ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কম্পিউটারে ও মাতৃভাষায় মোস্তাফা জব্বার

প্রকাশিত: ১১:১১, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

কম্পিউটারে ও মাতৃভাষায় মোস্তাফা জব্বার

কম্পিউটারে বাংলা ভাষার ব্যবহার আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি যুগের সবচেয়ে সফল উদ্যোগ। যদিও নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের অনেক অর্জন এখন বিশ্বসভার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। দুনিয়ার নানা প্রান্তে অন্তত ২৫ কোটি বাংলাভাষী মানুষের শতকরা ৩০ ভাগও যদি কম্পিউটারে ও মোবাইল ফোনে দাফতরিক বা দৈনন্দিন কাজের জন্য বাংলা ব্যবহার করে তাহলে তার সংখ্যা দাঁড়ায় ৭-৮ কোটি। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বিশেষ করে যেই দেশ ভাষার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছে, সংগ্রামে-আন্দোলনে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যেই দেশের আন্দোলনের ফলশ্রুতি এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ যা আমাদের দেশের সম্মানে বিশ্বব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়ে থাকে। ২০০৩ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে জেনেভায় যখন বিশ্ব তথ্য সমাজের শীর্ষ সম্মেলন হয় সেখানে ঘোষণাপত্রের অন্যতম অংশ ছিল দেশে দেশে ভাষার বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখা, যাতে তথ্যপ্রযুক্তির ক্রম উন্নয়নের ফলেও কোন ভাষা তার স্বকীয়তা না হারায় (জাতিসংঘের জেনেভা ঘোষণাপত্র সি.৮)। এই ঘোষণাপত্রে সদস্য রাষ্ট্রগুলো সম্মত হয় যে, দেশগুলো নিজেদের ভাষা ও যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত কম্পিউটার সফটওয়্যারের জন্য নানারকম গবেষণা কাজের উদ্যোগ নেবে, বিশেষ কোন বর্ণ বা অক্ষর বিন্যাস, এমনকি যে কোন পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ভাষার কোড, ইলেকট্রনিক অভিধান, শব্দার্থ, ব্যাখ্যা বা নিজেদের ভাষায় ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন পর্যন্ত করে নিতে পারবে, যাতে অন্য কোন ভাষা বা দেশ কখনই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না (জেনেভা ঘোষণাপত্র সি.৮.১৫)। বাংলাদেশের জন্য আনন্দের ও গর্বের বিষয় যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর যা ১৯৪৮ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল, এ দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগ ও আবেগ বাংলাদেশের মানুষের জন্য ছিল একটি অন্যতম প্রেরণা। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়ন চিন্তায় মাতৃভাষা সংযুক্ত করে নেয়ার প্রয়াসও শুরু হয় সে প্রেরণা থেকেই। ১৯৬৫ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী তার অহ Illustrated Brochure on Bengali Typewriter– রচনায় বাংলা ভাষাকে প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে উদ্যোগী হন। তার উদ্ভাবিত কী বোর্ড ‘অপটিমা মুনীর কী বোর্ড’ নামে সমধিক পরিচিত। এই কথা বলাই বাহুল্য যে, মুনীর চৌধুরী যদি তখন এই উদ্যোগ না নিতেন তাহলে হয়ত পাকিস্তান সরকারের ভৌতিক চিন্তা অনুযায়ী রোমান হরফে বাংলা লেখা চালু হতো আর তার ফলে আজ আমাদের ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় কী দশা হতো তা সহজেই অনুমেয়। সবচেয়ে বড় কথা প্রযুক্তি যখন ভাষা চর্চাকে ধারণ করে তখন সঙ্গত কারণেই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশি। ষাটের দশকে আমরা অনুমান না করতে পারলেও প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান যুগে তা বাস্তব সত্য। তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে এখন আমরা অলীক মনে করলেও আজ এটা ধ্রুব সত্য যে, কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনে ক্রমাগত নিজের ভাষা ব্যবহার করে আমরা এখন যে পর্যায়ে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে পারছি তা ঐতিহাসিক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফসল হিসেবে সে ইতিহাসকে চোখের সামনে এনে দেখতে আমরা বিশেষভাবে গর্ববোধ করি। সেরকম গর্ব আমাদের বাংলা বর্ণলিপি নিয়েও। ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনায় না গিয়েও খুব সহজে বলা যায় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সদস্য হয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে এসে বাংলা লিপি এখনও যথেষ্ট প্রতাপের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক ভাষায় প্রভুত্ব বজায় রেখেছে। এখনও বাংলা লিপির লিখন পদ্ধতি ব্যবহার হয় প্রধানতঃ বাংলা, মণিপুরি, ককবরক ও অসমীয়া ভাষায়। আমরা অনেকেই হয়ত জানি না যে, বাংলা লিপি বিশ্বের ৫ম সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত লিখন পদ্ধতি। ফলে মুনীর চৌধুরী বুঝে-শুনেই সেই ঐতিহাসিক কাজে হাত দিয়েছিলেন। যার ফলে প্রযুক্তি জগতে বাংলা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের মুখ্য ভাষা হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে আন্তর্জাতিক সম্মানের অধিকারী হয়েছে। এই সকল অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসপরম্পরা বিবেচনায় নিয়ে অপটিমা মুনীর কী বোর্ড তৈরির ২৩ বছর পরে মুনীর চৌধুরীর সুযোগ্য ছাত্র মোস্তাফা জব্বার কম্পিউটারে লিখবার জন্য ‘বিজয় কী বোর্ড’-এর সূচনা করেন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৮৮ সালে। যদিও ১৯৮৭ সালে তিনি প্রথম ‘জব্বার কী বোর্ড’ নামে একটি কী বোর্ড তৈরি করেন মুনীর চৌধুরীকে অনুসরণ করেই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষার্থী হিসেবে মোস্তাফা জব্বারও ভিত্তি মূলে অনুসরণ করেন তার শিক্ষকের কৌশল। যার ফলে একই লে-আউট তিনি রূপান্তর করেন মূলত একটি সফটওয়্যার হিসেবে, যা প্রধানত গ্রাফিক্যাল লে-আউট পরিবর্তকের কাজ করত। পরবর্তী সময়ে মোস্তাফা জব্বার ইউনিকোডভিত্তিক বিজয় কী বোর্ড প্রবর্তন করে বাংলায় বিজ্ঞানসম্মত কম্পিউটার ব্যবহার নিশ্চিত করেন। মুনীর চৌধুরীর কাছে সেই ঋণ তিনি স্বীকার করেন এভাবে- ‘আমি যদি মুনীর কী-বোর্ড অধ্যয়ন না করতাম, যদি আমি তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রয়াসকে অনুভব করতে না পারতাম, তবে বিজয় কী-বোর্ডের জন্ম হতো না। বিশ্বের সব বাংলা ভাষাভাষীর মতো আমিও এই মহামানবের কাছে ঋণী’ (প্রথম আলো, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২)। বাংলায় কম্পিউটার ব্যবহার জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে মোস্তাফা জব্বারের ভূমিকা ঐতিহাসিক। যে কোন নতুন নির্মাণে যেসব আলোচনা-বিতর্ক হয় বিজয় কী বোর্ড নিয়ে যে তা হয়নি সে রকম নয়, কিন্তু আমাদের দেখতে হবে এর বিজ্ঞানসম্মত নির্মাণ কৌশল ও ব্যবহার। সর্বোপরি দেখতে হবে বাংলা ভাষা চর্চায় তথ্যপ্রযুক্তির যে সীমাহীন ব্যবহার ঘটেছে তাতে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, ভাষা-সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে ও সংবেদনশীল বাঙালী মানুষ হিসেবে যখন কারও কাছে কোন দায়িত্ব আপনা থেকেই এসে পড়ে তার যথাযথ সম্মানের দায়িত্ব মোস্তাফা জব্বার পালন করেছেন কি-না। এ কথা অস্বীকার করার কোনই উপায় নেই যে, মোস্তাফা জব্বার তা করেছেন ও তার বিনিময় সম্মান আমাদের ভাষার ইতিহাসের অংশ। বিজয় কী বোর্ড ইউনিকোডের অন্তর্ভুক্তির অনেক আগে থেকেই বাংলায় কম্পিউটার ব্যবহারের শুরু হয় মূলত মোস্তাফা জব্বারের কী বোর্ড ব্যবহার করেই। যখন সারা দুনিয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি বৈষম্য নিয়ে আলোচনা শুরু“হয়নি তখন বাংলাদেশের মুদ্রণ শিল্পে মোস্তাফা জব্বার একটি পরিবর্তনের সূচনা করেন। লাইনো টাইপ ও ফটো কম্পোজের ব্যয়বহুল অফসেট মুদ্রণ পদ্ধতিতে এক ব্যাপক পরিবর্তন আসে কম্পিউটারে লিখন ও ট্রেসিং পেপারে প্লেট তৈরির কৌশল থেকে। ব্রিটিশ ভারতে স্যার চার্লস উইলকিন্স যিনি ছেনি দিয়ে কেটে হরফ তৈরির কৌশল শিখিয়েছিলেন হুগলীর ত্রিবেণী গ্রামের অধিবাসী বাঙালী খোদাই শিল্পী পঞ্চানন কর্মকারকে, যিনি ঢালাই করা চলনশীল ধাতব হরফ তৈরির কাজ রপ্ত করে বাংলা মুদ্রণ শিল্পে সে সময় এক ঐতিহাসিক অবদান রাখেন। এই পঞ্চানন কর্মকারের পরে মোস্তাফা জব্বারই সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের অবদান রাখেন আধুনিক মুদ্রণ শিল্পের হরফ বিন্যাসে, যা সংযোজিত হয় কম্পিউটার প্রযুক্তিতে। সে সময় মোস্তাফা জব্বারের ব্যবসায়িক উদ্যোগ রঙিন মনিটরসহ এ্যাপল ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটার, লেজার প্রিন্টারের বিপণনও একটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। এর ফলে শুরু হয় ডেস্কটপ কম্পিউটারে জীবিকা নির্বাহের এক নতুন উদ্যম। ঢাকা শহরের নীলক্ষেত ও আরামবাগে শত শত স্বল্পশিক্ষিত অল্প পুঁজির যুবক শ্রেণী ফটোসেট, ইলাস্ট্রেটর, পেজমেকারের কাজ শুরু করে দেশে একটি নীরব তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের জন্ম দেয়। ডিজিটাল ডিভাইড সঙ্কোচন নিয়ে যারা গবেষণা করেন এই বিষয়গুলো তাদের অবশ্যই বিবেচনা করে নিতে হবে। ২০০০ সালে জি-৮ সামিটের ওকিনাওয়া ঘোষণাপত্রের আলোকে যখন দেশে দেশে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বজনীন ব্যবহার ও দারিদ্র্য মোচনে এর ব্যবহার এবং ভূমিকা নিয়ে ডিজিটাল অপরচুনিটি টাস্ক ফোর্সের (ডট ফোর্স) কাজ শুরু হয় তখন বাংলাদেশের এসব উদ্যোগ আলোচনায় সামনে আসে। সঙ্গত কারণেই আমরা দেখি কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহার, হরফের উৎকর্ষশৈলী, প্রকাশনা শিল্পের যুগোপযোগী আধুনিকীকরণ, কম্পিউটার উপকরণের যুতসই ব্যবহারের প্রণোদনা দানে মোস্তাফা জব্বারের সুদীর্ঘ কর্মজীবনের অবদানের সঙ্গে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের ও ব্যবহারে জনসম্পৃক্তির মৌলিক আলোচনার এক গভীর যোগসূত্র আছে। নানা তত্ত্বে এই বিষয়টি এখনও আমাদের অগোচরে রয়ে গেছে। আমরা যদি এই অর্জন কেবল তথ্যপ্রযুক্তি উপকরণের ব্যবসায়িক সূত্রে মিলিয়ে দেখি তাহলে ভুল হবে। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের উন্নয়ন চিন্তা- যা সফলভাবে প্রতিভাত হয়েছে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্পে। মোস্তাফা জব্বারের অবদান সেখানে আধুনিক পথিকৃতের ইতিহাস তা নির্ধারণ করেই রেখেছে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×