ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুয়ার খুলেছে প্রাণের বইমেলার

কাগুজে বইয়ের আবেদন চিরন্তন, জীবনকে ধরে রাখে...

প্রকাশিত: ০৯:৪৯, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

কাগুজে বইয়ের আবেদন চিরন্তন, জীবনকে ধরে রাখে...

সমুদ্র হক ॥ বই পড়ার অভ্যাস জীবনকে ধরে রাখে অনেকটা সময়। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইসে কম্পিউটার ল্যাপটপ, ট্যাবে ই-বুক (ইলেকট্রনিক বই) পড়ার প্রবণতা বেশি। মুদ্রিত (ছাপাখানা) বই বা কাগুজে বই পড়ার মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য চিরন্তনের। প্রতিবছর একুশের বই মেলা বাঙালীর হৃদয়ের একান্ত গভীরে নাড়া দেয়। কম্পিত মন ছুটে যায় প্রাণের বই মেলায়। চারদিকে বইয়ের বাগানের মধ্যে নিজেকে প্রকৃত বাঙালী হিসেবে তুলে ধরে। একমাসের এই বইমেলা বাঙালীর আবেগের, যা শুরু হয়েছে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে। একুশের বইমেলায় আশা জাগায় ছাপানো বই। বাঙালীর হৃদয় জুড়ে থাকে। বিশ্বায়নে ই-বুক বা পোর্টেবল ডকুমেন্ট ফরমেট (পিডিএফ) অবশ্যই থাকবে। একবিংশ শতকের তরুণের মধ্যে এই গ্রহণযোগ্যতা শুরুও হয়েছে। রবি ঠাকুর যেমন বলেছিলেন, বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ। সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে এর গতির এই আবেগ কতটা থাকবে! বিশ^বিদ্যালয়ের কয়েক তরুণের সঙ্গে কথা হয়। তাদের কথা- ইন্টারনেটে ট্যাবে বই পড়ে বেশিক্ষণ ধৈর্য রাখা যায় না। যন্ত্র যেভাবে পাঠ করতে বলে তার বাইরে যাওয়া যায় না। ভাবনার দুয়ার খোলে না। কোন ক্রিয়েটিভিটিও আনে না। যা পাঠ করা হয় তার নির্যাসের খেই হারিয়ে যায়। মনিটরের রেডিয়েশন মাঝেমধ্যে চোখ ধাঁধিয়ে চাপ বাড়িয়ে দেয়। ই-বুকের পজিটিভ দিকও আছে। বিশে^র যে কোন বই (যা ডিভাইসে যুক্ত আছে) ডাউনলোড করে রাখা যায়। কোন রেফারেন্সের প্রয়োজন হলে তা খোঁজ করা যায়। বেশিরভাগ সময় তা পাওয়াও যায়। অজানা অনেক কিছুই জানা যায় কোন লাইব্রেরিতে ঢুকে। ই-বুক দূরকে অনেক কাছে এনেছে। বড় মনিটরের উন্নত স্মার্টফোনগুলোয়ও নেটে বই পড়া যায়। তবে কথা একটাই- বিজ্ঞানের গতির বেগ কেড়ে নিয়েছে হৃদয়ের আবেগ। কাগুজে বই পড়ার একটা আলাদা আমেজ আছে, যা চিরন্তন। এই বই পড়তে ডিজিটাল যন্ত্রের সাহায্যের দরকার নেই। একটি বইয়ের প্রতিটি পাতার প্রতিটি শব্দ পড়ার সময় মনে হবে অনেক কথার মালা গাঁথা হয়ে যাচ্ছে। যে লেখক তার লেখনী শক্তিতে পাঠককে যত কাছে টানতে পারে সেই বই হৃদয়ের কম্পন এনে দেয়। যার লেখা যত ভাল তার লেখা ততই আদৃত হয়। যে লেখক সাহিত্যের ফ্লেভারে সহজ ভাষায় মানুষের জীবনের কথাগুলো তুলে ধরতে পারেন তার লেখা পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়। দেশে প্রতিবছর একুশের বই মেলাকে ঘিরে তৈরি হয় কবি সাহিত্যিকদের মিলন মেলা। পুরনো ও নতুন লেখক তৈরি হয় এই মেলায়। ঢাকার বাংলাবাজারের প্রকাশনা সংস্থাগুলোর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানের ছাপাখানাগুলোও অনেক বই প্রকাশ করে। একুশের মেলা আবর্তিত হয়ে স্থানীয় পর্যায়ের অনেক লেখক তাদের লেখক সত্তা তুলে ধরতে পারে। বাঙালীর জীবনে একুশ এভাবেও ভাষার মর্যাদাকে হিমালয়ের সমান চূড়ায় তুলে ধরে। একুশের বই মেলায় কত ধরনের বই যে প্রকাশিত হয় তার হিসাব পাওয়া কঠিন। এর মধ্যেই বাংলা একাডেমি প্রতিবছর নতুন বই প্রকশনার একটি হিসাব দেয়। গত পাঁচ বছরের এক খতিয়ানে দেখা যায় প্রতি বছরই ঢাকায় একুশের বই মেলায় নতুন বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর (২০১৮) নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে ৪ হাজার ৫৯১। ’১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৪৬। ’১৬ সালে নতুন বই আসে ৩ হাজার ৯৪৪। ২০১৫ সালে ছিল ৩ হাজার ৭শ’। ২০১৪ সালে নতুন বই মেলায় আসে ২ হাজার ৯৫৯। বই বিক্রির হিসাবে বলা হয় ’১৪ সালে বই মেলায় বিক্রি হয় ১৬ দশমিক ৫০ কোটি টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে গত বছর ২০১৮ সালের বই বিক্রি হয় ৭০ দশমিক ৫০ কোটি টাকার, যা চারগুণেরও বেশি। একুশের বই মেলা সাক্ষ্য দেয় প্রতি বছর মেলায়পাঠক ও দর্শনার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। একটা সময় যে বইমেলা বাংলা একাডেমির চত্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল চিত্তসাহার মতো প্রকাশকের কল্যাণে তা আজ সম্প্রসারিত হয়ে সামনের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনেকটা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। বেড়েছে স্টলের সংখ্যা। প্রতিবছর একুশের বই মেলা শুরু হওয়ার সঙ্গেই দেশজুড়ে বাঙালীর হৃদয়ে আলাদা একটা আমেজ চলে আসে। যারা ঢাকায় থাকেন নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয় এই মেলায়। বই মেলা যতদিন চলে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ একটিবারের জন্য হলেও বই মেলা ঘুরে আসেন। এ যেন প্রাণের গভীরের দাবি- যেতেই হবে বই মেলায়। বই মেলার নির্মল আড্ডা বাঙালীর প্রাণের আবেগ। কত কবি কত সাহিত্যিক কত সাংবাদিক কত লেখক এই মেলায় পদধূলি দেন। এ যেন তাদের জীবনের মেলা। গত বছর থেকে একুশের বইমেলায় অধিকাংশ স্টলে কাগজের বইয়ের পাশাপাশি ই-বুকের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। পাঠক আকর্ষণে বইয়ের প্রচারে ডিজিটাল ডিভাইসে বহুমূখী প্রয়োগ শুরু হয়েছে। প্রজন্মের তরুণ তরুণীরা কাগজের বইয়ের সঙ্গে ই-বইয়ের স্বাদও পাচ্ছে। অনেক বই পিডিএফ ভার্সনে পাওয়া যাচ্ছে। তরুণদের কাছে তা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়েও উঠছে। প্রকাশকরাও কাগজি বইয়ের সঙ্গে ই-বুক ও পিডিএফকে এগিয়ে দিচ্ছে। এত কিছুর পরও কাগজে বইয়ের আবেদন চিরন্তন হয়ে থাকছে মধ্য বয়সীদের সঙ্গে এ কালের তরুণদের মধ্যে। কাগজি বইয়ের পাঠক সংখ্যাও বাড়ছে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের এক জরিপে বলা হয়েছে ২০১৬ সালে তাদের পাঠক সংখ্যা ছিল ৪৫ লাখ। এর মধ্যে নারী পাঠক ছিল ৫৫ শতাংশ। বাংলা একাডেমির এ ধরনের কোন হিসাব মেলেনি। তবে কাগজি বইয়ের পাঠক যে এখনও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাড়ছে সেই আঁচ পাওয়া যায় প্রতিবছর একুশের বই মেলায় নতুন বইয়ের আগমনে। বই পড়ার বিষয়ে বিশিষ্ট লেখক প্রবীণ ব্যক্তি বজলুল করিম বাহার বলেন, নিকট অতীতে এ দেশের প্রায় প্রতিটি বনেদী বাড়িতে ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল। বই পড়ার অভ্যাস ছিল প্রায় প্রতিটি বাড়িতে। ওই সময়ে বিয়ে শাদীর অনুষ্ঠানে বই উপহার দেয়ার রেওয়াজ ছিল। তিনি বলেন, সাহিত্যের মনোজগত দীর্ঘ, গভীর। সাহিত্যে নৈতিক এনরিচমেন্ট চিত্তের আলোকায়ন। যা সুদূর মেয়াদে ভূমিকা রাখে। আর লেখক সত্তা হলো : অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার। যিনি প্রকৃত লেখক তিনি যা কিছু দেখেন, না লিখে থাকতে পারেন না। কাগজি বই এই লেখা ধরে রাখে। আজকে ডিজিটাল ডিভাইসে যা আসে তাও কাগজি বইয়ের ডিজিটাল পিডিএফ সংস্করণ।
×