ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাণিজ্যমেলা ফুটপাথের মানে নেমে এসেছে

প্রকাশিত: ১০:২৮, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাণিজ্যমেলা ফুটপাথের মানে নেমে এসেছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ২২ দেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ৯ জানুয়ারি শুরু হয়েছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা। কিন্তু এই মেলার অব্যবস্থাপনা দেখে দর্শনার্থীর অনেকেই এটিকে নামে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা মনে করছেন। কিন্তু হকারদের মতো হাকডাকে বাস্তবে এটি ফুটপাতের বাজারে পরিণত হয়েছে। নগরীর ফুটপাতের মতো মেলা প্রাঙ্গণের রাস্তাগুলোতেও বসেছে হকারের পসরা। ‘বাইছ্যা লন, দেইখ্যা লন’; ‘একদাম ১০০’; ‘মাত্র ৫০০’ এমন ডাক মেলা প্রাঙ্গণের নিত্য চেহারা। কেবল অবৈধভাবে বসা স্টলের সামনের দোকানগুলোই নয়, ক্রেতা আকর্ষণের এমন আহ্বান আসছে নামীদামী স্টলগুলো থেকেও। আবার বিদেশী প্যাভিলিয়নগুলোর পণ্যের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বিদেশী প্যাভিলিয়নের বহুস্টলে দেশী পণ্য বিক্রি হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এরইমধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও মেলা কর্তৃপক্ষ। এদিকে, রফতানি বাড়ানোই মেলার প্রধান লক্ষ্য হলেও নেই কোন বিদেশী ক্রেতা। বিক্রেতা ও উদ্যোক্তারা বলছেন, মেলা প্রায় শেষ হতে চললেও বিদেশী কোন ক্রেতা চোখে পড়েনি। আবার মেলা থেকে এখন তেমন কোন রফতানি আদেশ আসে না। বৃহৎ পরিসরের এই মেলায় নেই কোন সভা-সেমিনারের আয়োজনও। আন্তর্জাতিক মেলায় দেশীয় বিভিন্ন পণ্য তুলে ধরতে এ ব্যবস্থা না থাকায় প্রশ্ন তুলেছেন কোন কোন দর্শণার্থী। বাণিজ্যমেলা এখন শেষ লগ্নে। সামনে ছুটির দিন রয়েছে আর দুটি। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি মেলা শেষ হওয়ার কথা। ফলে শেষদিকে মেলা প্রাঙ্গণে বেড়েছে হকারের উৎপাতও। প্রতিটি প্যাভিলিয়ন আর স্টলে সামনে সাজিয়ে বসেছে বাহারি পণ্যের পসরা। এতে ছোট হয়ে এসেছে দর্শনার্থীদের চলাচলের জন্য প্রশস্ত রাস্তাগুলোও। হাজী বস্ত্র বিতান নামের একটি স্টলের সামনের রাস্তায় শীত সামগ্রী বিক্রি করছিলেন মোঃ রাসেল। ডেকে ডেকে পণ্য বিক্রির কারণ জানতে চাইলে দোকানটির কর্মচারী রাসেল বলেন, ‘ভাই এবার লস খেয়ে গেছি। তাই ডেকে পণ্য বিক্রি করছি। নয়ত এত কষ্ট করে কে?’ অন্য একটি প্যাভিলিয়নের সামনে রাস্তায় ফেরি করে পণ্য বিক্রেতা ওবায়দুল বলেন, ‘বেচাকেনার অবস্থা খারাপ। তাই বাধ্য হয়ে এখানে বসেছি।’ বিদেশী প্যাভিলিয়নগুলোর সামনেও একই অবস্থা। থাইল্যান্ড প্যাভিলিয়নসহ একাধিক ফরেন প্যাভিলিয়নের সামনে দেখা গেছে হকারের উৎপাত। বিদেশী একটি স্টলের কর্মচারী ফরহাদ বলেন, ‘আমরা যে পণ্য বিক্রি করছি, একই পণ্য প্যাভিলিয়নের সামনেও বিক্রি হচ্ছে। এতে আমাদের বেচাকেনা কমে গেছে।’ মেলা প্রাঙ্গণের প্রতিটি রাস্তাতেই স্টল আর প্যাভিলিয়ন থেকে বিক্রয়কর্মীদের হাঁকডাক শুনতে পাওয়া যায়। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে দর্শনার্থীদের।’ পরিবারসহ ফার্মগেট থেকে আসা রফিক বলেন, ‘বাণিজ্যমেলা আর নিউমার্কেটের মধ্যে এখন কোন পার্থক্য নেই। অথচ এটি নাকি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা। বিদেশী ক্রেতারা মেলায় এলে এমন পরিবেশে দেশের সুনাম নষ্ট হতে বাধ্য। তাই কর্তৃপক্ষকে দ্রুতই এ বিষয়ে নজর দেয়া উচিত।’ গাজীপুর থেকে আসা সাকিব হোসেন বলেন, ‘হকারের হাঁকডাকের কারণে মেলার মান দিনকে দিন নিচে নামছে। এমন পরিবেশ না থাকলে মেলার মান আরও উচ্চ হতো।’ এবারের মেলায় ২২ দেশের ৫২টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। তবে অধিকাংশ স্টল আর প্যাভিলিয়নে বিদেশী পণ্যের সঙ্গে মিলছে দেশী পণ্যও। একটি ফরেন প্যাভিলিয়নের কর্মচারী ফরহাদ বলেন, ‘বাইরের জুতোর সঙ্গে আমরা দেশী জুতো বিক্রি করছি।’ বিদেশী প্যাভিলিয়নে দেশী পণ্য কেন জানতে চাইলে এর কোন সদুত্তর দিতে পারেননি ওই বিক্রেতা। থাইল্যান্ড প্যাভিলিয়নের সামনে কথা হয় গাজীপুর থেকে আসা সাকিব হোসেনের সঙ্গে। সাকিব বলেন, ‘পণ্যের দাম অকে বেশি। বলা হচ্ছে বিদেশী। কিন্তু মান ভাল নয়। কোয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন আছে।’ মিরপুর থেকে আসা গৃহিনী ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘ইরানী বোরকা কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু পছন্দ হয়নি। কাপড় আগের মতো ভাল বলে মনে হয়নি।’ এদিকে বিদেশী বলে দেশী পণ্য বিক্রির অভিযোগে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। রিকো ক্রোকারিজ তেমন একটি গৃহস্থালী পণ্য বিক্রেতা। প্রতিষ্ঠানটি ইরানী বলে দেশী পণ্য বিক্রি করেছিল। নেই বিদেশী ক্রেতা, আসে না রফতানি আদেশ ঃ বিক্রেতারা জানিয়েছেন মেলা প্রাঙ্গণে এখনও কোন বিদেশী ক্রেতা চোখে পড়েনি। নেই বায়ারও। রংপুরের শতরঞ্জি দেশের শীর্ষ কারুশিল্প রফতানিকারক। প্রতিষ্ঠানটির সমন্বয়ক আশিকুর রহমান রুমেল বলেন, ‘শতরঞ্জি আমরা ৩৬টি দেশে রফতানি করি। এরইমধ্যে এটি বেশ পরিচিত। মেলায় আমরা স্টল দিই দেশীয় ক্রেতাদের মধ্যে কারুশিল্পের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য। কারুপণ্যের প্রতি দেশীয় ক্রেতাদের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মেলায় কোন বিদেশী ক্রেতার উপস্থিতি চোখে পড়ে না। আর মেলা থেকে কোন রফতানি আদেশও পাওয়া যায় না।’ হলি ক্রাফটস এ্যান্ড ফ্যাশনের সিইও কামাল হোসাইন পাটপণ্যের একজন দেশীয় উদ্যোক্তা। আন্তর্জাতিক বাজারে বহুমুখী পাটপণ্য বিক্রির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এবারের মেলায় স্টল নিয়েছেন জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারে (জেডিপিসি)। কামাল হোসাইন বলেন, ‘মেলায় আন্তর্জাতিক কোন ক্রেতা নেই। ২০০৭-০৮ সালের দিকে কিছু কিছু ফরেনার বায়ার আসত। এখন আসে না। কয়েক বছর ধরে মেলায় কোন বিদেশী ক্রেতা চোখে পড়ে না।’ জানান, আন্তর্জাতিক ক্রেতা পেতে তিনি বাইরের বিভিন্ন দেশের মেলায় অংশ নেন। মেলা প্রাঙ্গণের এ অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাণিজ্যমেলার আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব আবদুর রউফ বলেন, ‘মেলা প্রাঙ্গণ হকারমুক্ত রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যারা ডেকে ডেকে পণ্য বিক্রি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর মনিটরিং চলছে। এরই মধ্যে ৬০টি প্রতিষ্ঠানকে আমরা তিন লাখ টাকা জরিমানা করেছি। ভোক্তা অধিকারও প্রায় ৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে।’ অনেক বৃহৎ আয়োজনের কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে জানান তিনি। বিদেশী ক্রেতা কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে রউফ বলেন, ‘বাণিজ্যমেলায় বিদেশী ক্রেতা এখন হাতেগোনা, এটা সত্যি। তবে, মনে রাখতে হবে বাণিজ্যমেলার একমাত্র উদ্দেশ্য কিন্তু রফতানি বাড়ানো নয়। এখানে দেশের বাণিজ্যকে একসঙ্গে শোকেসিং করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশের বাণিজ্য চিত্রই ফুটে উঠে। মেলায় বিভিন্ন দেশ অংশ নেয়ায় দেশীয় উদ্যোক্তারা বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে। আবার বাইরে থেকে আসা প্রতিষ্ঠানগুলোও দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে জানতে পারছে। একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ বা মেলবন্ধন গড়ে উঠছে। আর এখন বিদেশী ক্রেতারা কিন্তু পণ্যের অর্ডার অনলাইনেই দিয়ে থাকেন। বিদেশী বায়ার কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটিও কারণ হতে পারে।’ সভা-সেমিনারের আয়োজন নেই কেন, এমন প্রশ্নে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের ভাবনায় ছিল না। ক্রেতা-বিক্রেতারা যদি আগ্রহ প্রকাশ করেন তবে বিষয়টি নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে ভাবতে পারি।’
×