ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কি যেন হারিয়ে এলাম ॥

প্রকাশিত: ১২:৪৮, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

কি যেন হারিয়ে এলাম ॥

পূর্ব প্রকাশের পর ইতোমধ্যে ১৯৫৭ সালের শেষ দিকে ডিসেম্বর মাসেই আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকের সুপারি বাগান থেকে, সুপারি পাড়তে গিয়ে প্রায় ২৫-৩০ ফুট সুপারি গাছের মাথা থেকে কখন যে পড়ে গিয়ে বাড়ির মা-আব্বা, ভাইবোনকে কাঁদিয়ে জ্ঞানহীন অবস্থায়, পাবনা শহরের পেটের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা, সদর হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হয়ে প্রায় মাস খানেক থাকার পর দোহারপাড়ায় ফিরলাম বটে। ফিরে এসে সেই আগের মতো খেজুরের রসের প্রতি, গাছি হওয়ার প্রতি কেমন করে যেন উৎসাহে ভাটা পড়তে কখন যে শুরু করেছিল ঠিক বুঝতে পারিনি। তবে সেই ১৯৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসেই পাবনা সদর হাসপাতালের সামান্য দক্ষিণে যে অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি দাঁড়িয়ে আছে এবং সেই লাইব্রেরির পশ্চিম দিকেই দাঁড়িয়ে থাকা বনমালি ইনস্টিটিউটের পশ্চিম দিকে ইছামতী নদী আর পূর্বদিকের অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির সামনে দিয়ে পিচঢালা যে রাজপথটি ঈশ্বরদী গিয়ে তখনকার দিনে শেষ হয়েছিল, সেই পাবনা ঈশ্বরদী রাজপথে, বনমালি ইনস্টিটিউশন এবং অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির ঠিক সামনেই একদিন এক মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গেল, ঘটনাটি লাহিড়ীপাড়া অথবা দিলালপুরের জৈনক হিন্দু ভদ্রলোক পাবনার রোডস এ্যান্ড হাইওয়েজের অথবা সিএ্যান্ডবি নাকি অন্য কোন বিভাগের রাস্তা ঠিক করার একটি ‘রোলার’ অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির এবং বনমালি ইনস্টিটিউটের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া, পাবনা ঈশ্বরদী, সেই পিচঢালা রাজপথে, লাহিড়ীবাবু নাকি গুহ বাবুকে, সেই কয়েক টন ওজনের রোলার চাপা দিয়ে একদম রুটির মতো বানিয়ে ফেলেছিল। সারা পাবনা শহরে হৈ, হৈ, রৈ, রৈ কাণ্ড- এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা? প্রশ্নটা ছিল ওই রকমের তবে লাহিড়ী বাবু-গুহ বাবুদের যিনি মারা গেলে, তিনি তো চিড়ে চ্যাপ্টা হয়েছে, শহরের উত্তর দিকের ‘শিঙ্গা’ শ্মশানে গেলেন তবে শ্মশানে যাবার আগে পুলিশী ঝামেলা থেকে রোলার ড্রাইভারকে মুক্ত করলেন, ওই লাহিড়ী বাবু বা গুহ বাবুর আত্মীয়স্বজনেরা, তারা পুলিশকে জানালেন যিনি রোলারের চাপায় নিহত হয়েছেন, তিনি কানে শুনতেন না। কানে না শোনার খেসারত তাকে দিতে হলো ওই ৫-৭ টন রোলারের নিচে। আমি সদর হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই আমার মামাত ভাই মোগল ভাইয়ের নিকট থেকে শুনলাম, সেই হিন্দু ভদ্রলোকের রোলারের নিচে চাপা পড়ে সকরুণ মৃত্যুর কথা। খুবই খারাপ লেগেছিল তখন, আরও খারাপ লাগছিল, এই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে, প্রায় মাস খানেক হয়ে এলো, আমাকে ছাড়বার কোন লক্ষণই দেখাচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, একদিন এক ডাক্তার সাহেব গলার ব্যান্ডেজ খুলে আমার কলার বোনটি টিপে টুপে দেখে, আরও গোটা দুয়েক এক্স-রে নেয়ার হুকুম দিয়ে আমার বাবাকে বললেন, এক্স-রে দেখে যদি বুঝি ভাল, তাহলে ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই ছেড়ে দেব, আর যদি... আমার কপাল ভাল প্রায় ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই আমার ভাগনি বকুল খবর দিল, কিছুক্ষণের ভেতরেই মামা আপনাকে ডাক্তার সাহেব ছেড়ে দেবেন। বকুলের কথা শুনে তখনই মনে হলো, একদৌড়ে যদি দোহারপাড়ার রাস্তায় যেতে পারতাম। আমার বাবা শহরের কাপড়পট্টি থেকে আমার জন্য একটি লুঙ্গি ও একটি গামছা কিনে সঙ্গে গোটা কয়েক ইলিশ মাছসহ আমাদের পাড়ারই এক রিক্সাওয়ালার রিক্সায় চেপে সোজা চলে এলাম দোহারপাড়ার বাড়িতে, আমাকে দেখেই প্রথমে কাঁদলেন আমার মা রহিমা খাতুন পরে ঝর্ণাবু হেনা- অথচা ওই হেনাকে মারধর করেই আমি আর আমার মেজ চাচার ছোট মেয়ে কনা গিয়েছিলাম ওই সুপারি বাগানে, সুপারি পাড়তে। আমার বাড়িতে ফেরার খবর কয়েক মুহূর্তের ভেতরেই সব শরিকের ভাই-বোনদের কাছে পৌঁছাতে বেশি সময় না লাগায়, উঠোন ভর্তি হয়ে গেল আমাকে দেখার জন্য। আমি কি বাঘ না ভাল্লুক? কথাটি জিজ্ঞেস করলাম ফনি ভাইকে। ফনি ভাই তার উত্তরে জানালেনÑ তুই বাঘ ভাল্লুক কিছুই না, তুই হলি সুপারি গাছ। এখন থেকে আমরা তোকে সুপারি গাছ বলে ডাকব। যেহেতু আমাদের বংশের কেউ কোন দিন সুপারি গাছ থেকে পড়েনি, সেই দিক থেকে তুই-ই প্রথম, অন্যদিকে তুই অত উঁচু সুপারি গাছ থেকে পড়ে গিয়ে বেঁচে গেলি অথচ হাবীব চাচার ছেলে বিশু, বাদশা ভাইয়ের দ্বিতীয় মায়ের ছেলে আমাদের রবি ভাই, সিঁদুরে আমগাছ থেকে আম পাড়তে গিয়ে সামান্য আট দশ ফুট উপর থেকে পড়ে গিয়ে লাঞ্চই নাকি ফেটে গিয়েছিল, যার ফলে রবি ভাই মারা গেলেন। তুই যে হাসপাতালে ছিলি সেই হাসপাতালেই। সেদিক থেকে তোর কপাল অনেক ভাল, তুই ফিরে এসেছিস আমাদের সকলের কাছে আর আমরা সকলে মিলে, আগামী মাস থেকে জিসিআই স্কুলে যাব তোকে রশীদ ভাই, ক্লাস ফাইভে ভর্তি করে দিয়েছে, দিন কয়েক আগে। আর কিছুদিন শুয়েটুয়ে থেকে শরীটাকে ঠিক করে নিয়ে আমাদের দলপতি মোতালেব হোসেন ফনির নেতৃত্বে দোহারপাড়া থেকে জাম্বুরা বা বাদাম দিয়ে ফুটবল খেলতে খেলতে রাস্তার লাল শুড়কির ধুলা উড়াতে উড়াতে, আমরা একদল রওনা দিলাম সেই জিসিআই স্কুলের দিকে, সেই দলে থাকত আপন ভাই, চাচাত ভাই, পাড়াত ভাই- সব মিলে ১২-১৫ জন। বোকাসোজা বাবলু, থাকত দলের সবার পেছনে, আগের দিন থাকত খোকন, রাজা, রতন, স্বপন, আব্দুল্লাহ, হাচেন, কায়েস, আজিজুল এবং আমি। আরিফপুর থেকে আসত আমীর হামজা মোক্তার, মোসলেম এক বিশাল দল নিয়ে, আমাদের ফনি ভাই স্কুলে যেতেন বেলা প্রায় সোয়া এগারোটা-সাড়ে এগারোটার দিকে। ওদিকে স্কুল শুরু হওয়ার আগে জিসিআই স্কুলের ভেতরেই চার কোনা মতো ছোট একটি মাঠ আছে, সেই মাঠেই হতো ন্যাশনাল এ্যান্থেম ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ।’ এতগুলো পড়ুয়াকে ম্যানেজ করে স্কুলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ন্যাশনাল এ্যান্থেম মাঝে মধ্যে শেষ হয়ে গেলেই হতো যত অসুবিধা। এই সব পড়ুয়ার পায়ে জুতা-স্যান্ডেলের যে অবস্থা হতো, তা ভাষায় বর্ণনাতীত। কেননা আমরা আমাদের জাম্বুরা গাছ থেকে দুই-তিনটে জাম্বুরা পেড়ে, বাড়ির সামনের বড় রাস্তায়, সেই দোগাছি রোডে উঠেই শুরু হয়ে যেত ফুটবল খেলা, ফুটবল খেলতে খেলতে পাবনা পলিটেকনিক স্কুলের পশ্চিম দিকে জামতলা অবধি আসতে না আসতেই কারও না কারও স্যান্ডেলের ফিতা অথবা জুতার মাথা কারও না কারও ছিঁড়বেই, সেই সঙ্গে ডান বা বাঁ পায়ের নখে আঘাত লাগিয়ে রক্ত ঝরিয়ে স্কুলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে স্বভাবতই ন্যাশনাল এ্যান্থেম প্রায়ই আমাদের স্কুলে পৌঁছানোর আগেই শেষ হয়ে যেত। ন্যাশনাল এ্যান্থেমের প্রধান উদ্যোগী ছিলেন স্কুলের হেড মাস্টার মথুরা নাথ। তাঁকে অন্যান্য শিক্ষক সাহায্য সহযোগিতা করতেনই, সব চেয়ে বেশি সহযোগিতা করতেন আমার ড্রিল স্যার। ড্রিল স্যারের দায়িত্ব ছিল, হুইশেল বাজিয়ে লাইন ঠিকমতো হয়েছে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখা। পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ঠিকমতো মাথার উপরে ক্লাস নাইনের ক্যাপ্টেন ছেলেটি ঠিকঠাক মতো তুলে ধরেছে কিনা এবং প্রতিটি ক্লাসের ক্যাপ্টেনদের লাইনের সামনে আছে কিনা, এ সবরই দেখভালের দায়িত্ব ছিল সেই ড্রিল স্যার দিলীপ চাকীর। এতসব কিছুর পরেও ফনি ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা যারা স্কুলে যেতাম-আসতাম, তারা কোনদিনই জানতে পারিনি, ফনি ভাই লুকিয়ে লুকিয়ে সিজার সিগারেট খায়। একদিন স্কুলের উত্তর দিকের পাবনা জিলা জজকোর্টের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখি, আমাদের ফনি ভাই বেশ মজা করে একটি আম গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন। তিনি আমাকে ডেকে পকেট থেকে একটা সিজার সিগারেট আমার মুখে জোর করে তুলে দিয়েই ক্ষান্ত না হয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন- মোতালেব হোসেন ফনি, এত বোকা নয়, তুই যদি আমার সিগারেট খাবার কথা, বাড়িতে গিয়ে আব্বা-মাকে বলে দিস, তাই তোকেও খাওয়ালাম। আমিও বড় চাচা মিয়াকে, বড় চাচি মাকে, দুলাল ভাইকে (রশীদ হায়দার) গিয়ে বলে দেব, তুই প্রতিদিনই সিগারেট খাস, আর কালা শাজাহানের নিকট থেকে লোকোদানা, চিনে বাদাম, বাকি করে কিনে খাস, আমি দলপতি ফনি ভাইয়ের কথা শুনে ফনি ভাইকে বললাম- তুমিই আজ থেকে আমার গুরু হলে, সিগারেট খাওয়ানো। ঠিক সেইদিনই বেলা ১২টা ১টার দিকে শুনলাম ‘মার্শাল ল’ নামের একদল মিলিটারি, ঢাকা নাকি করাচী থেকে পাবনা শহরে এসেছে, পাঠিয়েছে দেশের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং আইয়ুব খান, সময়কাল ছিল ১৯৫৮ কিংবা ১৯৫৯ সাল। ইতোমধ্যেই আমরা হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা দিয়ে কয়েকজন ক্লাস সিক্সে উঠব উঠব করছি অথচ আমাদের দলপতি ফনি ভাই সেবারও ক্লাস সিক্সেই হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় পাস না করে করলেন ফেল। তিনি আমাকে একদিন জানালেন, রমেশ স্যার তাকে দেখতে পারেন না, মোজাহার স্যার দিন কয়েক আগেও তাকে অকারণে পিটিয়েছিলেন। ওই বছর খুবই সুন্দর দেখতে আবদুস সামাদ নামের এক ইংরেজীর স্যার খ-কালীন স্যার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন জিসিআইতে। খুব সম্ভব তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ পরীক্ষা দিয়েই খ-কালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আমাদের জিসিআই স্কুলেতে আবদুস সামাদ অকারণেই ছাত্রদের পেটাতেন, দু-কটি ইংরেজী শব্দের অর্থ না জানার জন্য প্রায়ই আমি মার খেয়েছি আর ফনি ভাই তো প্রায় প্রতিদিনই খেতেন। ফনি ভাই-ই একদিন বললেন- ওই শালা আব্দুস সামাদ আমাকে ইংরেজী পরীক্ষার খাতায় মাত্র ৩ নম্বর দিয়েছে। বুঝলি রোকন, আমি এই বাজে স্কুলে পড়ব না, ফনি ভাই সত্যই স্কুল ছেড়ে দিলেন পরের বছর ১৯৫৯ সালে। আর আমার যতদূর মনে পড়ে সেই বছরে গোপালপুর, দিলালপুর, লাহিড়ীপাড়া থেকে অনেকগুলো ছেলে জিসিআইতে ভর্তি হয়েছিল এবং এই ভর্তি করানোর পেছনে সবচাইতে বেশি অবদান রেখেছিলেন আমাদের বাংলার স্যার বিমল বাবুল, বিমল ভৌমিক সেই অনেকগুলো ছেলের ভেতরে একটি ছেলে ছিল চোখে পড়ার মতো দেখতে সুন্দর, বেশ মোটা এবং একই সঙ্গে বেশ খাটো, তবে তার পোশাক দেখে যে কেউই বলে দিতে পারতেন, ছেলেটির মা ছেলেটিকে স্কুলে পাঠাবার আগে বেশ যত্ন-আর্তি করেই প্রতিদিন স্কুলে পাঠাতেন। জিসিআই স্কুল চত্বরের পূর্বদিকের পানির-কলের পার্শ্বেই চানাচুর চিনেবাদাম, লোকোনদানা, চুরমুর খাস্তার পশার সাজিয়ে সাধুপাড়ার কালা শাজাহান প্রতিদিন যে ভাবে বিক্রি করতো আজকেও ঠিক সেই ভাবে করছিল, সেই সুবেশ সুশ্রী ছেলেটির কাছে ১ আনার চিনেবাদাম, ২ পয়সার চুরমুর খাস্তা এবং ২ পয়সার লোকোনদানা। চিনি, নারকেল এবং ময়দা দিয়ে তৈরি করা হতো সেই লোকোনদানা এবং খেসারীর ডাল দিয়ে তৈরি হতো চুরমুর খাস্তা এবং মাঝে মাঝে সাধুপাড়া, কাচারীপাড়ার ছেলেরা বিক্রি করতো মোকাররম হোসেনের আইসক্রিম ফ্যাক্টরির লাল টকটকে আইসক্রিম। সেই লাল, সবুজ আইসক্রিমেরও মূল্য ছিল ১ আনা, তবে দুধ মিশানো আইসক্রিমগুলোর মূল্য ছিল ২ আনা, যেটা আমি কোনদিনই কিনতে পারিনি, মাঝে মাঝে কিনতে দেখতাম সেই সুবেশী, মোটা এবং তুলনামূলক খাটো ছেলেটিকে। ছেলেটি আমার চেয়ে দুই ক্লাস নিচে পড়তো। চতুর্থ শ্রেণীতেই সে এসে ভর্তি হয়েছিলো বা তাকে বাড়ি থেকে ধরে এনে ভর্তি করেছিলেন আমাদের বিমল ভৌমিক স্যার। পাবনা বাণী সিনেমা হলের ম্যানেজার ভানুবাবুর ছেলে হারুদাস ছিলো আমার সহপাঠী, প্রায়শই দেখতাম স্কুল ছুটির পরে আমার অন্যান্য সহপাঠী আশীষ রাখাল রায়, দীপক রায় এবং হারু দাসের সঙ্গে সেই ছেলেটিও একদল হয়ে ফিরে যেত বাড়ির দিকে। আশীষের বাবা ছিলেন পাবনা বিখ্যাত উকিল প্রভাত কুমার রায়, দীপক রায়ের বাবা ছিলেন একটি লন্ড্রির মালিক এবং একাধারে স্কয়ার ঔষধ কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। সবই জেনেছিলাম সহপাঠীদের নিকট থেকে, কার বাপ কে, কি করেন। একদিন কৌতূহলবশত হারুকে জিজ্ঞেস করলাম, তোদের মাঝে মোটা এবং দেখতে সুন্দর ছেলেটি কি কোন পুলিশ অফিসারের ছেলে নাকি? নাকি তোদের পাড়ার, পাবনা সদর হাসপাতালের, ডাক্তার সাহেবের ছেলেটেলে কিনা। হারুদাস খুবই নির্বিকারভাবে বললো, না-না সেসব কিছুই নয়, ঐ ছেলেটি মানে সামসুলও হচ্ছে আমাদের বাবুজান কাকার বড় ছেলে ওদের ভাড়া করা বাড়িটি বাণী সিনেমা হলের পশ্চিম দিকে আমাদের বাড়ির কাছেই। বাবুজান কাকা, আমার বাবা এরা সকলেই বাণী সিনেমা হলের বিভিন্ন বিভাগে কাজ করেন এবং বাবু কাকার বিশেষ বন্ধু বাণী সিনেমা হলের মালিক ইউনুস সাহেব। ওরা নাকি কলকাতার লোক, কলকাতা থেকে এসেছে, বাণী সিনেমা হলের গাঘেঁষে উত্তর পাশে যে রেডিও মাইক এবং মোটর গাড়ির ব্যাটারির দোকানটি আছে সেটা সামসুলদের। সেই দিনই প্রথম জানলাম ছেলেটির নাম। আমাদের দলপতি মোতালেব হোসেন ফনি ভাই লেখাপড়া ছেড়ে দেয়ায়, দোহারপাড়া, আরিফপুরের ছেলেদের দলপতি আমি হয়ে গেলাম। আমাদের বাড়ির সব ছেলেকে আশপাশের বাড়ির হাচেন, আজিজুল আব্দুল্লাহ, শহীদুল্লাহ এবং আরিপপুরের মুক্তারফ, আমির হামজা, রশীদসহ প্রায় ১০-১৫ জনের একদল যখন স্কুলে গিয়ে পৌঁছাতাম তখন দেখতাম আমাদের ড্রিলমাস্টার চাকী স্যার সবে মাত্র ন্যাশনাল এ্যান্মেম শেষ করে স্কুলের প্রধান গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। স্কুলের হেড মাস্টার মথুর স্যারের নির্দেশেই তিনি এসে দাঁড়াতেন স্কুলের প্রধান গেটের কাছে, কোন কোন ছাত্র স্কুলে দেরিতে আসে, তারই খোঁজ খবর নিতেন। ক্লাস সিক্সেই আমার সঙ্গে ভর্তি হলো, ভবানী সাহার ৪ তলা ভবনের একটি সুশ্রী ছেলে, তাদের আসল বাড়ি পশ্চিম বঙ্গের মেদিনীপুরে। ঐ ৪তলা ভবনের সকলেই ছিলেন ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের উদ্বাস্তু লোকজন, সেই লোকজনের ভেতরে ছিলেন ভারতের বিহার প্রদেশের বিহারী সম্প্রদায়ের ছেলে শামীম বিহারী, সেই শামীম এসে ভর্তি হলো ক্লাস সিক্সে আমার সঙ্গে। ৪ তলা ভবনের অন্যান্য ফ্ল্যাটে থাকতেন অধিকাংশই মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর ও কলকাতা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা লোকজন। মাথা মোটা শামীম বিহারী, বাংলা বলতেই পারতো না বলা যায়, তার অধিকাংশ কথাই আমরা বুঝতে পারতাম না, অথচ ঐ একই ভবনের মুর্শিদাবাদের লোকজনদের কথা শুনতে ভাল লাগত, তারা করতেন শুদ্ধ উচ্চারণ। যেমন শুদ্ধ উচ্চারণ করতেন আমার নতুন সহপাঠী ৪ তলা ভবনের সেই সুশ্রী ছেলেটি। স্কুলের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনেই জেনে নিলাম তার নাম এবং তাকে আমার বেঞ্চেই বসার সুযোগ করে দেয়ায়, বোধ করি কৃতজ্ঞতাবশত, আমাকে চিনেবাদাম, লোকোনদানা খাওয়াবে বলেই নিয়ে গেলেন সেই সাধুপাড়ার চিনেবাদাম বিক্রেতা কালা শাজাহানের নিকট। ইতিমধ্যে জেনে নিয়েছি সুশ্রী ছেলেটির নাম। শেখ আবদুল হাদী, অনুরূপভাবে সেও জেনে নিয়েছে আমার নাম। দুপুরের টিফিনে যখন শাজাহানের চিনেবাদাম কিনতে গিয়েছি আমি আর শেখ আবদুল হাদী, তখন দেখি সেই মোটা সুবেশী শামসুলও চিনেবাদাম কিনছে শাজাহানের নিকট থেকে। শেখ আব্দুল হাদীই জানতে চাইলো সামদুল, তুমিতো মহাকালী স্কুলে পড়তে, জিসিআইতে কবে ভর্তি হলে। নাকি গার্লস স্কুলের কাছে নাজির উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তে? মহাকালী স্কুলটি ছিল শামসুলদের সেই রেডিও, ব্যাটারীর দোকানের বিপরীতে অর্থাৎ পূর্বদিকে পাবনা অন্নগোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরীর দক্ষিণ ঘেঁষে স্কুলটিতে আমি তোমাকে বোধ হয় দেখেছিলাম, শেখ আব্দুল হাদীর কথায় ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলো শামসুল, এমন সময় আমি শামসুলকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার পুরো নামটি কি? অত্যন্ত ভদ্রভাবে, বিনয়ের সঙ্গে শামসুল জানালো আমার নাম শামসুল হক, অনেকে আমাকে ‘শামু’ বলে যাকে। আপনি যদি আমাকে ‘শামু’ বলেন, বলতেও পারেন। শামসুল হক শামু কথা শেষ করেই তার হাত ধরে চিনেবাদামের ঠোঙ্গা থেকে অনেকগুলো চিনেবাদাম বের করে আমার আর শেখ আব্দুল হাদীর হাতে তুলে দিয়ে, হাদীকে বললো, হাদী ভাই, উনার নাম কি, হাদী আমার নাম বললেও, বলতে পারলো না আমি কোথায় থাকি। আমি নিজ থেকেই বললাম। আমাদের পাড়ার ও আমাদের আপন চাচাতো ভাই মিলে আমরা ১০-১৫ জন ভাই, এই স্কুলে পড়ি। আমাদের বাড়ি দোহারপাড়ার গ্রামে পাবনা সদর গোরস্থানের পূর্বদিকের পুরাতন দোতলা বাড়িটি আমাদের। হাদী কিছু না ভেবেই বললো, শামসুল হক এবং আমরা যে পাড়ায় থাকি, সে পাড়াটির নাম দিলালপুর। দিলালপুর থেকে পশ্চিম দিকে গেলেই লাহিড়ীপাড়া, গোপালপুর শামসুলরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকে, সেই বাড়ির পূর্বদিকেই বাণী সিনেমা হল, আর পশ্চিম দিকেই মহল্লাগুলোর নাম গোবিন্দা কেষ্টপুর, সেই পশ্চিম দিকেই জিন্নাপার্ক, যে পার্কে ফুটবল খেলা থেকে শুরু করে ১৪ আগস্টের পাকিস্তান দিবসে বিভিন্ন সংস্কৃতি অনুষ্ঠান কৃষি মেলা, যাত্রা, জুয়ার আসর এমনকি মৃত্যুকূপে দূরন্ত যুবকের সাইকেল নিয়ে ঝাঁপাঝাঁপি, মুখে আগুন জ্বেলে দর্শকদের অভিভূত করার কলাকৌশল দেখানো হয়। সেই কৌশল দেখতে লাগতো ৮ আনা পয়সা, তখনকার দিনে যে কোন স্কুল ছাত্রের পক্ষে ৮ আনা জোগাড় করা এক দুঃসাহসিক কর্মকা- ছাড়া অন্য কিছু নয়। বিশেষত আমাদের মতো ছেলেদের পক্ষে এক সঙ্গে ৮ আনা পয়সা হাতে পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। (চলবে)
×