ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাণিজ্যমেলায় ছুটির দিনে দর্শনার্থী কম, তবে কেনাকাটা ভাল

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 বাণিজ্যমেলায় ছুটির দিনে দর্শনার্থী কম, তবে কেনাকাটা ভাল

ওয়াজেদ হীরা ॥ শেষের দিকে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। ছুটির দিনে দর্শনাথী বেশি হওয়ার প্রত্যাশা বেশি থাকে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। তবে ছুটির দিনে দর্শনার্থী কমলেও বেড়েছে বিক্রি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন রাজধানীতে প্রাণের বই মেলা শুরু হওয়ায় দর্শনার্থীও ভাগ হয়ে গেছে। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে এবারের বাণিজ্য মেলায়। সে হিসেবে আরও একটি ছুটির দিন পাওয়া যাবে। তবে মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে সেদিন মেলা শেষ হয়ে যাবে অনেকটাই ভাঙা হাটের মতোই মনে হবে। সে হিসেবে ১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার নিয়ে প্রচুর আশায় ছিল অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু দর্শনার্থীরা সাড়া ফেলেনি তেমন। গত শুক্রবার দর্শনাথী প্রবেশ সংখ্যা ছিল এবারের রেকর্ড। অর্থাৎ গেট ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের সূত্রে দেড় লাখেরও বেশি। আর গতকাল শুক্রবার দর্শনার্থী প্রায় ৫০ হাজারই কমে গেছে। মেলার দ্বিতীয় শুক্রবারও ১ লাখ বিশ হাজার টিকেট বিক্রির কথা জানিয়েছিল। আর চতুর্থ শুক্রবার মেলার ২৪তম দিনে অনেকটাই হতাশার কথা বলেন গেট ইজারাদার স্বত্বাধিকারী মোঃ শহিদুল ইসলাম। মীর ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মোঃ শহিদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, আরও একটি শুক্রবার থাকলেও সেদিন মেলা শেষ। এই চতুর্থ শুক্রবারটা নিয়ে আমরা অনেক আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু আগের দুই শুক্রবারের চেয়েও টিকেট কম বিক্রি হয়েছে। হতে পারে রাজধানীতে বই মেলা শুরু হয়েছে এটির কারণে কিছু বইপ্রেমী দর্শনার্থী সেখানে ছুটেছেন। ২৪তম দিনে কেমন টিকেট বিক্রি হলো সেটি নিয়ে তিনি সন্ধ্যা ৬টার দিকে জানান, এখনও এক লাখের কিছু কম হবে। হয়ত দিন শেষে সেটি ১ লাখ ১০ হাজার হতে পারে। মেলাপ্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে সকাল থেকেই দর্শনার্থী তুলনামূলক কম। তবে যারা এসেছেন তারা অধিকাংশই কিছু না কিছু কিনেছেন। একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন দর্শনার্থী হয়ত কিছু কম, তবে বিক্রি বেশ সন্তোষজনক। আর বিক্রির উদ্দেশে যারা মেলায় অংশ নিয়েছেন তারা সহজে কোন ক্রেতাকে হাতছাড়া করতে চায়নি। আর যেসব প্রতিষ্ঠান শুধু পণ্যের প্রদর্শন করার জন্য মেলায় অংশ নিয়েছেন তারাও দর্শনার্থীদের পণ্যের নানা পরিচিতি তুলে ধরে সময় কাটিয়েছেন। শুধু একটি ছুটির দিন বিক্রি ভাল হলেও সারা মাসের মেলা নিয়ে কিছুটা শঙ্কা কাজ করছে ব্যবসায়ীদেরও। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন মেলা শেষে দেখা যাবে অন্যান্য বছরের চেয়ে তাদের ব্যবসা তুলনামূলক কম হবে। কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাণিজ্য মেলার ক্রেতাদের বড় অংশ মধ্যবিত্ত। মাসের প্রথম সপ্তাহে তারা তুলনামূলক বেশি কেনাকাটা করেন। এ বছর দেরিতে মেলা শুরু হওয়ায় সেই প্রথম সপ্তাহ বাণিজ্য মেলা ধরতে পারেনি। মধ্যবিত্ত শ্রেণী জানুয়ারি মাসের বেতনের বড় অংশ অন্যখাতে খরচ করেছেন। আবার ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা বা অন্যান্য কারণে দর্শনার্থীও খুব একটা সাড়া দেবে না। এদিকে দর্শনার্থী যারা এসেছেন তারা মোটামুটি সবাই কিছু না কিছু কিনেই ফিরেছেন। সন্তানসহ মেলায় আসা সোরহাব হোসেন বলেন, বাণিজ্য মেলা শেষের দিকে। আর আসা হবে না। কিছু কিনে নিলাম প্রয়োজনীয় পণ্য। আর সামনের ছুটিটা বইমেলায় নিয়ে যাব সন্তানদের। সবই জানার দরকার আছে বলেন তিনি। ব্লেজারের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জসিম বলেন, রাজধানীতে শীত একেবারেই নেই। তবুও ব্লেজার বিক্রি একেবারে খারাপ না। যদিও মেলার শুরুর দিকে কোন বিক্রি ছিল না। আমরা কাস্টমারও খুব একটা হাতছাড়া করতে চাই না। গৃহস্থালি পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, বিভিন্ন খাদ্য পণ্য কিনতে নারীদের বেশ ভিড় দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট স্টল প্যাভিলিয়নগুলোয়। হাসনা আক্তার মিনু নিজে বালতিসহ কয়েক প্রকার পণ্য নিয়ে হাঁটছেন, স্বামীর কাছেও পণ্য। দু’জনে বিশাল পণ্যের সমাহার নিয়ে হাঁটতে বেশ ক্লান্ত হয়ে মেলার বাইরে এসে বসে যান আইলেনের ওপর। পণ্য কেনা নিয়ে বলেন, যা কিনেছি সবই সংসারের প্রয়োজন। বাইরে থেকে অনেক সময় বেশি দাম হয়। আবার এখানে হয়তো দাম বাইরের মতোই কিন্তু কোন অফার চলছে সঙ্গে। সবমিলিয়ে আমরা ক্রেতারা একটু লাভবান হই। স্বস্তির হাসি দেন হাসনা আক্তার। বাণিজ্যমেলায় অনুমতির তোয়াক্কা না করে বেড়েই চলেছে হকারের দৌরাত্ম্য। বিড়ি-সিগারেট, পানি, ফুসকা, চিপস বা খেলনা সামগ্রী নিয়ে বড় বড় প্যাভিলিয়ন বা স্টলের সামনে বসে পড়ছেন তারা। তিন গুণ বেশি দামে বিক্রি করছেন পণ্য। এতে একদিকে স্টলের পরিবেশ যেমন নষ্ট হচ্ছে অপরদিকে ম্লান হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার পরিবেশ। এদিকে মেলায় প্রচুর হকারের আমদানি বেড়েছে। আর হকারদের কারণে রীতিমতো বিরক্ত দর্শনার্থীরা। কেউ কেউ বলছেন মেলায় আরও কয়েকদিন আসার ইচ্ছা থাকলেও আর আসবেন না। মিরপুর বাংলা কলেজের শিক্ষার্থীরা ১৫ জন দলবেঁধে এসেছেন মেলায়। অনেকেই পছন্দের জিনিস কিনেন। আরিফুর রহমান ও তার বন্ধুরা বলেন, আন্তর্জাতিক মেলায় এলাম শখের বসে। এসে দেখলাম এটি একটি বড় ধরনের বাজার। আর যে হারে হকারদের হাকডাক তাতে মনে হয় এটি নিউমার্কেট বা বঙ্গবাজারকেও হার মানিয়েছে। ইচ্ছা ছিল আরও দু’একবার আসার তবে হকারদের উৎপাতে আর আসব না। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মেলার ভিআইপি গেট দিয়ে প্রবেশ করলে হাতে ডান দিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) অফিস ও পুলিশ কন্ট্রোল রুম। এর একটু সামনে এগোলে চোখে পড়বে হকারদের বেচা-বিক্রি। বিভিন্ন পণ্যের পসরা নিয়ে তারা হাজির হয়েছে মেলার ভেতরে। অথচ তাদের মেলাস্থলে মালামাল নিয়ে প্রবেশের কোন অনুমতি নেই। মেলার মেইন ফটকের আশপাশে একাধিক স্থানে চোখে পড়বে হকার। পায়েল থেকে শুরু করে রান্নার নুসনি পর্যন্ত হাকডাক করে হকাররা বিক্রি করছেন। তাদের কেউ খেলনা বা খাবারও বিক্রি করছেন। এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মেলার বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ীভাবে বসেছেন তারা। তামিম আহসান নামের এক বেসরকারী চাকরিজীবী বলেন, দেখুন অনেক সময় মেলায় হয়তো বিদেশী দর্শনার্থীও আসে। তবে তারাও বিরক্ত হয়, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এক হকার বলেন, স্যারদের ম্যানেজ করে ভেতরে আসি। এরপর এখানে বিক্রি শেষ করে চলে যাই। এ বিষয়ে কেউ কোন মন্তব্য করতে রাজি নন। একটি সূত্র জানিয়েছে মেলায় যত হকার তার সবই গেট ইজারাদারের কাছের লোকজন ইপিবির সঙ্গে সিটিং করে মেলায় জায়গা গিয়েছেন। ইপিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, কে কোন সিটিং করে আমার জানা নেই। আমরা মেলায় এসব ‘এলাও’ না করতে সবাইকে নির্দেশনা দেয়া আছে। হকাররা পণ্য বিক্রি করার কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও বিরক্ত। একাধিক প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, মেলায় আমরা একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসি। সেখানে যে কেউ যখন তখন যা তা বিক্রি করছে। দোষ হচ্ছে মেলায় অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর। একটি সূত্র জানিয়েছে গেট ইজারাদার মোঃ শহীদুলের এক নিকট আত্মীয় মুকুল এই হকার বাণিজ্যের নেতৃত্ব দেন। এদিকে ছুটির দিন দর্শনার্থী হয়তো পূর্বেও শুক্রবারের চেয়ে কমেছে তবে সংখ্যাটা যে লাখের কাছাকাছি তাই আশপাশ এলাকা বেশ যানজটই ছিল। দর্শনার্থীদের আসতে এবং মেলা থেকে যাওয়ার পথে গাড়ি বিড়ম্বনাও ছিল দেখার মতোই। অনেকেই হেঁটে বা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করেন। এদিকে, মেলার অভ্যন্তরে প্রচুর গরম অনুভূত হওয়ার কারণে সবাই কোমলপানীয় বা আইসক্রিমে ঝুঁকে পড়েন। তরুণীদের বেশির ভাগই ছিল জুয়েলারি, থ্রিপিস বা জুতার স্টলগুলোতেই। প্রতিটি থ্রিপিসের স্টলে একটি কিনলে একটি ফ্রি অফার দেখে ঝোক ছিল আরও বেশি। এছাড়াও নির্দিষ্ট করা ৩টি থ্রিপিস ৫০০ থেকে ৯৯৯ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এদিকে মেলায় এসে ছোট্ট শিশুরা মেতে উঠেন বিনোদনে। মেলায় অবস্থিত মিনি পার্কের বিভিন্ন রাইডে উঠে আনন্দে মেতে ওঠে শিশুরা। এবছর মেলায় প্যাভিলিয়ন, মিনি-প্যাভিলিয়ন, রেস্তোরাঁ ও স্টলের মোট সংখ্যা ৬০৫। এর মধ্যে রয়েছে প্যাভিলিয়ন ১১০, মিনি-প্যাভিলিয়ন ৮৩ ও রেস্তোরাঁসহ অন্যান্য স্টল ৪১২টি। এবার বাংলাদেশ ছাড়াও ২৫ দেশের ৫২ প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নিচ্ছে। দেশগুলো হলো থাইল্যান্ড, ইরান, তুরস্ক, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, পাকিস্তান, হংকং, সিঙ্গাপুর, মরিশাস, দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান। প্রতিদিন সকাল দশটায় শুরু হয়ে মেলা চলছে রাত দশটা পর্যন্ত। প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ৩০ টাকা ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ২০ টাকা টিকেটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো এবার অনলাইনে মেলার টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে এবারের বাণিজ্য মেলা ৮ দিন পিছিয়ে গত ৯ জানুয়ারি শুরু হয়েছে। শেষ হবে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি।
×