ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

২৪ চিত্রশিল্পীর অব্যক্ত ভাষা ‘কন্যা’

প্রকাশিত: ১২:৪৬, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

২৪ চিত্রশিল্পীর অব্যক্ত ভাষা ‘কন্যা’

কেউ মা আবার কেউ কন্যার বয়সী। বিভিন্ন ব্যাচের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ১৬ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ও একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন চারুকলায় পাঠ নেয়া বেশিরভাগ প্রাক্তন এবং অল্প কয়েকজন বর্তমান ছাত্রীদের নিয়ে গড়ে উঠেছে শিল্পী শাকিলা চয়নের উদ্যোগে ২৪ নারী চিত্রশিল্পীকে নিয়ে প্রযুক্তি যোগাযোগ মাধ্যম মেসেঞ্জার গ্রুপ ‘কন্যা’। চারুকলা ব্যাকগ্রাউন্ডের এই মানুষগুলো শিল্প ভুবনে একসঙ্গে পথ চলবেন বলেই এক হয়েছিলেন প্রযুক্তি দুনিয়ার এই প্লাটফর্মে। শুরুতে বিভিন্ন শো নিয়ে, বিভিন্ন শিল্পীর কাজের খবর নিয়ে গ্রুপে আলাপ হতো। পরে ধীরে ধীরে তাদের নিজের কাজ নিয়ে আলাপ শুরু হয়। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠিত বিষয় ছিল চিত্রকলা কিন্তু পারিবারিক, সামাজিক বাধা কিংবা আলস্যের কারণে হাতে আর রং তুলি নেয়া হয়নি, ক্যানভাসে জীবনের রং চিত্রায়নও করা হয়নি। এই গ্রুপ তাদের হাতে আবারও রং তুলি এবং ক্যানভাসের মেলবন্ধন ঘটাতে সহায়তা করেছে। অনেকে নিয়মিতই আঁকতেন। আবার এমনও আছে কেউ ১৮ কিংবা ৩৫ বছর পর এই গ্রুপকে কেন্দ্র করে আঁকার জগতে ফিরে এসেছেন। গ্রুপটির স্বার্থকতা এখানেই। এই গ্রুপের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় ‘চলো আঁকি’ স্লোগানকে সামনে রেখে ‘কন্যা আর আমরা’ শিরোনামের যৌথ শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। যেটি গত ২৫-২৭ জানুয়ারি শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার ২ নম্বর গ্যালারিতে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো। প্রত্যেকের তিনটি করে মোট ৭২টি চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল। মানুষের মুখে মুখে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, ‘অস্ত্র জমা দিলেও ট্রেনিং জমা দেইনি। ‘কন্যা’র শিল্পীদের আঁকায় সেটিই প্রমাণ করেছে। অনেকে দীর্ঘদিন পর আঁকছেন, শিল্প ভুবন থেকে এক প্রকার বিদায় নিয়েছিলেন কিন্তু তাদের কাজ দেখে সেটি মনে হয়নি। প্রত্যেকের কাজের বিষয়বস্তু এবং স্টাইল তাদেরকে নিয়মিত আঁকিয়ে হিসেবেই আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে। আফরোজা খন্দকারের চিত্রকর্ম ‘হংস মিথুন’ মুহূর্তেই নৈসর্গিক ভাল লাগায় নিবিষ্ট করে। আবার ‘উর্মি মালা’ চিত্রকর্মে সাগেরের তীরে আছড়ে পড়া ঢেউ আমাদের দারুণ অনুভব তৈরি করে। আঁখি নূর রহমান ঝর্ণা আঁকার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন নগর জীবনে ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট টোকানো কাক, খোলা আকাশে উড়ন্ত মা কাক এবং ছাদে বসা এক ঝাঁক বাচ্চা কাক। তিনি আমাদের নিত্য দেখা বিষয়কে নতুন উপলব্ধির জায়গায় নিয়ে গেছেন। আমিনা আক্তারের ‘ড্রিমি টাচ’ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলো আমাদের কল্পলোকের জগতে নিয়ে যায়। আতিকুন নাহার জ্যোতি ‘এ ব্রেভ ওমেন’ চিত্রকর্মে নারীর শক্তি ও সাহসের কথা জানান দিয়েছেন। আবার ‘মেয়েলি’ চিত্রকর্মে একটি সুন্দর নারী মুখশ্রীর সাযুজ্য ফুটিয়ে তুলেছেন। ফাতেমা বেগম রিনা ‘কম্পোজিশন’ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলোতে বিমূর্ত ক্যানভাসে আলো-আঁধারের অস্পষ্টতা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। ফারহানা ইয়াসমিন ‘রেইন ফর লাইফ’ চিত্রকর্মগুলোতে বৃষ্টির সৌন্দর্য খোঁজার চেষ্টা করেছেন এবং ভাল লাগার অনুভূতি জাগিয়ে দিয়েছেন। খুরশিদা আক্তার তার ‘ফ্রেন্ডশিপ’ চিত্রকর্মে আমাদের চিরন্তন বন্ধনের কথা স্মরণ করে দেয়ার চেষ্টা করেছেন এবং ‘নিঝুম দ্বীপ’ চিত্রকর্মে হয়ত আমাদের একাকী জীবন নিয়ে কথা বলতে চেয়েছেন। মাহফুজা বিউটি ‘ডিটারেন্ট-৩’ শিরোনামের চিত্রকর্মে দেখিয়েছেন বেড়ে ওঠার অদম্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ পরিস্থিতি আবার ‘বিউচড বাই নেচার-১’ চিত্রকর্মটিতে প্রকৃতির মায়ামমতা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। মাহিন মাহনুমা তার ‘রিফ্লেকশন অব গ্যালাক্সি’ চিত্রকর্মগুলোতে এক মহাজাগতিক আবেশ তৈরি করেছেন। মোরসালিনা আহসান লাভলী ‘জলসা’ চিত্রকর্মগুলোতে সুনিপুণ মুন্সিয়ানায় জীবনের আনন্দলোকের কথা বলেছেন। নাজমা মুক্তার শিল্পের বেড়ে ওঠা পাহাড়ের পাদদেশে। তাই তিনি হয়ত ‘মাউন্টেন স্কেপ’ এবং ‘মাউন্টেন সিটি’ চিত্রকর্মে পাহাড়ী সৌন্দর্য তুলে এনেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলার একমাত্র সদস্য রহমান সুখি ‘নেচার-৭১’ চিত্রকর্মে মুক্তি এবং নৈসর্গের মায়াভরা রূপ তুলে ধরেছেন আবার ‘বর্ডার’ চিত্রকর্মে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়াকে ইঙ্গিত করেছেন বোধহয়। সেলিনা মুন্না ‘ডিসটেন্স’ চিত্রকর্মে ওই দূর আকাশের মেঘমালা আর মেঘে ঢাকা চন্দ্রালোকের নান্দনিকতা নির্দেশ করেছেন হয়ত। ‘ল্যান্ডস্কেপ’ চিত্রকর্মে কোন রিয়ালিস্টিক ভূ-সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন। এস.বি নুসরাত জাহান নোটনের ‘নেচার’ চিত্রকর্মে ফুলেল পরিবেশ এবং ‘অন দ্য ওয়ে’ চিত্রকর্মে এক ছায়া-সুনিবিড় প্রকৃতি এবং ইটপাথরের নৈসর্গিক পথের সন্ধান পাওয়া যায়। শর্মিলা সোমার ‘বন্ডেজ’ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলোতে নারী এবং আবদ্ধতার এক শৈল্পিক রূপ দেখতে পাওয়া যায়। নারী মানেই প্রতিটি পদক্ষেপে বাধা আর এই বাধার সঙ্গে যুদ্ধ করে নারীকে এগিয়ে যেতে হবে তিনি হয়ত এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন। শাহেদা কুলসুম জেসমিনের ‘আরবাস গ্ল্যামার’ চিত্রকর্মগুলোতে নিসর্গের মায়াময় দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে দেয়। শামীমা আক্তারের ‘বন্ডিং’ চিত্রকর্মগুলো দিগন্তজোড়া আকাশ, মাটি এবং প্রকৃতির এক মেলবন্ধন নির্দেশ করে। শাহনাজ শাহীন তার চিত্রকর্মে ফুলেল সৌন্দর্য এবং নারীর মায়ামমতা প্রকাশ করেছেন। শাকিলা চয়ন ‘মনছায়া’ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলোতে নারীর ভাল থাকার মনছবি রচনা করেছেন। পেছনে যতই বেদনা থাকুক ফুল, পাখি ও প্রকৃতি থেকে নির্যাস নিয়ে নারীকে ভাল থাকতে হবে এবং এগিয়ে যেতে হবে তিনি হয়ত এই বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সুলতানা পুতুল ‘কেভ’ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলোতে আমাদের আদিম সমাজের গুহাচিত্রের মাধ্যমে গুহা জীবনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। সুরভী সোবহানার ‘সকুন্তলা’ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলোতে নারীর একান্ত আপন ভাবাবেগ প্রকাশের প্রয়াস পেয়েছেন। তানিয়া বারি কান্তা ‘রিদিমিক’ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলোতে প্রকৃতি এবং প্রাণ উভয়ের মধ্যে যে একটি গতি আছে সেটি খোঁজার চেষ্টা করেছেন। উম্মে হাবিবা সুমি ‘হার সং’ চিত্রকর্মগুলোতে জীবনকে দেখেছেন সঙ্গীতের গতিময়তার সঙ্গে। জাকিয়া ফেরদৌস আলো আঁধারির সবুজাভ এবং রঙিন যান্ত্রিক দুটি পাহাড়ী শহরের দুই জীবনের কথা বলেছেন হয়তবা। নিসর্গ, নারী, ফুল, পাখির কলতান, গ্রামীণ জীবনসহ বিবিধ বিষয় উঠে এসেছে প্রত্যেকের কাজে। এ্যাক্রেলিক, জল রং, তেল রং ছাপচিত্রের আশ্রয়ে আঁকা হয়েছে চিত্রকর্মসমূহ। সোজা কথায় প্রতিটি চিত্রকর্ম বিষয় বৈচিত্র্যে ভরপুর। শিল্পকর্ম আমাদের চেনা পৃথিবীকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করে, নতুনভাবে চিনিয়ে দেয়ার প্রয়াস চালায়। ‘কন্যা’র এ যৌথ প্রদর্শনী আমাদের চিরচেনা পৃথিবীর নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়কে নান্দনিক উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। তবে প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া বেশিরভাগ কাজ রিয়ালিস্টিক ফর্মে করা। সীমিত কয়েকজন ছাড়া এ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্মটি প্রায় উপেক্ষিত হয়েছে। শিল্পানুরাগী মানুষ হিসেবে ভবিষ্যতে আশা করব প্রত্যেকে দুই ফর্মেই কাজ করবেন এবং শিল্পের আরও গভীরে প্রবেশ করবেন। সর্বোপরি ‘কন্যা’র যে যাত্রা শুরু হয়েছে সেটি অব্যাহত থাকবে এবং আমাদের শিল্প ভুবনকে ‘কন্যা’ সমৃদ্ধ করে চলবে সেটিই প্রত্যাশা।
×