ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জয়নব কুলসুম

চিৎকার

প্রকাশিত: ১২:৫১, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

চিৎকার

একদল লোক কখনও সংঘবদ্ধভাবে, কখনও বিক্ষিপ্ত পলায়নপর উদ্দাম গতিতে, কখনও এলোমেলো ভীতসন্ত্রস্ত পদে খণ্ড খণ্ড মনুষ্য মিছিলে পরিণত হয়ে শস্যবিহীন ধু-ধু মাঠটিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে পাড়ি দিয়ে চলেছে। কোথায় যাবে জানে না তবে গন্তব্য একটিই, এই মুহূর্তে যা তাদের জানা নেই, যা নাকি শাখা প্রশাখা বিস্তৃত সুপরিসর বৃক্ষের ছায়াতল নিশ্চিন্ত নিরাপদ স্থান, যেখানে তাড়া খাওয়া ভয়ার্ত কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। শ্রান্ত ক্লান্ত দেহটিও পিপাসার্ত ভয়ঙ্কর এক আজলা জল, আর কিছু নয়। ন্যূনতম এ দুটির চাহিদা নিয়ে ধু-ধু প্রান্তর জুড়ে দলটির ছোটা আর ছোটা। প্রাণটি যে এখনও তাদের হৃৎপি-ে ধুঁকপুক করছে অর্থাৎ তারা বেঁচে আছে। পেছনে তো শুধু লাশ আর লাশ। স্তূপীকৃত ওই লাশের ওপর নিজেরাও যে আরও কয়েকটি লাশ হয়ে যেতে পারত। এলোপাতাড়ি বুলেট যখন এদিক ওদিক ফসকে গিয়ে অন্যদিকে বিস্ফোরিত হতে লাগল তখনই কেউ কেউ সুযোগ পেল পালিয়ে আসবার। পেছনে ফেলে এলো প্রিয়জনের রক্তাক্ত দেহগুলো। বেঁচে নেই! কেউ বেঁচে নেই! শুধু মেয়ে লোকদের ধরে নিয়ে গেছে জ্যান্ত। মাংসের মতো তাদের চিবুবে। পৈশাচিক উল্লাসে রক্ত চুষে চুষেও খাবে। খোঁয়াড় থেকে ধরে নিয়ে গেছে দুটি ষাঁড়। আর সের পাঁচেক দুধ দেয় দুধেল একটি গাইও। তার পর ওই বাড়ির অস্তিত্ব বলতে আর কিছু নেই। দাউ দাউ করে জ্বলছে, আগুনের ফুলকি আর চৈত্রের দাবদাহের মতো প্রবল বাতাস যোগ হয়ে দ্বিগুণ করেছে সর্বগ্রাসী ওই আগুনকে। বাকি এখন ছাই ভস্মে পরিণত হওয়া। পেছন ফিরে দেখারও কারও সাহস নেই। তবুও ফিরে তাকাল সেই গৃহী, প্রিয় কুঁড়ে ঘরগুলো শেষবারের মতো দেখতে। সেদিকে লক্ষ্য করেই মিছিলের মধ্য থেকে এবার যুবক শ্রেণীর দু’জন ধমকে উঠল তার উদ্দেশ্যে- থামলেন কেন? দেখছেন কি পেছন ফিরে? আপনিও মরবেন, সেই সঙ্গে আমরাও মরব। পা চালান জোরে- আরও জোরে জোরে- নইলে... অবশেষে বড় একটি শিমুল গাছের তলদেশ খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু প্রকা- ওই বৃক্ষের ফুলের বাহার যত, পাহাড় বাহার তত নেই তাতে। নিস্তেজ নিরুত্তাপ ছায়াটি তলানির মতো পড়ে আছে শুধু নিচে। আশপাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাটির ঢেলা ছোট-বড়। রুক্ষ্ম ঘাস ভর্তি মাঠ। মানুষের মিছিলটি তাতেই যে যার মতো বসে পড়ল। পাশেই একটি কুড়েঘর। সেটিকেও তারা পুড়িয়ে গেছে। পুড়িয়ে দেয়াই শুধু নয় মাটির হাঁড়িকুড়ি জলের দুটি কলসিও অক্ষত রাখেনি। ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেছে। পুড়ে যাওয়ার পর কুড়ে ঘরটির বাঁশ কাঠের খুঁটিগুলো অর্ধদগ্ধ হয়ে তখনও ধোঁয়ার কু-লি ছড়াচ্ছে। ওঠানের ঢালে নিচে কয়েকটি কলাগাছ। দাহ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার যো নেই যেহেতু পোড়াবার চেষ্টাও তাই করিনি। এক কাঁদি কলা যে তাতে ছিল- খাকী পোশাকের নরপশুরা সেটিকে নিয়ে গেছে। এখনও তার কষ ঝরছে নিচে। মোচাটা শুধু পড়ে আছে দূরে। শ্রান্ত ক্লান্ত দলের মধ্যে থেকে দু-তিনজন প্রায় ওর ওপরই হামলে পড়ল। খোলস খুলে খুলে ভেতরের রস খুঁজতে চিবুতে লাগল প্রাণপণ অর্থাৎ মুখের ভেতরের শুষ্কতা তো কাটবে। মনে প্রশ্ন জাগল, মাঠের ঠিক এই মাঝখানে কুড়েঘরটিতে কি লোকজন কেউ থাকত না? ছড়িয়ে ছিটিয়ে একটি লাশও এখানে নেই! হতে পারে বুলেটে বাজি ফোটাত ফোটাতে জানোয়াররা মাতম করতে করতে যেভাবে আসছিল- চারপাশ খোলা আর দেখা যায় বলে তাদের আসবার আগেই ভাগতে পেরেছে তারা। তখন কাউকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত পশুর দল ঘরগুলো পুড়িয়েছে। সামনে যতটুকু যা পেয়েছে নির্বিবাদে সেগুলো ধ্বংস করে গেছে। না ভাঙলে জলের কলসিতে এক আজলা জলও তো পাওয়া যেত। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়া সেই মনুষ্য মিছিলটির এতক্ষণে যেন পরস্পরের দিকে তাকাবার সুযোগ হলো। গ্রামের কৃষক সাত-আটজন, কলেজের ছাত্র পাঁচ-ছয়জন। নারী বিবর্জিত শুধু পুরুষের দল। ব্যতিক্রমের মধ্যে অল্প বয়সী মেয়ে শিশু যে একজন আছে, বয়স-বছর ছয়-সাত হবে। বাপের কাঁধে উঠে এতদূর পালিয়ে আসতে পেরেছে বটে- ঘটনার আকস্মিকতায় আতঙ্কে নির্বাক নিশ্চুপ হয়ে এখন সে কেবল ফ্যালফ্যাল করে এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। যাদের দিকে তাকাল তারাও তো নির্বাক নিশ্চুপ একেবারে প্রাণস্পন্দনহীন। কী হয়েছিল তাদের পেছনে? কী দোষ হয়েছিল গৃহস্থের ওই বাড়িঘরগুলোর? দুর্বৃত্তরা তাকে ছাই ভস্মে পরিণত করতে আক্রশ আর ওমন তা-বের আশ্রয় নিল কেন? ছাত্তর বাজানরা তার ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল তাই! নাইট শোর সিনেমা দেখে ফিরছিল যখন হলে, ঢোকার আগেই ব্রাশ ফায়ারের মুহুর্মুহু শব্দ শুনল তারা। বিল্ডিং কাঁপিয়ে কামানের শব্দের মতো বিধ্বংসী আওয়াজ আর হলের বাইরে বস্তির ঘরগুলো জ্বালিয়ে দেয়া-পুড়িয়ে দেয়া তো আছেই, পুলিশ লাইনেও তখন শুরু হয়েছে গোলাগুলি। সব মিলে ঢাকা শহর দাউ দাউ করে জ্বলছে। আর এক মুহূর্তও নয়- উল্টো দৌড় শুরু করল ছাত্রের দল। প্রাণান্তকর দমবন্ধ দৌড়ে অনুমানের ওপর ভর করেই আশপাশের গ্রামগুলোর কাছাকাছি যখন হয়েছে- হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল এক গৃহস্থের কুঁড়েঘরে। কিন্তু কাউকে বাঁচতে দেবে না জানোয়াররা। হলের কুকুরদেরও খতম করেছে খতম করতে হবে এদেরও। তারপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। দলের ভেতর আরও একজন হতদরিদ্র লোকও আছে। শরীরটাকে কুকড়ে মুকড়ে- বুঝিবা সঙ্গের লোকদের সংস্পর্শ বাঁচিয়েই আলাদা হয়ে বসবাস চেষ্টা করছে। সমস্যা পরনের লুঙ্গিটা-শতছিন্ন ওই বস্তুটির পরনে থাকা না থাকা সমান। টেনেটুনে একদিকে ঢাকতে গিয়ে অন্যদিকে যাচ্ছে অনাবৃত হয়ে। -তুম হিন্দু হ্যায়? খতনা কিয়া-দেখাও! নিষ্ঠুর উল্লাসে উলঙ্গ করে দিতে না দিতেই তাদের খপ্পর থেকে পিছলে কী করে যে দৌড়ে বেঁচে আসতে পেরেছে সৃষ্টিকর্তাই তা বলতে পারেন। বার বার তার উদ্দেশ্যে দু’হাত জোড় করে কপালে এখন ঠেকাচ্ছে। রুজি রোজগারের একমাত্র সম্বল ছুরি, কাচি, দাড়ি কামাবার ক্ষুর সমেত ক্ষুদ্র কাঠের বাক্সটি সন্তানের মতো তাকেও বাঁচিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছে। বগোলের তলদেশ থেকে সেটিকে মাটিতে নামিয়ে রেখে এতক্ষণে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। ঘর পুড়ে যাওয়া সেই গৃহস্থ গভীর মনোসংযোগ নিয়ে তার কাঠের বাক্সটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগল। -কী দেখছ রহমান ভাই? আমার এ কাঠের বাক্সটা! তুমার যে ভাই সব জ্বলে পুইড়্যে ছাই ভস্ম হয়ে গ্যাছে! কিচ্ছু তো নাই ওখানে- বলেই নাপিত লোকটি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। রহমান ভাইয়ের ছোট মেয়েও তখন ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। -মা মরা দুই মিয়ে তুমার- একটাকে কাঁধে তুইল্যে নিয়ে বাঁচাতি পারলা, বড়টারে তো পারলা না। ওরা যে ধইরে নিয়ে গ্যালো- দর দর করে গাল ভেসে যেতে লাগল নাপিত লোকটার। -পেত্তেক দিনের লাহান ঘোম থিকে তুইল্যে হাত মুখ ধোয়ায়ে কাপড় চোপর পরায় দিছ- কুটি মিয়েটার চুলের ঝুঁটিও সোন্দর কইরে‌্য বাইন্ধ্যে দিছ- তারপর ওই জানোয়াররাই না বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বিলাপ আর বোঝা গেল না বরঞ্চ যার উদ্দেশ্যে এই বিলাপ- প্রস্তরসম স্তব্ধতায় সে বসে আছে একই ভাবে। দৃষ্টি নিবদ্ধ শুধু ওই কাঠের বাক্সের দিকেই। -কী আছে ওতে নেতাই নাপতে? ছুরি, কাচি, দাড়ি কামাবার ক্ষুর? -হ্যাঁ গো তাই আছে। ওগুলিন দিয়া কী করবা তুমি? ওই জানোয়ারদের সঙ্গে যুদ্ধ করবা নাকি? -কৃষক একজন উল্টোমুখো হয়ে বসেছিল; সেই যেন তাচ্ছিল্যের সুরে উত্তর দিয়ে দিল। -যা বলিস নেতাই নাপতে! বাক্স খুইল্যে ছাত্তর বাজানদের হাতে তুইল্যে দাও- ওরাই ওগুলিন লিয়ে যুদ্ধ করুক। -আহ্ থামাও তো দেখি তুমাগো প্যাচাল-রহমান ভাই ধমকে উঠল। তারপর নিতাই নাপিতের উদ্দেশে বলল- তুমার বাক্সটা আমাক দিবা? -কেনে গো? -কাচি আছে নাকি কাচি? -হ্যাঁ হ্যাঁ আছে! চুলকাটার কাচি তো- আছে। কিন্তুক- কোন উত্তর না দিয়ে কাচিটি হাতে নিল রহমান ভাই। যত্নের সঙ্গে কোলে বসিয়ে নিল তার ছোট মেয়েকে। দুই আঙ্গুলের ফাঁকে কাচিটি ধরে প্রথমে তার লাল ফিতায় বাঁধা চুলের ঝুটি- তারপর লম্বা লম্বা চুলের গুছিও ঘচ ঘচ করে কেটে দিতে লাগল। খুলে দিল লাল নীল রঙের ফ্রকটিও। এরপর মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আত্মগতভাগে বলে উঠল, বাহ্! এই তো হয়া গেল- ব্যাটা ছেইলে ছাওয়াল একজন। মিয়ে নয়। কেউ আর তোর বুর মতন মেয়ে লোক বুইল্যে ধইরে‌্য নিয়ে যাতি পারবে না। খোঁচা খোঁচা মাথাময় চুলকাটা। ফ্রক খুলে নেয়া-খালি গা। অতর্কিত এই কান্ডে ছোট মেয়েটি হতবুদ্ধির মতো কাঁদতে লাগল। তার চাইতেও দলের অন্যরা রহমান বাইয়ের কা- দেখে আরও হতবুদ্ধির মতো চেয়ে রইল। নিতাই নাপিত হাহাকার করে উঠল- আ হা হা মিয়েডার ওমন সোন্দর চুলগুলো-কাকের বাসার মতোন এ্যাবড়ো খেবড়ো কইরে কাইট্যে দিলে ক্যান রহমান ভাই? আমাক বুলল্যিই তো পারতা- বলেই দরদ ভরা গলায় সে কাছে এগিয়ে এলো- আস-মা- আস কাইন্দো না- সোন্দর কইরে‌্য তুমার চুলগুলি আমি সাইজ করে দিই। নির্লিপ্ত চেহারা রহমান ভাইয়ের। দুই চোখে ভর করেছে অশ্রু সমুদ্র। গাল বেয়ে নেমে আসতে লাগল তার বাঁধভাঙ্গা স্রোত। আপন মনে বলতে লাগল-বুঝলা নেতাই নাপতে, আমার বড় মিয়েডার বয়স বেশি না, দেখতেই কেবল ডাগর ডোগর। তারে জোয়ান মদ্দর জানোয়াররা ধইরে‌্য নিয়ে গ্যাছে-ওদের অত্যিয়েচার আমার কচি মিয়েডার সহ্যি হবে নাগো, সহ্যি হবে না!! তুর্দিক চৌচির করে রহমান ভাই চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
×