ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অর্ধেকই অবৈধ

ইটভাঁটিতে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ, বাড়ছে শিশু শ্রমিক

প্রকাশিত: ১১:০৮, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ইটভাঁটিতে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ, বাড়ছে শিশু শ্রমিক

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন দেশের প্রায় সব ইটভাঁটির শ্রমিকরা। যেখানে শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্রে যেমন নিরাপত্তা নেই, তেমনি বাসস্থানও অনিরাপদ। কর্মস্থলে শ্রমিকরা কিভাবে থাকেন তাও জানেন না মালিকদের অনেকে। যদিও এ নিয়ে মালিক পক্ষের ভাবনার কিছু নেই। আর অনিরাপদ পরিবেশের কারণেই কুমিল্লার এক ইটভাঁটিতে ট্রাক উল্টে অকালে ঝরে গেল ১৩ শ্রমিকের প্রাণ। যাদের মধ্যে অনেকেই স্কুলের ছাত্র। পরিবারে বাড়তি আয়ের যোগান দিতেই কাজে এসেছিল তারা। বাস্তবতা হলো নিরাপদ পরিবেশের অভাবেই ইটভাঁটিগুলোতে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। গবেষণা বলছে, দেশের ৯ হাজার ৭০০টি ইটভাঁটির অর্ধেকই অবৈধ। তাছাড়া বেশিরভাগ ভাঁটির কাজ করছে শিশু শ্রমিক। কুমিল্লায় বাড়তি আয়ের আশায় ইটভাঁটির কাজ করতে এসে দুর্ঘটনায় ১৩ শ্রমিকের মৃত্যুর পর এ নিয়ে নানা আলোচনা। স্থানীয়দের অভিযোগ, ইটভাঁটি কর্তৃপক্ষে অব্যবস্থাপনা ও মালিকের গাফিলতির কারণেই এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। গাফিলতির বিষয়টি ইটভাঁটি মালিকের কথাতেই স্পষ্ট। কে এ্যান্ড কো. ব্রিক ফিল্ডের মালিক হাজী আবদুল রেজ্জাক বলেছেন, ‘ব্রিক ফিল্ডে শ্রমিকের প্রয়োজন হলে আমরা সর্দারের সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাদের শ্রমিক সংগ্রহ করে দেন। কিন্তু তারা কোথায় কীভাবে থাকত সে বিষয়ে আমি জানি না। তবে সর্দার সাদ্দাম হোসেন বললেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা ইটভাঁটি কর্তৃপক্ষ করে থাকে। আমরা শ্রমিক হওয়ায় মালিকরা দায়সারাভাবে একটা ব্যবস্থা করে দেন। শুক্রবার জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গোলপাশা ইউনিয়নের নারায়ণপুর এলাকায় কে এ্যান্ড কো. ব্রিক ফিল্ডে কয়লার ট্রাক উল্টে ঘুমন্ত ১৩ শ্রমিক নিহত হন। এদের মধ্যে সাতজন একই বাড়ির। নিহত শ্রমিকদের সবার বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকায়। ইট পোড়ানোর মৌসুমে তারা কাজ করতে এসেছিলেন কুমিল্লায়। ইটভাঁটির মালিক বলেন, ‘আমি যতটুকু খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম কয়লাবাহী ট্রাকের চালক ও হেলপারের গাফিলতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এদিকে এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই মঙ্গলবার ঢাকার আশুলিয়ায় একটি ট্রাক ইটভাঁটি থেকে বের হওয়ার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তুরাগ নদে পড়ে চালক ও ভাঁটির নিরাপত্তা প্রহরিসহ চারজন নিহত হয়েছেন; আহত হয়েছেন তিনজন। আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জাবেদ মাসুদ জানান, মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে মরাগাঙ্গ এলাকার বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়কে এ দুর্ঘটনায় নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে কুমিল্লার ট্রাক দুর্ঘটনায় ১৩ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই ইটভাঁটির শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। সেই সঙ্গে দেশের ইটভাঁটিগুলোতে কর্মপরিবেশ যে শ্রমিকবান্ধব নয় তাও আলোচনায় এসেছে। যদিও দীর্ঘদিন ধরে চলা আসা এই অব্যবস্থাপনা সরকারের একেবারেই নজরের বাইরে। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, কুমিল্লার ইটভাঁটির ১৮ শ্রমিক ছোট্ট একটি অস্থায়ী ঘরে থাকতেন। ওই ঘরের দেয়ালের ইটগুলো খুবই নিম্নমানের। সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পর খড় বিছিয়ে মাটিতে ঘুমিয়ে থাকত শ্রমিকদের। এটা শুধু কে এ্যান্ড কো. ব্রিক ফিল্ডের নয়, কুমিল্লার সব ব্রিক ফিল্ডের একই চিত্র। স্থানীয় কয়েক শ্রমিক জানান, দুই মাস আগে সর্দার সাদ্দাম হোসেনের মাধ্যমে ইট পোড়ানোর কাজ করতে আসেন নিহত শ্রমিকরা। তারা ছয় মাসের জন্য ওই ইটভাঁটির কাজ করতে এসেছিলেন। মৌসুম শেষে তারা নিজ এলাকায় ফিরে যাবেন। এক হাজার কাঁচা ইট পোড়ানোর উপযোগী করলে তাদের দেয়া হতো ১৫০ টাকা। ওই ইটভাঁটির শ্রমিক মনির হোসেন জানান, গত বৃহস্পতিবার সারাদিন কাজ করেছেন নিহত শ্রমিকরা। শুক্রবার পুরো সপ্তাহের বেতনের টাকা পেয়ে বাড়িতে পাঠাতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু তা আর হলো না। তিনি বলেন, ‘ঘটনার রাতে আমরা সবাই ঘুমিয়ে ছিলাম। ভোরে একটি ট্রাক চট্টগ্রাম থেকে কয়লা নিয়ে আসে। গাড়িটি হেলপার চালাচ্ছিল। ট্রাক থেকে কয়লা আনলোড করার সময় হঠাৎ তা উল্টে ঘরের ওপর পড়ে। এতে চাপা পড়ে ১৩ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পাঁচজন আহত হয়েছেন। ওই রুমে মোট ১৮ শ্রমিক ঘুমিয়েছিলেন। কুমিল্লা পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্ঘটনার কারণ ও কর্তৃপক্ষের গাফিতলি আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মামুনকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পালাতক থাকা চালক ও হেলপারকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে পুলিশ। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর বলেন, জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কাইজার মোহাম্মদ ফারাবিকে। আশা করি ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষে দুর্ঘটনার কারণ জানা যাবে। দেশের ইটভাঁটিগুলোতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ যেমন নেই তেমনি শিশু শ্রমিক নিয়োগও বন্ধ হচ্ছে না। মজুরি কম দেয়ার নামে বেশিরভাগ ভাঁটিতে শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়। অথচ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় ৫৪টি ধারার মধ্যে সরাসরি শিশুর সুরক্ষা বিষয়ক ২৪টি ধারা রয়েছে। ধারা ৩২-এর ১-এ বলা আছে, শরিক রাষ্ট্রসমূহ অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শিশুর অধিকারকে রক্ষা করবে এবং শিশুর শিক্ষায় ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী কিংবা তার স্বাস্থ্য অথবা শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর কাজ করানো না হয়, সে ব্যবস্থা নেবে। এই শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী ১৯১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কিন্তু এখনও দেশে এই সনদের বাস্তবায়ন হয়নি। শিশুরা এখনও অরক্ষিত। কুমিল্লায় ইটভাঁটিতে ট্রাক উল্টে নিহত ১৩ শ্রমিকের মধ্যে সাতজনই নীলফামারীর দুটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলেন। যারা পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে দিনমজুরি করে পরিবারকে সহযোগিতা করত। তাদের সবার বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার শিমুলবাড়ি ও তার পাশের নিজপাড়া গ্রামে। জলঢাকা উপজেলার মীরগঞ্জ হাট বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, নিহতদের মধ্যে পাঁচজন তার বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র। অন্য দুইজন শিমুলবাড়ি এসসি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী বলে জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষক জ্যোতিশ চন্দ্র রায়। পবার প্রতিবেদন ॥ দেশের ৯ হাজার ৭০০ ইটভাঁটির অর্ধেকই অবৈধ বলছে বেসরকারী সংস্থা পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার ইটভাঁটিগুলোর জন্য যে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ধারণ করে দিয়েছে, অবৈধ ভাঁটিগুলো তা মানছে না। তারা অবৈধ ড্রাম চিমনি ও ১২০ ফুট উচ্চতার স্থায়ী চিমনিতে ইট পোড়াচ্ছে। লোকালয়ে ইটভাঁটি স্থাপনের নিয়ম না থাকলেও, বেশির ভাগ ভাঁটি স্থাপন করা হয়েছে বসতবাড়ি, গ্রামগঞ্জ ও শহর এলাকা এবং কৃষি জমিতে। পবার মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও পরিবেশ ছাড়পত্র এবং জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স ছাড়াই দেশের বিভিন্ন ভাঁটিতে ইট পোড়ানো হচ্ছে। উপকূলীয়, পাহাড়ী, বরেন্দ্র এলাকা, চর এলাকার জেলাগুলোতে ড্রাম চিমনিবিশিষ্ট ইটভাঁটি বেশি রয়েছে ও স্থাপনের মহোৎসব চলছে। সে বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসন সম্পূর্ণ নীরব এবং কার্যকর কোন ভূমিকা পালন করছে না। অথচ ২০০১ সাল থেকে ড্রাম চিমনির ইটভাঁটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইটভাঁটির সংখ্যা ৬ হাজার ৭৭০। এর মধ্যে ৪ হাজার ১০৮টি উন্নত জিগজ্যাগ প্রযুক্তির, ২ হাজার ৫৪১টি ১২০ ফুট উচ্চতার স্থায়ী চিমনি ভাঁটি এবং ১২১টি এইচএইচকে ও টানেল ভাঁটি। কিন্তু পবার মাঠপর্যায়ের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ইটভাঁটির সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার ৭০০। এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৮০০’র বেশি ড্রাম চিমনিবিশিষ্ট, ৪ হাজার ৭০০ উন্নত জিগজ্যাগ, ৩ হাজার ৭৫টি ১২০ ফুট উচ্চতার স্থায়ী চিমনি ভাঁটি এবং ১২৫টি এইচএইচকে ও টানেল ভাঁটি। ৪ হাজার ৮২৫ ইটভাঁটির পরিবেশগত ছাড়পত্র বা জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স রয়েছে। পবার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে পরিবেশ অধিদফতরের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের আওতায় নরওয়ে ইনস্টিটিউট অব এয়ার রিসার্সের মাধ্যমে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার চারপাশে নবেম্বর থেকে চালু হওয়া ইটভাঁটিগুলো ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ৫৮ শতাংশ দায়ী। ঢাকার বাতাসে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বস্তুকণা, ক্ষুদ্র বস্তুকণা ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা দিন দিন বাড়ছে। নবেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনটি উপাদানের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি থাকে।
×