ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষে তীব্র যানজট

প্রকাশিত: ১১:৫০, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষে তীব্র যানজট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সারাদেশ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সে সময় সরকারীর বিভিন্ন দফতর থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত ও গণপরিবহন যে আইনের তোয়াক্কা না করেই সড়কে চলছে তা শিক্ষার্থীরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আন্দোলনের মুখে দোষী ব্যক্তিরা আইন মেনে চলার অঙ্গীকার করলেও আন্দোলন পরবর্তী অবস্থা আগের মতোই। সদ্য সমাপ্ত ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষে’ এ চিত্র আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরিবহন চালক ও পথচারীরা মানছেন না ট্রাফিক আইন। দোষীদের বিরুদ্ধে শুধু মামলাই দিয়েছে ট্রাফিক পুলিশরা, সচেতনতা বা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর কোন বিশেষ উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বরং ট্রাফিক পক্ষে ট্রাফিক পুলিশের চরম ব্যর্থতায় রাজধানীতে তীব্র যানজটে নাকাল হয়েছে নগরবাসী। ফলে ১৫ দিনের ট্রাফিক পক্ষ ‘মামলা পক্ষে’ পরিণত হয়েছে। জানা যায়, ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ, জনসচেতনতা এবং সড়কে ট্রাফিক শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে গত ১৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ’। এই কার্যক্রম চলে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। ট্রাফিক পক্ষের প্রথম ৯ দিন রাজধানী জুড়ে ট্রাফিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ৪৬ হাজার ৪৪টি মামলা দায়ের করেছে ট্রাফিক পুলিশ। জরিমানা করা হয়েছে ২ কোটি ২৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫০ টাকা। মামলা সবচেয়ে বেশি হয়েছে মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে। মোট ২০ হাজার ৯৯০টি মামলা ছাড়াও ৯৭০টি মোটরসাইকেল আটক করা হয়েছে। এছাড়া উল্টোপথে চলাচলের অপরাধে ৮ হাজার ২০৪টি মামলা হয়। এসব মামলায় মোট ২ কোটি ২৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫০ টাকা জরিমানাও করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। এছাড়াও সড়কে অভিযানকালে ২০৭টি গাড়ি ডাম্পিং ও ৬ হাজার ১৮৫টি গাড়ি রেকার করা হয়। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের দায়ে ৯৫২টি, হুটার ও বিকনলাইট ব্যবহারের কারণে ৬০টি, স্টিকার ব্যবহারের জন্য ৮টি এবং মাইক্রোবাসে কালো গ্লাস ব্যবহারে ১১৭টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইলফোনে কথা বলার অপরাধে ১৪৯ জন চালকের বিরুদ্ধেও মামলা দেয়া হয়। এ চিত্র দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাফিক পক্ষে কেবল মামলা দেয়াই সার হচ্ছে। সড়কে কোন শৃঙ্খলা ফেরেনি, বরং যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে। অথচ ট্রাফিক পক্ষ হওয়া উচিত ছিল মামলাহীন। এ সময়ে নগরী হওয়া উচিত ছিল যানজটমুক্ত। ট্রাফিক পক্ষের একটিই ইতিবাচক দিক ছিল ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তাদের মাঠে দেখা গেছে। সারাবছর যা দেখা যায় না। অবস্থা দেখে মনে হয়েছে, সারাবছর ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা ছুটি কাটায় শুধু ট্রাফিক পক্ষেই কাজ করেন। তবে মাঠে তারা ট্রাফিক শৃঙ্খলা রক্ষার পরিবর্তনে গাড়ি ধরা আর মামলা দেয়াতেই ব্যস্ত থেকেছেন। অথচ মামলা দেয়ার কাজটি সারাবছর করা উচিত, আর ট্রাফিক পক্ষে সড়ককে যানজটমুক্ত শৃঙ্খল সড়ক করা উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, সড়কে ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে প্রথম প্রয়োজন আইন। আমাদের দেশে আইন থাকলেও তা খাতায় পত্রে। বাস্তবে আইন প্রয়োগ নেই। আমাদের সড়কে ট্রাফিক কার্যক্রম চলে ট্রাফিক পুলিশের (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কনস্টেবল) ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের ইচ্ছে হলে এখন তিনি এই রাস্তা ছাড়বেন, তিনি ছেড়ে দিলেন। সেটা কতক্ষণ চলবে তার কোন সুনির্দিষ্ট সময় নেই। তার আবার যখন ইচ্ছে হয় তিনি অন্য সিগন্যাল ছাড়বেন, সেটা ছাড়লেন। এভাবে ট্রাফিক পুলিশের ইচ্ছায় ট্রাফিক সিগন্যাল চলার কারণে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন সমন্বয় দেখা যায় না। সমন্বয়ের জন্য ট্রাফিক পুলিশকে ওয়াকিটকি দেয়া হয়। কিন্তু ওই ওয়াকিটকি ব্যবহার করতে দেখা যায় না যানজট নিরসণে। কোন রাস্তায় যানজট লেগে গেলে তারা জানার পর্যন্ত চেষ্টা করে না কি কারণে জট লেগেছে, কোথায় লেগেছে এবং তা দূর করার হচ্ছে না কেন? বরং কোন রাস্তায় যানজট লাগলে অন্য রাস্তা ছেড়ে দিয়ে রাস্তার মোড়ে নির্বাক তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সরেজমিনে ঢাকার ট্রাফিক কার্যক্রম পরিদর্শনে দেখা যায়, রাস্তায় যারা ট্রাফিক শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করেন তাদের কোন মনিটরিংয়ের কোন ব্যবস্থা দেখা যায় না। আজ পর্যন্ত রাস্তায় ট্রাফিক শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য কোন ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের খবর পাওয়া যায়নি। মূলত ট্রাফিক পুলিশের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাবেই আমাদের দেশে যানজট তীব্র আকার ধারণ করছে। বেশিরভাগ ট্রাফিক পুলিশ বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চাকরি লাভ করে কিংবা বদলীয় হয়ে আসে। ফলে সুযোগ পেলেই গাড়ি আটকে (বিশেষ করে মালামাল পরিবহনকারী গাড়ি) সেই টাকা উঠাতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। শুধু তাদের এই অসৎ উপায়ে টাকা উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে বলে ঢাকায় জিজিটাল সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে ডিজিটাল সিগন্যালিং ব্যবস্থা নেই। অথচ বাংলাদেশ কোটি কোটি ডলার খরচ করে ডিজিটাল সিগন্যালিং ব্যবস্থার কাঠামো তৈরি করেছে, যা ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যানজটের কথা উঠলেই ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে ‘রাস্তা অপ্রশস্ত ও গাড়ি বেশি’ বলা হয়। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকতা শহরেও আমাদের চেয়েও অপ্রশস্ত রাস্তা এবং গাড়ি অনেক বেশি। অথচ তারা সেখানকার ট্র্রাফিক ব্যবস্থা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। ওখানে আমাদের মতো হাত দিয়ে সিগ্যানাল নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। সবকিছু ডিজিটাল ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কোন যানবাহন ট্রাফিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের সাহস পায় না। আর উন্নত দেশগুলোর মধ্যে লন্ডন শহরের রাস্তা আমাদের চেয়ে আরও অপ্রশস্ত। সেখানে আমাদের চেয়ে গাড়ি কয়েকগুণ বেশি। অথচ সেখানে আমাদের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোন সিগ্যনালে আটকে থাকতে হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু গণসচেতনতা সৃষ্টি করে সড়কে ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। এজন্য সড়কে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত ট্রাফিক সার্জেন্ট-টিআইদের উন্নত প্রশিক্ষণ দরকার। বাড়ানো দরকার দক্ষতা। তাদের পণ্যবাহী যানবাহনের পেছনে না ছুটে সড়কে শৃঙ্খলা কি করে ফেরানো যায় তা নিয়ে আরও মনোযোগী হতে হবে। আইন ভঙ্গকারীর জরিমানার হার দ্বিগুণ করতে হবে। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করলেই কেবল সড়কে শৃঙ্খলা ফিরতে পারে। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘সড়কে আইন অমান্য করার দায়ে মানুষ (চালক, পথচারী) যখন ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঠিক তখনই তারা আইন মানতে বাধ্য হবে। শুধু চালকদেরই নয়, পথচারীদেরও দোষ আছে। তারাও আইন মানে না। তবে পথচারীদের বিষয়ে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তিনি ট্রাফিক আইন অমান্য করলে জরিমানার হার বৃদ্ধি করারও দাবি জানান। জোরালো প্রচারণার কোন বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এতদিনেও সড়কে কেউ আইন মেনে চলেনি। এখন মানুষকে আইন মানাতে হলে কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। এজন্য স্কুল পর্যায়ে ট্রাফিক এ্যাডুকেশন চালু করতে হবে। আমার সাজেশন হচ্ছে- তিনমাস দেশের সকল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারী-বেসরকারী সকল প্রতিষ্ঠানে এবং বিভিন্ন কমিউনিটিতে গিয়ে ট্রাফিক সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। তিনমাস পর কেউ যদি ট্রাফিক আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে তবে তার এবং তার কর্মরত প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ সড়কে দায়িত্ব পালনকারী ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, সড়কে যারাই ট্রাফিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছে তাদেরকেই আমরা মামলা দিচ্ছি। কিন্তু এরপরও চালক-পথচারীরা আইন মানছেন না। রাজধানীর বিভিন্ন সিগন্যালে ট্রাফিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মাইকিং করে বলা হচ্ছে এবং বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাফিক সদস্যরা আইন মেনে চলার অনুরোধও করছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে মানুষের মধ্যে আইন মানার প্রবণতা যেন কমে গেছে। সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর উত্তরা হাউস বিল্ডিং এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ থাকার পরও পথচারীরা ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পারাপার হচ্ছেন। গণপরিবহনগুলো চলন্ত অবস্থায় দরজা খোলা রাখছে। অপরদিকে উত্তরা আজমপুর এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে সড়কের আইল্যান্ড টপকে পথচারীদের পার হতে দেখা গেছে। সেই সঙ্গে সড়কের মাঝখানে গণপরিবহন থামিয়ে যাত্রী উঠা-নামাও চলছে। হাউস বিল্ডিং এলাকায় ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পার হওয়া আশরাফুল নামে একজন পথচারীর সঙ্গে কথা হয়। এ সময় আশরাফুল ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করার কারণ জানান। তিনি বলেন, ‘হাউসবিল্ডিংয়ের ফুটওভার ব্রিজটি অনেক সরু, একসঙ্গে দুইজন ওঠা যায় না। আর ফুটওভারব্রিজে উঠতে-নামতে সময় বেশি লাগে। মূলত সময় বাঁচাতে নিচ দিয়ে হেঁটে পার হয়েছি।’ এদিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দেখা যায়, সড়ক ছেড়ে ফুটপাতের ওপর দিয়ে গণপরিবহন চলাচল করছে। এছাড়া মোটরসাইকেল চালকরা একটু বেশি সুবিধা নিতে ফুটপাথেই তুলে দিয়েছেন নিজেদের বাহনটি। ফুটপাথের ওপর দিয়ে গাড়ি চালানোর কারণ জানতে চাইলে শিকড় পরিবহনের চালক জাহিদ বলেন, ‘আগের গাড়িটা গেছে বলে আমিও পেছন পেছনে আসছি। ভুল হয়ে গেছে।’ ট্রাফিক আইন মানেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মানি, মাঝে মধ্যে একটু ভুল হয়ে যায়।’ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা চেষ্টা করছি। তবে এটা একদিনেও হবে না, ১৫ দিনেও হবে না। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ধীরে ধীরে এর সফলতা আসবে। এছাড়াও শহরে বিভিন্ন জায়গাতে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে, তাই সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সব দেশে প্রাইমারি স্কুলে ট্রাফিক এ্যাডুকেশন রয়েছে, এর জন্য ট্রাফিক আইন সম্পর্কে তাদের কাউকে বোঝাতে হয় না। তারা সড়কে এলেই নিজে থেকেই আইন মেনে চলাচল করে। আমাদের দেশে এই সংস্কৃতি যেহেতু হয়নি, তাই আমাদের ট্রাফিক সপ্তাহ দিতে হয়, আবার ট্রাফিক সচেতনতা মাসও দিতে হয়। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পরিবহন মালিক-শ্রমিক, সরকারের বিভিন্ন পক্ষ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সমন্বয জরুরী বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ কার্যক্রমে শুধুমাত্র মামলাই দেয়া হচ্ছে, এর বেশি কিছু হচ্ছে না। সত্যিকার শৃঙ্খলা ফেরাতে সব পক্ষের সমন্বয় প্রয়োজন, যা আসলে হচ্ছে না। সমন্বিত কর্মসূচী গ্রহণ না করলে সড়কে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়।’
×