ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হাইকোর্টের আদেশ

কানামাছি খেলা নয় ॥ নদ-নদী দখল, উদ্ধার নিয়ে

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

কানামাছি খেলা নয় ॥ নদ-নদী দখল, উদ্ধার নিয়ে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকাসহ সারাদেশের নদ-নদী নিয়ে আর কানামাছি খেলা যাবে না বলে আদালত তার রায়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। আদেশে বলা হয়েছে নদ-নদীকে দখলমুক্ত করার বিষয়টি যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। নদী থাকবে। আবার নদী দখল করার মনোবৃত্তিসম্পন্ন কিছু লোকেরও অভাব হবে না। কিন্তু এর একটা সুষ্ঠু সমাধান হওয়া উচিত। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। নাব্য ও বেদখলের হাত থেকে নদ-নদী রক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশ তথা মানবজাতি সঙ্কটে পড়তে বাধ্য। অবৈধভাবে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী দখল এবং ওইসব নদ-নদী উদ্ধার ও আইনী লড়াই নিয়ে কানামাছি খেলা বন্ধ হওয়া উচিত। দেশে শত শত নদী রয়েছে। নদী দখলকে কেন্দ্র করে পৃথক মামলা ও পৃথক আদেশ হয়। দখলদাররা ফের গিয়ে দখল করে। এমনটি চলতে দেয়া যায় না। আমরা এসব বিষয়কে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে চাই। আদালত তার রায়ে আরও উল্লেখ করেছে সময় এসেছে দেশের সব নদ-নদী রক্ষা করার। যদি রক্ষা করতে না পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম বা পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বৃহস্পতিবার তুরাগ নদ রক্ষা সংক্রান্ত একটি মামলার রায় ঘোষণার সময় বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। বলেন, এর আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের একটি রায় ও গাইড লাইনের আলোকে নদী কমিশন গঠিত হয়েছে। আইন তৈরি হয়েছে। আমরা সেটি দেখে আরও কিছু গাইড লাইন দিয়ে রায় দেব। এ জন্য আগামী রবিবার বাকি রায় ঘোষণার জন্য দিন ঠিক করে আদালত। এর আগে বুধবার এ মামলার রায় ঘোষণা শুরু করে এ আদালত। অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা করতে তুরাগ নদীকে ‘লিগ্যাল পার্সন’ ঘোষণা করে। এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঢাকার চার নদীর রক্ষায় ২০০৯ সালেও আদালত গুরুত্বপূর্ণ রায় দিলেও আজ পর্যন্ত নদীর রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে দেয়া যায়নি। এই কয় বছরে উচ্ছেদ দখল, খেলা চলেছে সর্বত্র। এই সুযোগে আস্তে আস্তে যে অংশটুকু বাকি ছিল তার কফিনেও শেষ পেরেক মারা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঢাকা শহরের সোয়া কোটি জনগণের অস্তিত্ব নির্ভর করছেন চার নদী রক্ষার ওপর। অথচ এই নদীগুলোর অবস্থা এখন একটা নর্দমার ড্রেনে পরিণত হয়েছে। নদীর পাশ দিয়ে হাঁটলে মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটার উপক্রম হয়ে পড়ছে। নদীর পানি শুষ্ক মৌসুমে কুচকুচে কালো রং ধারণ করছে। কোন জলজ প্রাণী নদীতে নেই। জলজপ্রাণীর জীবন ধারণের জন্য পর্যান্ত অক্সিজেনের মাত্রাও এখন শূন্যের কোঠায়। তারা বলেন, চার নদী ধ্বংস হয়ে গেলে ঢাকা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। নদীকে আগের অবস্থায় ফিরে আসতে হলে এখন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেন তারা। হিমালয় থেকে নেমে আসা ভিন্ন ¯্র্েরাতধারা এই বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চার নদীর সঙ্গে মিশে আছে। এক সময়ে ঢাকার মসলিন, জামদানি ও নৌকা শিল্পের গৌবর ছিল বিশ্বের নানা প্রান্তে। মোসল স¤্রাটরা ঢাকা এই বিলাসী পোশাক সমলিন উপহার দিতেন বিদেশী রাজাবাদশাদের। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল ঢাকার মতো আধুনিক একটা শহর। অথচ সেই নগরে নদীর এখন একটা গুরুত্ব কীটে পরিণত হয়েছে। বৃহস্পতিবার আদালত তার রায়ে আরও উল্লেখ করেছে শুধু যে তুরাগ নদী আক্রান্ত তা নয়, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র মেঘনা এবং দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৪৫০টি নদী অবৈধ দখলদারদের দ্বারা আক্রান্ত। আবহমানকাল থেকে এসব নদ-নদীকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। এখন নদ-নদী রক্ষায় কি আমরা হাজার খানেক মামলা করার উৎসাহ বা অনুমতি দেব? নাকি অবৈধ দখলের হাত থেকে সকল নদী রক্ষায় এ মামলাটিকে ধরে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেব, যে নির্দেশনার আলোকে নদী দখলমুক্ত করার মামলা আর আদালতের সামনে আসবে না? তুরাগ নদের অবৈধ স্থাপনা দখলমুক্ত করার নির্দেশনা চেয়ে করা একটি রিট মামলার রায় ঘোষণার মধ্যে বৃহস্পতিবার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে এমন পর্যবেক্ষণ আসে। আগের দিন বুধবার এ মামলার রায় ঘোষণা শুরু করে এই আদালত অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা করতে তুরাগ নদীকে ‘লিগ্যাল পার্সন’ ঘোষণা করে। জীবন্ত সত্তা হিসেবে মানুষ যেমন সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করে, আদালতের এই আদেশের মধ্য দিয়ে নদীর ক্ষেত্রেও তেমন কিছু মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হবে বলে রিটকারীর আইনজীবীর পক্ষ থেকে জানানো হয়। বৃহস্পতিবার এ মামলার কার্যক্রম শুরুর পর বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক রিটকারী পক্ষের আইনজীবীর কাছে জানতে চান, নদী রক্ষায় সরকার যে একটি কমিশন করেছে, একটি আইন করেছে, সেই তথ্য তিনি আদালতে কেন দেননি। ২০০৯ সালে চার নদী রক্ষায় হাইকোর্টের রায়ের আলোকে সরকার একটি নদী রক্ষা জাতীয় কমিশন করেছে। এ বিষয়ে আইনও হয়েছে। কমিশন কাজও করছে। বিচারপতি খায়রুল হক সাহেব যে সাজেশন দিয়েছেন, সরকার কাজ শুরু করেছে। যেখানে পারছেন না, সেখান থেকে আমরা শুরু করতে চাই। এ সময় রিটকারীপক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, কমিশন নদী সংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তি করবে এবং সে আলোকে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু নদী রক্ষা কমিশন ‘সেভাবে কার্যকর না’। তারা সুপারিশ ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। বিচারপতি আশরাফুল কামাল তখন বলেন, নদী দখল করা হচ্ছে, আমরা নির্দেশ দিচ্ছি অবৈধ স্থাপনা ভাঙছে। কয়েকদিন নিরিবিলি থাকার পর আবার দখল শুরু হয়। এই কানামাছি খেলা বন্ধ হওয়া উচিত। আইনজীবীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনার রিটের আলোকে একটি ল্যান্ডমার্ক রায় হতে যাচ্ছে। এই সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। নদীকে দখলমুক্ত করার বিষয়টি যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। নদী থাকবে। আবার নদী দখল করার মনোবৃত্তিসম্পন্ন কিছু লোকেরও অভাব হবে না। কিন্তু এর একটা সুষ্ঠু সমাধান হওয়া উচিত। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বিচারক রিটকারীপক্ষের আইনজীবীকে নদী রক্ষা কমিশনের কাজ, এখতিয়ার ও ক্ষমতা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বলেন। সেসব বিষয় পর্যালোচনা করে রবিবার একটি ‘গাইড লাইন’ দেয়া হবে বলে জানান। হাইকোর্টে এসব মামলা ‘আসাই উচিত না’ মন্তব্য করে এ বিচারক বলেন, বর্তমানে হাইকোর্টে ৫ লাখ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আজকের পর আর যদি কোন মামলা না নেয়া হয় এবং আমরা বিচারকরা যদি দিনরাত কাজ করি, তাহলেও এই ৫ লাখ মামলা নিষ্পত্তি করতে ৩০ বছর লাগবে। নদী রক্ষা কমিশন সঠিকভাবে কাজ করলে অনেক বিষয় আদালতে আসত না এবং এত মামলা জট সৃষ্টি হত না বলে মন্তব্য বরেন বিচারপতি আশরাফুল কামাল। তিনি বলেন, সাংবাদিকরা অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলে আমরা অনেক অনিয়মের বিষয়ে জানতে পারছি। তবে ইনভেস্টিগেটিভ সাংবাদিকতা তো ওই অর্থে আমাদের দেশে নাই। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি প্রকাশ করেছিলেন দুজন সাংবাদিক, যার কারণে সেদেশের প্রেসিডেন্টকে পদ ছাড়তে হয়েছিল। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এ সময় বলেন, আমাদের এখানেও কিছু কিছু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হয়। তারাই তো সমাজের হুইসেল ব্লোয়ার। হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তুরাগ নদের অবৈধ দখলদারদের নাম ও স্থাপনার তালিকা হাইকোর্টে দাখিল করেছিল বিচারিক একটি তদন্ত কমিটি। ওই তালিকায় আসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা পরে এ মামলায় পক্ষভুক্ত হন। উভয় পক্ষের দীর্ঘ শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বুধবার নদ-নদী রক্ষায় রায় ঘোষণা শুরু করে। মনজিল মোরসেদ জানান, জীবন্ত সত্তা হিসেবে মানুষ যেমন সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করে, আদালতের এই আদেশের মধ্যে দিয়ে নদীর ক্ষেত্রেও তেমনই মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি পেল। তুরাগ নদ রক্ষায় বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে ঐতিহাসিক রায়ের ঘোষণা করা হয়েছে। আইনের চোখে ব্যক্তি দুই ধরনের- নেচারাল পার্সন ও লিগ্যাল পার্সন। একজন মানুষ ‘নেচারাল পার্সন’ হিসেবে যেসব আইনী সুবিধা ভোগ করেন, ‘লিগ্যাল পার্সন’ এর ক্ষেত্রে বেশ কিছু আইনী অধিকার প্রযোজ্য হয়। হাইকোর্ট তার ঘোষিত অংশের রায়ে বলেন, অবৈধ দখলদারদের দ্বারা প্রতিনিয়তই কম-বেশি নদ দখল হচ্ছে। অবৈধ স্থাপনা তৈরি করায় সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে নদ। এসব বিষয় বিবেচনা করে তুরাগ নদকে লিগ্যাল/জুরিসটিক পার্সন হিসেবে ঘোষণা করা হলো। আদালত উল্লেখ করেছে, নাব্য ও বেদখলের হাত থেকে নদী রক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশ তথা মানবজাতি সঙ্কটে পড়তে বাধ্য। রিটকারী এবং বিবাদী উভয় পক্ষের দীর্ঘ শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২৮ জানুয়ারি মঙ্গলবার তুরাগ নদ নিয়ে করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সব নদ-নদী রক্ষার জন্য রায় ঘোষণা শুরু করে। হাইকোর্ট বলেছে, ঢাকার আশপাশে বহমান চার নদ-নদী রক্ষায় ইতোপূর্বে আদালত নানা গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু সে সব রায়ের নির্দেশনাগুলোর সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য বিবাদীরা কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো তা হলে তুরাগ নদ রক্ষায় হাইকোর্টে আরেকটি মামলা করার প্রয়োজন পড়ত না। রিটকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, তুরাগ নদ নিয়ে বিচারিক তদন্তে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় ৩৬টি অবৈধ দখলের চিত্র বিভিন্ন প্রতিবেদনে এসেছে। সেসবের ওপর ভিত্তি করেই হাইকোর্টে এই শুনানির সূচনা হয়। আদালত রায়ে প্রথমে নদের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছে। আর তা করতে গিয়ে দেশের অস্তিত্ব¡, মানুষের অস্তিত্বে নদের গুরুত্বের বিষয়গুলো আদালতের বক্তব্যে এসেছে। কেউ যাতে নদ দখল করতে না পারে, নদের প্রবাহ যেন ঠিক থাকে, সর্বোপরি নদ যাতে জীবন্ত থাকতে পারে, তা নিশ্চিত করতে দখল ও দূষণকারীদের আদালত একটি বার্তা দিতে যাচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ নদ দখলের মতো সাহস না করে। নদী রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে জাগরণ শুরু হয়েছে। পরিবেশের জন্য নদ-নদী রক্ষার গুরুত্ব নিয়ে এখন সবাই কথা বলছে। তাই নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে আদালত রায়ে বলেছে, আমরা এমন একটি রায় দিতে চাই। যাতে নদ অবৈধ দখলমুক্ত করতে বার বার আদালতে আসতে না হয়, আদালতের উপর যেন বার্ডেন না হয়। তবে এ বিষয়টাও তারা দেখতে চান, যাতে অন্য যেসব নির্দেশনা আছে বা অন্য যে অথরিটি আছে, আদালতের নির্দেশনার সঙ্গে অন্য অথরিটির নির্দেশনা বা ক্ষমতা যেন ওভারল্যাপ না হয়। একটার সঙ্গে আরেকটা যেন সাংঘর্ষিক না হয়। এজন্য একটু সময় নিয়ে তারা আগামী রবিবার জাজমেন্টটা দিতে চাচ্ছেন। দেশের নদ-নদী রক্ষায় আদালত থেকে বারবার গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা যেমন এসেছে। তেমন আমাদের এই নদী মাতৃক ঐতিহ্য নিয়ে দেশের প্রচুর গবেষণা হয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে এসব নদী ছিল, যেমন মানুষের জীবিকার উৎস তেমনি বিনোদনের একমাত্র উৎস ছিল এই নদীকেন্দ্রিক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন কালের বিবর্তনে আজ নদীগুলো অস্থিত্ব বিলীন হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন, ১৮৬৪ সালে ঢাকার কমিশনার নিযুক্ত বাঁকল্যান্ড বুড়িগঙ্গার তীরে নাগরিক বিনোদনের গড়ে তোলেন বাঁকল্যান্ড বাঁধ। এই তীরে গড়ে ওঠে মনোরম বিনোদন কেন্দ্র। এখন বুড়িগঙ্গার সেই দৃশ্য কেবল স্মৃতির পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই বুড়িগঙ্গা তীর ঘেষে গড়ে উঠেছে লালবাগের কেল্লা, পরিবিবির মাজার, জিনজিরা প্রসাদ ও জিনজিরা হম্মাম খানাসহ নানা ঐহিত্যবাহী স্থাপনা। তারা বলছেন নদীর পানির স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যাবলীর ভারসাম্য ব্যতিক্রম ঘটলেই তাকে দূষণ বলা হয়। দীর্ঘ সময় ঢাকার শহরের বর্জ্য মলমূত্র আবর্জনা, রাসায়নিক বিষে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে নদী। চার পাশে পরিবেশ মারাত্মক হুমকিতে। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বৃহত্তম নদী বন্দর সদরঘাট। বুড়িগঙ্গার তীরে বহু শিল্পকারখানা এবং কেরানীগঞ্জের জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের বিশাল কারখানা বর্জ্য। ব্যাপক পলি পরার কারণে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা ও অন্যান্য নদীতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। স্বাভাবিক পানি পরিশোধন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। জাহাজ থেকে নির্গত তেল, মবিল ও গ্রিজ ও মনুষ্য বর্জ্য, রাস্তার আবর্জনা এবং অধিহারে দূষণ করছে ডাইং কারখানার বর্জ্য। বৃষ্টির পানির সঙ্গে স্টর্ম সুয়ারেজের মাধ্যমে সড়কের বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানিতে নিঃসরণের স্থান হওয়ায় তৈলাক্ত পিচ্ছিল হেভিমেটাল পানিতে মিশে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নদী-খাল দখল দূষণ রোধে উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষিত হচ্ছে। উচ্চ আদালতের আদেশ না মানায় বাংলাদেশে ছোট বড় যে তিন শতাধিক নদী আছে তা আজ হারাতে বসেছে। প্রায় ৩০টি নদী ও খালের দখল, পুনরুদ্ধার ও দূষণ রোধে আদালতের আদেশ থাকা সত্ত্বেও নদী ও ভূমি খেকোদের কবল থেকে নদী ও খাল গুলোকে বাঁচানো যাচ্ছে না। রাজধানী ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর অবস্থাও খুবই করুণ। নদী খেকোদের কারণে আজ দেশের নদ-নদীগুলো তাদের মানচিত্রও হারাতে বসেছে। ভরাটের কারণে পানি প্রবাহের কমে গেছে। স্রোতস্বিনী নদীগুলোতে জেগে উঠেছে ছোট-বড় অনেক চর। নদীর নাব্য হারানোর ফলে দূষণ মাত্রাও বেড়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার পানিতে ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে প্রতি লিটারে দশমিক ৪৭ মিলিগ্রাম। কোথাও কোথায়ও অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যের কোঠায়। পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। নদী দখলের কারণে দেশের ছোট-বড় ২৩০টি নদীর মধ্যে ১৭৫টি নদীই মৃত প্রায়। এছাড়া প্রতি বছরই দুই একটি করে নদী মরে যাচ্ছে বা শুকিয়ে যাচ্ছে। নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার কারণে তার প্রভাব হাওড় বিলেও পড়েছে। যার ফলে বর্ষার সময়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পাশাপশি নদী ভাঙ্গনের মাত্রাও বেড়ে গেছে। অন্যদিকে নদ-নদী ও মিঠা পানির প্রায় ৬৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নদী দখলের প্রভাব প্রাণীকুলেও পড়েছে। নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এরই মধ্যে ১৮ প্রজাতির প্রাণী হারিয়েছে। সুন্দরবনেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সুন্দরী গাছ, কেওড়া, গোলপাতাসহ মূল্যবান সম্পদ ধ্বংসের সম্মুখীন। একই সঙ্গে অনেক পাখি, বন্যপ্রাণী, বনজ উদ্ভিদ ও পোকামাকড়ের বহু প্রজাতিও বিলুপ্তির পথে। সব কিছুরই প্রভাব পড়েছে নদী দখলের কারণে।
×