ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলনে নারীদের স্মরণীয় ভূমিকার উপেক্ষিত ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৯:২০, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 ভাষা আন্দোলনে নারীদের স্মরণীয় ভূমিকার উপেক্ষিত ইতিহাস

আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী জাগরণ এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। আমাদের জাতীয় ইতিহাস বিনির্মাণে নারীদের ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে এদেশের সংগ্রামী নারী সমাজ পুরুষের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। রাজপথের আন্দোলনে, ঘরোয়া বৈঠকে, সভা-সমাবেশে, মিছিলে, পিকেটিং-এ, দুঃসময়ে ভাষাসৈনিকদের আশ্রয় দানে, লেখা, বক্তৃতা-বিবৃতিতে, ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। কিন্তু তাদের ভূমিকা আজও প্রায় অনুল্লেখিত, উপেক্ষিত এবং অনালোচিত। ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে সুধীমহলে যে আলোচনা হয় এবং লেখালেখির মাধ্যমে দাবি আদায়ের ব্যাপারে জাতিকে অনুপ্রাণিত করে, নারীরা সেই যুগসন্ধিক্ষণে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জোরালোভাবে মতামত দেন এবং আন্দোলন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে জুলাই মাসে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে ব্যাপারে বিভিন্ন মহলে যখন আলোচনা শুরু হয়, ১৯৪৭ সালের ৩ আগস্ট সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে মহিলা ছদ্মনামে আবদুল হক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার করার পক্ষে বক্তব্য রাখেন এবং পূর্ব-পাকিস্তানের নারীসমাজকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলনমুখর হওয়ার আশা ব্যক্ত করেন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষায় মুসলমানদের প্রথম মহিলা সচিত্র সাপ্তাহিক বেগমের প্রথম সম্পাদক ছিলেন কবি বেগম সুফিয়া কামাল। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে কবি সুফিয়া কামাল ও তার সম্পাদিত সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা জোরালোভাবে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। ১৯৪৭ সালের ২৩ আগস্ট ‘বেগম’ পত্রিকায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এটাই ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে কোন মহিলা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম সম্পাদকীয়। ‘আজাদ’ পত্রিকায় ‘মহিলা মাহফিলে’ ১৯৪৭ সালের ৫ অক্টোবর প্রকাশিত আয়েশা বেগমের ‘ভাষা সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি বাংলা ভাষা সমস্যা সম্পর্কে কোন মহিলা কর্তৃক লিখিত প্রথম প্রবন্ধ। রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে গ্রহণের ব্যাপারে নারী সমাজের পক্ষ থেকে অনমনীয় দাবি জানিয়ে মহাসেনা ইসলাম সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় ২৩ আগস্ট ১৯৪৭ সালে একটি প্রবন্ধ লিখেন। ১৪ নবেম্বর ১৯৪৭ পূর্ব-পাক প্রধানমন্ত্রী বরাবর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এতে দেশের শতাধিক চিন্তাবিদদের স্বাক্ষর ছিল। তন্মধ্যে নারীনেত্রী লীলা রায় এম এ (‘জয়শ্রী’-সম্পাদক), মিসেস আনোয়ারা চৌধুরী বিএবিটি (নিখিল বঙ্গ মোসলেম মহিলা সমিতির-র সেক্রেটারি) এবং অধ্যাপক শামসুন্নাহার মাহমুদ স্বাক্ষর করেন। ১৯৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সিলেটের কয়েকজন মহীয়সী নারী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১১ জনেরও অধিক মহিলা ১৯৪৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের মহিলা সাংগঠনিক সম্পাদিকা রুকিয়া আনোয়ার ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে দেশবাসীকে আপোসহীনভাবে সংগ্রাম চালাবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের হরতালে আনোয়ারা খাতুন ও লিলি খান অংশ নেন। সেদিনের পিকেটিংয়ে আরও অংশ নেন বেগজাদী মাহমুদা নাসির, মালেকা, সুলতানা রাজিয়া আফরোজ, খালেদা খানম, লুলু বিলকিস বানু, মেহেরুন্নিসা, আফরোজা হোসেন, লায়লা, সামসুন্নাহার প্রমুখ। ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তনের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং প্রতিবাদ সভায় মিলিত হন। প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে (১৯৪৭) কোন নারীনেত্রী ছিলেন না। দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে (১৯৪৮) দুজন নারীনেত্রী অন্তর্ভুক্ত হন। এরা হলেন- আনোয়ারা খাতুন ও লিলি খান। ১৯৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে আনোয়ারা খাতুন ছাড়াও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একমাত্র মহিলা ছাত্রীনিবাস থেকে একজন প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হন এবং তিনি হলেন- শাফিয়া খাতুন। ১৯৫২ সালে আঞ্চলিক রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদগুলোতে অনেক স্থানে নারী প্রতিনিধি লক্ষ্য করা যায়। যশোরের সংগ্রাম পরিষদে মিসেস হামিদা রহমান এবং বগুড়া সংগ্রাম পরিষদে রাহিমা খাতুন ও সালেহা খাতুন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এছাড়া নাটোরের ‘ভাষা আন্দোলন সমিতি’ গড়ে তুলেছিলেন সামসুন্নাহার নামে একজন নারীনেত্রী। নারায়ণগঞ্জে মমতাজ বেগম ভাষা আন্দোলনের দায়ে শুধু কারাবরণই করেননি, সংসার হারিয়েছেন ও সরকারী চাকরি হারিয়েছেন। সে এলাকার জনতার মধ্যে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক গণজাগরণের সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। তার সঙ্গে আরও ছিলেন আয়েশা আক্তার বেলু, ইলা বকশী, আয়েশা জামান প্রমুখ। ময়মনসিংহ গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী সালেহা বেগম কালো পতাকা উত্তোলনের অপরাধে রাস্টিকেট (বহিষ্কার) হন। খুলনার স্কুলছাত্রী হামিদা খাতুন মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ করার অপরাধে লাঞ্ছিত হন। একুশের গুলিবর্ষণের পর সারাদেশের গ্রাম-গঞ্জে আন্দোলন ছড়িয়ে যায়। এসব আন্দোলনে নারী সমাজও যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে যেসব ছাত্রীরা ভাষা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন তারা হলেন, মিরা সেন, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, জাহানারা রহমান, জওশন আরা রহমান, হোসনে আরা মাক্ষী, তালেয়া রহমান ও হালিমা খাতুন। খুলনায় আনোয়ারা খাতুন, রেবা লুৎফুন নাহার, ফাতেমা চৌধুরী, রাবেয়া খাতুন, সাজেদা হেলেন, রত্না, কৃষ্ণা, বরিশালে মিসেস হামিদ উদ্দিন, হোসনে আরা বেগম, আনজিরা বেগম, মঞ্জুশ্রী সেন, মাহেনুর বেগম, মিসেস অবনিনাদ ঘোষ, মিসেস প্রাণ কুমার সেন, হালিমা খাতুন, নূরজাহান, রাজশাহীতে হাফিজা বেগম টুকু, ফিরোজা বেগম ফুনু, হাসিনা বেগম ডলি, খুকু, মনোয়ারা, জাহানারা বেগম, মোহসিনা বেগম, জেরিনা বেগম, কুলসুম বেগম প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। কুমিল্লায় কারানির্যাতনভোগকারী ভাষাসংগ্রামী লায়লা নূর-এর অবদান স্মরণীয়। ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সারাদেশেই মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৮ সালের ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করেন। তবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য হারে। প্রতিটি মিছিলের অগ্রভাগে ছাত্রীরা অবস্থান নিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে স্লোগান দিয়েছেন। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে ধর্মঘট হয়, ওই ধর্মঘট চলাকালে ঢাকার রাজপথে ছাত্রীদের আলাদা মিছিল হয়েছে। সেখানে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, ইডেন কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করে। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলে নারী সমাজের মধ্যে এক অভাবনীয় গণচেতনা সৃষ্টি হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রীনেতৃবৃন্দ ঢাকার বিভিন্ন মহিলা স্কুল ও কলেজে ছাত্রীদের ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সংগঠিত করেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলা সভায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। আমতলার সভায় বাংলাবাজার গার্লস স্কুল, বকশীবাজার কলেজ, আনন্দময় স্কুল এবং ইডেন কলেজের মেয়েরা অংশ নেয়। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্বেও ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখে রাষ্ট্রভাষা পতাকা দিবসেও ছাত্রীরা ঢাকার রাজপথে মিছিল করেছেন। ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে মেয়েরা পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, মিছিল করেছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, একদল ছাত্রী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে ‘রাষ্টভাষা বাংলা চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ প্রভৃতি ধ্বনিসহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ অভিমুখে চলে আসেন। সেদিন তাদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রী নাদিরা বেগমের নেতৃত্বে ৫০০ পোস্টার লেখা হয় পতাকা দিবস উপলক্ষে। ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলার সভায় অধিকসংখ্যক ছাত্রী অংশগ্রহণ করেন। তারা বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে মিছিল সহকারে আমতলার সভায় উপস্থিত হন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম ছাত্রীদলের নেতৃত্ব দেন শাফিয়া খাতুন। ওই দলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন সুফিয়া ইব্রাহিম, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন্নাহার, হালিমা খাতুন প্রমুখ। সেদিন ১৪৪ ধারা ভাঙার ক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকাও ছিল খুবই স্মরণীয়। ভাষাসৈনিকদের স্মৃতিচারণ এবং বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৫১-৫২ সালে ছাত্রাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উইমেন স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ভিপি ছিলেন ড. শাফিয়া খাতুন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য ও মন্ত্রী ছিলেন। ছাত্রীদের প্রথম দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন সুফিয়া ইব্রাহিম (পরে ডক্টর, শিক্ষক ও জাতীয় অধ্যাপক), হালিমা খাতুন (পরে ডক্টর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও লেখক) এবং রওশন আরা বাচ্চু (পরে শিক্ষক)। ২১ ফেব্রুয়ারির সেই অবিস্মরণীয় ও উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে আরও যারা ছাত্রীদের প্রথম দলে যা অল্প ব্যবধানে সেই ঐতিহাসিক আমতলায় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছেন তারা হলেন- সুফিয়া খান, কাজী খালেদা খাতুন, গুলে ফেরদৌস, চেমন আরা, শরিফা খাতুন এবং নাম না জানা অনেকে। (সূত্র : ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ছাত্রীদল - এম আর মাহবুব, যুগান্তর, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৯) তারা টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ ও গুলির ভয়কে উপেক্ষা করে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। গুলির পর ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে আইনসভায় বক্তব্য রাখেন- আনোয়ারা খাতুন। আমানুল হক শহীদ রফিকের মাথার খুলি উড়ে যাবার ঐতিহাসিক দৃশ্যের যে ছবি তুলেছিলেন সেটা সম্ভব হয়েছিল তৎকালীন মেডিক্যাল ছাত্রী হালিমা খাতুনের সহযোগিতার কারণে। হাসপাতালে অসংখ্য আহত ছাত্রদের সেবায় এগিয়ে আসেন হাসপাতালের সেবিকারা। বিশেষ করে ঊষা বেপারীর নামটি খুবই স্মরণীয়। তিনি জীবনবাজি রেখে ছাত্রনেতাদের হাসপাতালের বেডে লুকিয়ে রেখেছেন। নিজের সাদা কাপড় পরিয়ে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন প্রতিবাদ করতে। বাড়ির ছাদ থেকে গৃহিণীরা শোক মিছিলের উপর ফুল ছিটিয়ে অভিনন্দন জানান। জেলখানায় রাজবন্দীদের জন্য সুস্বাদু খাবার পাঠিয়েছেন পুরান ঢাকার বধূরা এবং ইডেন কলেজের ছাত্রীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাজেদ খানের স্ত্রীর কালো শাড়ি কেটে ব্যাজ বানিয়েছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা মেডিক্যাল ছাত্রদের যৌথ শ্রমে নির্মিত হয় প্রথম শহীদ মিনার। ২৪ তারিখ সকালে সেই মিনারে প্রথম স্বর্ণালঙ্কার প্রদান করেছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের মাতা সৈয়দা খাতুন এবং প্রথম ফুলের মালা প্রদান করেছিলেন ডাঃ এ হাফিজের মাতা শাহজাদী খানম। ২৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্কুলে কলেজের ছাত্রীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল বের করেন। ২৯ ফেব্রুয়ারিও চট্টগ্রাম কলেজ ও স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা মিছিল বের করেন এবং সমাবেশ করেন। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রথম প্রভাতফেরি অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভোরেই মেয়েরা সারিবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করেন। এদিন যে মিছিল হয়েছে তার অগ্রভাগে মেয়েদের দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও সারিবদ্ধভাবে প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন খালেদা ফেনসী খান, ফরিদা বারী মালিক, হয়রত আরাসহ আরও অনেকে। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে ইডেন কলেজের ছাত্রীরা শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। এ সময় ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল শামসুজ্জামান চৌধুরী, উর্দু বিভাগের অধ্যাপক আহসান আহমদ আশক এবং ইডেন কলেজের প্রিন্সিপাল ফজিলাতুন্নেসা জোহা তাদের এ কাজে বাধা দেন। কিন্তু ইডেন কলেজের ছাত্রীরা সকল বাধা আগ্রাহ্য করে শহীদ মিনারটি নির্মাণকাজ শেষ করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কামরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রীরা ওই স্কুল প্রাঙ্গণে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। বাহান্ন পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। প্রতিভা মুৎসুদ্ধি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তারা পুলিশি নির্যাতন সহ্য করেছেন, জেল খেটেছেন। জেলে মহিলাদের জায়গা সংকুলান না হওয়ায় লালবাগ দুর্গে তাবু টানিয়ে সাবজেল তৈরি করা হয় এবং সেখানেই ভাষা সংগ্রামীদের রাখা হয়েছিল। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মূল নকশার শিল্পী হামিদুর রহমানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভাস্কর নভেরা আহমদের নাম। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা, পরিকল্পনা ও নির্মাণে নভেরা আহমদ বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন এবং হামিদুর রহমানের সঙ্গে মূল কাজটি নভেরাকেই করতে হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ১৯ নং আজিমপুরের সেই ত্যাগী ও মহিয়সী নারী রাহেলা কাসেমের (প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের স্ত্রী) কথা সবাই ভুলেই গেছে। একুশের ছাত্রহত্যার পর আমাদের মা-বোনদের কথা এসেছে কবিতা, গল্প, নাটক ও উপন্যাসে। বরকতের মা, সালাম-জব্বারের মা, রফিকের মা ও বধুর অন্তর্বেদনা আজও আমাদের আহত করে। তখনকার সামাজিক অবস্থা আজকের মতো ছিল না। তখনকার সময় ছেলেদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। প্রক্টরের মাধ্যমে কথা বলতে হতো। নতুবা ১০ টাকা জরিমানা করা হতো। ঘোড়ার গাড়িতে দরজা লাগিয়ে বা রিকশায় পর্দা লাগিয়ে মেয়েদের চলাফেরা করতে হতো। এমনি প্রতিকূল পরিবেশে শত বাধা-বিপত্তি অগ্রাহ্য করে মেয়েদের ভাষা আন্দোলনে যোগদান করা ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ ও অনন্য ঘটনা। ভাষা আন্দোলনে সফলতার নেপথ্যে নারী সমাজের অবদান অনস্বীকার্য। এ আন্দোলনের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো, ভাষা আন্দোলন ছিল নারী প্রগতি আন্দোলনের প্রথম এবং অন্যতম সোপান। তারা তৎকালীন সমাজের সকল অবগুণ্ঠন ভেঙ্গে এই প্রথম রাজপথে নেমে আসেন এবং আন্দোলনে অংশ নেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নারী সমাজের এসব স্মরণীয় অবদানের কথা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে আজও উপেক্ষিত রয়ে গেছে। এ যাবতকালে নারীদের অবদান নিয়ে মাত্র কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলনে নারীদের স্মরণীয় ভূমিকা নিয়ে আরও ব্যাপক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। লেখক : গবেষক
×