ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নুরুল করিম নাসিম

অতীনের গল্পভুবন

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

অতীনের গল্পভুবন

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ছোটগল্পের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল, যবনিকা পড়ল একটি গল্প আন্দোলনের। ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ উপন্যাসের মায়াবী প্রভাব এখনও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কখনও কখনও আমাদের এ রকম ধারণা হয়েছে, অতীনের উপন্যাস যেখানে শেষ, গল্প সেখানে শুরু। হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ প্রমুখের গল্প পাঠের অভিজ্ঞতা আমাদের ঋদ্ধ করে, উদ্বেলিত করে। আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি হাসানের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের দরিদ্র অসহায় এক বৃদ্ধ পিতা ও আত্মঘাতী কন্যার কথা। হকের ‘তাস’, ‘শীতবিকেল’, ‘জনক ও কালোকফি’ গল্পের চরিত্ররা কিংবা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘একটি তুলসী গাছের আত্মকথা’ অথবা ‘পাগড়ী’ গল্পের বিভিন্ন অনুষঙ্গ আমাদের উদ্বেলিত করে। বাংলা গল্পের দুই ধারা- পশ্চিমবঙ্গের গল্প এবং বাংলাদেশের গল্প দুই দেশের দুই জনগোষ্ঠী ও দুই সংস্কৃতিকে মূর্ত করে তোলে। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে ষাট কিংবা সত্তরের দশকের গল্পবিক্ষা আলোচনায় এনে আমরা অতীনের গল্পভাবনাকে পর্যালোচনা করতে পারি। ‘অলৌকিক জলযান’, ‘ঈশ্বরের বাগান’, ‘গাছ ও তার প্রতিপক্ষ’, ‘রাজার টুপী’ প্রভৃতি গল্প পড়তে পড়তে বিমল কর সম্পাদিত ‘সাম্প্রতিক ধারার গল্প’-এর ভূমিকা মনে পড়ে। সেই সুদূর পঞ্চাশ-ষাটের দশক কিংবা সত্তরের দশকেও গল্পের যে ভিন্নতর ভাবনা নিয়ে এগিয়ে আসেন, সেই সময়কার একঝাঁক গল্পকার, তাতে আমরা চোখ ফেরাতে পারি। বিমল কর লেখেনÑ ‘অনেক লেখক আছেন, যারা গল্পের গঠনে যতটা পারেন সাবেকি রীতিনীতি মেনে গল্প লেখেন, লেখার মধ্যে একটা ঝকঝকে ভাব থাকে, হয়ত খানিকটা নাটকীয়তায় অতীনের ধরনটাই আলাদা। তার কোন নির্দিষ্ট ছক নেই, মাপজোখ করে হিসাব মিলিয়ে গল্প লেখার ধাত তার নয়। প্রায় সব লেখাই স্বতঃস্ফূর্ত, ভেতরের তাগিদেই নিজের মতন করে আঁকেন, নিজের মনের পছন্দসই রং ব্যবহার করেনÑ যার উজ্জ্বলতা প্রখর নয় অথচ স্নিগ্ধ ও লাবণ্যময়। বলা বাহুল্য, এর একটা দেশজ রূপ ও আকর্ষণ রয়েছে।’ উপরোল্লিখিত বিমল করের তাৎপর্যময় মন্তব্য অতীনের গল্পের বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট করে তোলে এভাবে : ১. অতীন স্বতঃস্ফূর্ত। ইংরেজীতে যাকে কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ ঝচঙঘঞঊঘওঙটঝ বলেছেন, তা আমরা অতীনে লক্ষ্য করি। ২. সাবেকি রীতি মানেন না। ৩. তার কোন নির্দিষ্ট ছক নেই। ৪. মাপজোখ করে হিসাব মিলিয়ে গল্প লেখার ধাত অতীনের নেই। ৫. ভেতরের তাগিদেই লেখেন। ৬. নিজের মনের পছন্দসই রং ব্যবহার করেন। ৭. যার উজ্জ্বলতা প্রখর নয়, অথচ স্নিগ্ধ ও লাবণ্যময়। ৮. দেশজ রূপ ও আকর্ষণ রয়েছে। এসবের অর্থ কী? সোজাসাপটা কথায় বলা যায়, অতীন কবিদের মতো মনের তাগিদেই লেখেন। তার গল্প কখন আরোপিত মনে হয় না। তার গল্পে নাটকীয়তা নেই। মেলোড্রামা তার গল্পের আখ্যানকে বিব্রত করে না। তার গল্পের ‘দেশজ’ রূপ অর্থাৎ মাটি-সংলগ্নতা সমসাময়িক অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করেছে। প্রকৃতি, ইতিহাস ও দর্শন তার অধিকাংশ গল্প যেমন- ‘আবাদ’, ‘দেবীনিধন’, ‘আজ আমার সংবর্ধনা’তে আমরা ব্যবহৃত হতে দেখি। তিনি সময় ও সমাজকে পাশ কাটিয়ে বায়বীয় গল্প লেখেন না। তার গল্পে (যেমন আজ আমার সংবর্ধনা) নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে শ্লেষ ও ব্যঙ্গ সম্পৃক্ত হতে দেখি। তিনি যখন মানব-মানবীর সম্পর্কের গল্প লেখেন, সেখানেও আমরা ভিন্ন বয়ান লক্ষ্য করি। প্রসঙ্গত, ‘বয়স সাতাশি’ গল্পটি স্মর্তব্য। আপাতদৃষ্টিতে তার কিছু গল্পকে মনে হতে পারে প্রতিবেদন। আসলে তা প্রতিবেদন নয়, নিছক আখ্যানও নয়, ছকে বাঁধা পূর্বপরিকল্পিত গদ্যভাবনাও নয়। তবে অতীনের গল্প কী? জীবন যে রকম, জীবন যেমন, তেমনটি তিনি উপস্থাপন করেন। কিন্তু কখনও কখনও তা বহুতরবিশিষ্ট, তাতে একাধিক মাত্রা যুক্ত হয়। প্রসঙ্গত, ‘অলৌকিক জলযান’ কিংবা ‘ঈশ্বরের বাগান’-এর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। অতীনের গল্প একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে এ কথা অনস্বীকার্য যে, তার গল্প নিবিষ্ট পাঠ দাবি করে। আমরা তার গল্পে একটা ভিন্ন অবয়র দেখতে পাব। এসব কারণে তার গল্প এই একবিংশ শতকেও অনিবার্য। কেবল মধ্যবিত্ত নয়, কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত নয় অথবা উচ্চবিত্তও নয়, নিম্নবর্গের মানুষ বা গায়ত্রী স্মিভাকের ভাষা ধার করে বলা যায়, ঝটই-অখঞঊজঘ জনগোষ্ঠীর প্রতিও তিনি অনুরক্ত ছিলেন। তাদের শ্রেণীচরিত্র, ইতিহাস, সময়, সমাজ ও দেশকে সম্যক উপলব্ধি করতেন। কিছু কিছু গল্পকার, উভয় দেশেরই, নিছক নান্দনিকতার প্রয়োজনে যেসব গল্প লেখেন, সেগুলো না গল্প, না প্রতিগল্প (অঘঞও-ঝঙজণ), না আখ্যান, নিরীক্ষার নামে নিছক শব্দবিলাস। কবিতাক্রান্ত এ ধরনের লেখা অতীন লেখেননি। তবে এ কথা ধ্রুব সত্য যে, তিনি লাতিন আমেরিকান লেখকদের মতো, বিশেষজ্ঞ মার্কেজের মতো গল্পকথক বা ঝঞঙজণ-ঞঊখখঊজ নন। অতীনের গল্পে প্রতীকের আড়ালে দর্শন ও রাজনীতির সার্থক সহবাস লক্ষ্য করা যায়। তিনি নতুন নতুন প্রকরণ ব্যবহার করেন। তার ‘পঞ্চকাটি’ গল্পগ্রন্থে এসব গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তার গল্পে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পাশ্চাত্য লেখকদের মতো গ্লানিরোধ, রিক্ততা ও হতাশা কখনও কখনও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু তিনি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারান না। তিনি তার চরিত্রগুলোর প্রতি, যেমন- হাসিম পরান যথেষ্ট যত্নবান। প্রসঙ্গত, নোবেল বিজয়ী লেখক ঙখউগঅঘ অঘউ ঞঐঊ ঝঊঅ-এর অবিস্মরণীয় কথাকার হেমিংওয়ের কথা বিদগ্ধ পাঠকের মনে পড়বে- ‘আমরা পরাজিত হবো। কিন্তু হেরে যাবো না।’ উভয় দেশেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, দেশভাগ ও দেশত্যাগের নির্মম ও প্রাণস্পর্শী ঘটনা নিয়ে অসংখ্য গল্প লেখা হয়েছে। প্রসঙ্গত, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘একটি তুলসী গাছের আত্মকথা’ উল্লেখ্য। অতীনও এই স্পর্শকাতর ও মানবিক বিষয় নিয়ে বেশকিছু স্মরণীয় গল্প পাঠককে উপহার দিয়েছেন ‘সাম্প্রদায়িক’, ‘তায়েব আলবয়নসীর’, ‘জীবন নিয়ে খেলা’, ‘ভুখা মানুষের কোনো পাপ নাই’, ‘মানুষের ব্যভিচার’- এ রকম অজস্র গল্পের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ঞঐঊ চখঊঅঝটজঊ ঙঋ ঞঐঊ ঞঊঢঞ-এর প্রবন্ধকার তত্ত্ববিদ রোলাবার্ত একটা তাৎপর্যময় কথা বলেছেন, ISN’T STORY TELLING ALWAYS A WAY OF SEARCHING FOR ONE’S ORIGIN, SPEAKING ONE’S CONFLICT WITH LAW, ENTERING INTO THE DILECTIC OF TENDERNESS AND HATRED? হ্যাঁ, তাই তো, আসলে গল্পলেখা এক ধরনের অনুসন্ধান (অ ঝঊঅজঈঐ), শেকড়ের অনুসন্ধান, সংঘাত জীবনের সঙ্গে, পরিবেশের সঙ্গে, ঘৃণার সঙ্গে। লোলা বার্তের এই অমোঘ কথা কয়টি স্মরণ রাখতেই হবে- এমন কোন দিব্যি কেউ দেননি। তবে অতীনের গল্পবিক্ষা ও গল্পভাবনা ভাবতে গেলে এই মহাত্মার এসব বাক্যবন্ধ মনে পড়বে।
×