ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কারাগারে অতিরিক্ত বন্দী রাখার অভিযোগের দিন শেষ হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

  কারাগারে অতিরিক্ত বন্দী রাখার অভিযোগের দিন শেষ হচ্ছে

মশিউর রহমান ॥ ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দীকে কারাগারে আটক রাখার যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা অভিযোগের সমাপ্তি টানতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে দেশে প্রথমবারের মতো সিলেট পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে নতুন করে বন্দী আটক রাখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। এটি চালু হলে পুরনো কারাগারটির সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। যা দেশের ৬৯তম কারাগার হিসেবে গণ্য করা হবে। এর পরপরই আরও কমপক্ষে ৫টি পুরনো কারাগারকে পার্ট-২ হিসেবে ব্যবহারের জন্য সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করে অতি দ্রুতই তা চালু করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। মূলত সারাদেশের সকল কারাগারের বন্দী ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ও বন্দীদের সশ্রম কারাদন্ড বাস্তবায়নকল্পে দক্ষ ও উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে ও কারাগারকে প্রকৃত সংশোধনাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় সরকার। বন্দীর মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা স্বার্থ সুরক্ষাই এ পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য বলে জানা গেছে। এরই অংশ হিসেবে সকল পুরনো কারাগারকে বন্দী আটকের দ্বিতীয় স্থান হিসেবে ব্যবহার করবে সরকার। তবে এসব কারাগার চালু করতে নতুন জনবল নিয়োগ না করে উদ্যোগটি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে গেলে পুরনো জনবল দিয়ে কারাবন্দীর নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা প্রদান করা অনেকটা অসম্ভব বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। তবে প্রাথমিকভাবে সীমিত আকারে চালু করা সম্ভব হবে। কারা সূত্র জানায়, সদ্য নতুন কারাগারে বন্দী স্থানান্তর হওয়া পুরনো সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারকেই পার্ট-২ হিসেবে ব্যবহারের জন্য সরকার বেছে নিয়েছে। তবে পুরো কারাগারে নয় কারাগারটির একটি অংশকে সম্পূর্ণ বন্দী রাখার উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এরই অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিলেট বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক বরাবর চিঠি প্রদান করেছে। নতুন কারাগার চালু সম্পর্কে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কারাগারটি চালু করার লক্ষ্যে কি কি প্রয়োজন তা জানতে চাওয়া হয়েছে। অপরদিকে কারা কর্তৃপক্ষও নতুন করে পুরনো কারাগারটি চালু করতে কি কি প্রয়োজনীয় তা নির্ধারণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি প্রদান করেছে। কারা সূত্র জানায়, বর্তমানে পুরাতন কারাগারটিতে যেহেতু কোন প্রকার বন্দীই অবস্থান করে না তাই স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গেই নতুন কারাগারটিতে সকল আবাসন থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সকল কিছুর একটি তালিকা প্রদান করেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সিলেট পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারটির প্রধান ফটকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২ লেখা সম্বলিত সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে। কারাগারটি চালুকরণের লক্ষ্যে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কর্তৃক সংস্কারের কাজও চলমান রয়েছে। বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী সিদ্ধান্তের পরই নতুন করে এই কারাগারটি চালু করা হবে বলে জানা গেছে। কারা সূত্র জানায়, শুধু সিলেটই নয়, নতুন কারাগারে বন্দী স্থানান্তর হওয়া ও পুরনো আরও কয়েকটি কারাগারকেই সংস্কার করে একই নামে পার্ট-২ কারাগার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে কারা অধিদফতর। বর্তমানে দেশের ৬৮ টি কারাগারে ধারণ ক্ষমতার প্রায় আড়াইগুণ বন্দী আটক রয়েছেন। যা মানবাধিকার লংঘন বটে। এ থেকে উত্তরণের জন্য এই পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের সকল কেন্দ্রীয় কারাগার ও অনেক জেলা কারাগারে ২ থেকে ৫ গুণ বা কোন কোন কারাগারে ততোধিক বন্দীকে আটক রাখা হচ্ছে। এ অবস্থার অবসান ঘটাতে সরকার সকল পুরনো কেন্দ্রীয় ও জেলা কারাগারকে বন্দী আটক রাখার দ্বিতীয় স্থান হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রায় ২ হাজার বন্দীকে নবনির্মিত কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। সম্প্রতি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়ে সিলেট বিভাগের কারা উপ মহাপরিদর্শককে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরই অংশ হিসেবে এই কারাগারটিতে বন্দী আটক রাখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে সিলেট কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ। বন্দী সঙ্কট লাঘবে সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবানের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারাগারটি নতুন করে চালুর লক্ষ্যে কি কি প্রয়োজন তার উল্লেখপূর্বক তালিকা চেয়ে চিঠি প্রদান করা হয়েছে। নতুন করে কারাগারটি চালু করতে প্রয়োজনীয় জনবল, অস্ত্রাগার ও বন্দীর নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়টির প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় সকল কিছুর চাহিদা উল্লেখ করে কারা অধিদফতরের পক্ষ থেকেও মন্ত্রণালয়ে চিঠি প্রদান করা হয়েছে বলে জানা গেছে। কারা কর্তৃপক্ষ পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনাপূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার পরপরই কারাগারটি দ্রুত চালুকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে। তবে অতি দ্রুতই কারাগারটি চালুর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুরনো এসব কারাগারে আগের মতোই আটক থাকবেন বন্দীরা। অব্যবহারিত সকল পুরনো কেন্দ্রীয় ও জেলা কারাগারের জমি ও সকল স্থাপনাকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে এবং বন্দীদের থাকা, গোসল, রান্নার বহুযুগের কষ্ট লাঘব করতে চায় সরকার। তাই বন্দী আটকের হার অকল্পনীয় হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ভবিষ্যতে অধিক বন্দীদের কথা চিন্তা করে পুরাতন এসব কারাগারকে বন্দী আটকের স্থান হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের দেশের প্রথম কারাগারটি সরকারের এই সিদ্ধান্তের বাইরে থাকবে। এই কারাগারটিকে নতুন করে কোন বন্দী রাখা হবে না। এর বাইরে যে কোন নতুন কারাগারে বন্দী স্থানান্তর করার পর পার্ট-১ ও পুরাতন কারাগারটিকে পার্ট-২ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। ফলে অধিক বন্দী তুলনামূলক স্বাচ্ছ্যন্দের সঙ্গে থাকতে পারবেন। কারাসূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে কারাগারটির সীমানায় কোন পরিবর্তন না আনলেও পূর্বের সীমানার মধ্যেই নির্দিষ্ট স্থান নির্বাচন করে ও কয়েকটি সেল বন্দী আটকের জন্য ব্যবহার করা হবে। তবে প্রতিটি পুরাতন কারাগারে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা রক্ষা করেই পুরাতন এসব কারাগারে বন্দী আটক রাখা হবে বলে জানা গেছে। জনবল সংকটের কথা ভেবে প্রাথমিকভাবে ক্ষুদ্রাকারে এই পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে সিলেট কারাগারে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করার পরপরই সকল ব্যবহারযোগ্য পুরনো কারাগারকেই পার্ট-২ কারাগার হিসেবে ব্যবহার করা হবে। উল্লেখ্য, গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নবনির্মিত কারাগারে বন্দী স্থানান্তরিত হওয়ার পর দেশের সকল অব্যবহারিত পুরনো কারাগারকে অধিক পরিমাণ বন্দী আটকের স্বার্থে এসব কারাগারকে সংস্কারপূর্বক ব্যবহারের জন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের কারা-১ শাখার এ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন কারাগারে আটক বন্দীদের বর্তমান সংখ্যাধিক্য, ক্রমবর্ধমান বন্দী সংখ্যা, প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত অনুশাসন অনুযায়ী কারাবন্দীদের কর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করে কারাগারগুলোকে সংশোধনাগারে রূপান্তরের লক্ষ্যে বিভিন্ন জেলায় নতুন নির্মিত কারাগারকে কারাগার-১ ও পুরনো কারাগারকে কারাগার-২ হিসেবে ব্যবহারের জন্য সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ-সংক্রান্ত আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করা হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে সিলেট কারাগার দিয়েই এর সূচনা করা হচ্ছে বলে কারাসূত্র নিশ্চিত করেছে। কারা অধিদফতরের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগারের মোট বন্দী ধারণক্ষমতা ৩৬ হাজার ৬১৪ জন। এর বিপরীতে গত ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত কারাগারগুলোতে প্রায় ৯১ হাজারের বেশি বন্দী আটক রয়েছেন। যা ধারণ ক্ষমতার প্রায় আড়াই গুণ। কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, খুলনা, সিলেট, ফেনী, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শরীয়তপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় নতুন কারাগার নির্মাণ করা হয়েছে। সর্বশেষ শনিবার পিরোজপুর জেলা কারাগার নতুন কারাগারে সকল বন্দী স্থানান্তর করেছে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসব কারাগারসহ সকল পুরনো কারাগারকে কারাগার-২ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এরই অংশ হিসেবে এসব কারাগারকে বন্দীদের থাকার উপযোগী করে তুলতে দ্রুতগতিতে সংস্কার কাজ চলছে। এর আগে ২০১৮ সালে কারা কর্তৃপক্ষ সাজাপ্রাপ্ত আসামির চেয়ে বিচারাধীন আসামির সংখ্যা বেশি হওয়ায় ও ধারণক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি বন্দী আটক থাকায় রান্না, থাকার স্থান, গোলের সংকটসহ কারাভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত নানা সমস্যা সৃষ্টির কথা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেয়। এতে বিচারাধীন আসামিদের মধ্যে শুধু মাদক মামলায় আটক আসামিই মোট আসামির ৩৭ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে অধিদফতরে মোট জনবল প্রায় ১২ হাজার। এ অবস্থায় লোকবল বৃদ্ধি না করে পুরনো কারাগারগুলো ব্যবহার শুরু করলে নিরাপত্তা সংকট তৈরি হতে পারে। বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক জনবল দিয়ে ৫৫টি জেলা কারাগার ও ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিনিয়তই হিমশিম খাচ্ছে কারা অধিদফতর। কারা কর্তৃপক্ষ কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও শুধুমাত্র জনবল সংকটের কারণে তা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। এমতাবস্থায় নতুন করে কোন প্রকার প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ না করে পরনো জনবল দিয়েই একই জেলা বা বিভাগীয় শহরে বন্দীর নিরাপত্তা রক্ষা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে তা ভাবা প্রয়োজন। পুরনো কারাগারগুলোয় নতুনভাবে কার্যক্রম শুরু করতে গেলে জনবল সংকট আরো প্রকট হবে। সেক্ষেত্রে বন্দীদের নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়বে। জনবল নিয়োগের বিষয়টির প্রতি অতি গুরুত্ব দিয়ে নতুন নতুন কারাগার চালু করা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
×