির জন্যও এই পলিথিনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। পলিথিন বা পলিথিনব্যাগের এই পরিবেশ বিপর্যয় কর নানামুখী প্রতিক্রিয়ার কারণে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। পরিবেশ আন্দোলনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু ঢাকা শহরেরই প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। এ শহরের জলাবদ্ধতার জন্য ৮০ শতাংশ দায়ী এই পলিথিন ব্যাগ। এমতাবস্থায়, সোনালি ব্যাগ সবচেয়ে উপযুক্ত বিকল্প হতে পারে। একদিকে প্রচলিত পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজার জাতকরণ ও ব্যবহার স্টপ করতে হবে অন্য দিকে সোনালি ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদন, বাজার জাতকরণ ও ব্যবহার জনপ্রিয় করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে পরিবেশ ঘাতক পলিথিন ব্যাগের ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হতে পারে। পাটের তৈরি পলিমারে ব্যাগ সাধারণ পলি ব্যাগের চেয়ে দেড়গুণ টেকসই ও মজবুত। মাটি চাপা পড়লে পাট পলি ব্যাগ চার থেকে পাঁচ মাস পর পচে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে শুরু“করে। পানি নিরোধক এই পলি ব্যাগ দামে ও খুব একটা বেশি নয়। এক কেজি পলিথিন ব্যাগের বাজার মূল্য যেখানে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, সেখানে এককেজি পচনশীল পাটের পলিব্যাগের দাম পড়বে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের পর বাজারে এলে আরও দাম কমবে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘পলিথিন ব্যাগ’ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যের ফুটামুরা কেমিক্যালের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করেছে বাংলাদেশ সরকার। কাঁচা পাট ও বহুমুখী পাটজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করা, পাটজাত পণ্য রফতানি , অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বাড়ানো ও পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন বর্জনের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে পলিথিনের মতো পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ বাজারে আনা হচ্ছে। এমওইউ অনুযায়ী ফুটামুরা কেমিক্যাল কোম্পানি সোনালি ব্যাগ উৎপাদনে সব ধরনের কারিগরি সহায়তা দেবে। তবে পাট থেকে সেলুলোজ উৎপাদনের মাধ্যমে সোনালি ব্যাগ প্রস্তত ও বাজারজাতের কাজটি করবে বিজেএমসি।
×