ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

দুর্নীতি নির্মূল ও পচা শামুকের দেয়াল

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

দুর্নীতি নির্মূল ও পচা শামুকের দেয়াল

আক্ষরিক অর্থে বিধিবদ্ধ সমাজে বিপরীতমুখী কর্মকা-কে দুর্নীতি বলা হয়ে থাকে। সমসাময়িক সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ চরিতার্থে সরকারী বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিবর্গের অবৈধ জনস্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপকেই দুর্নীতির মোড়কে উপস্থাপন করা হয়। সকল দেশ বা সমাজে দুর্নীতিমূলক আচরণ করার প্রবণতার কারণসমূহ মূলত এক ও অভিন্ন। তবে এর ব্যাপ্তি, ব্যাপকতা ও ধরন সকল সমাজে একই রকম নয়। যেসব প্রধান কারণে দুর্নীতি হয়ে থাকে তা হলো সামাজিক পরিবেশ ও মূল্যবোধ এবং দুর্নীতিমূলক আচরণ দমনে গৃহীত ব্যবস্থার দুর্বল সমন্বয়। এটি একটি সহজ সমীকরণ যে, দমনমূলক ব্যবস্থা কঠিন হলেই দুর্নীতির ব্যাপকতা কম এবং শিথিল হলে তার অধিক বিস্তার ঘটে। বাংলাদেশের দুর্নীতির প্রকৃতি, পরিধি, ধরন ও কারণ স্বভাবত ভারতসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো। বিশিষ্ট সমাজ-অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গুন্নার মিরডলের মতে ‘সংস্কার, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ইত্যাদি কোন কিছুতেই আমার কোন আস্থা নেই যতক্ষণ পর্যন্ত দুর্নীতি দূরীকরণের কোন চেষ্টা না হচ্ছে।’ প্রসঙ্গত তাঁর মতানুসারে ভারতের মতো দরিদ্র দেশসমূহে দুর্নীতিকে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার প্রবণতা কত যে ভয়ঙ্কর তা রাষ্ট্র পরিচালকদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে এবং এসব দেশসমূহে দুর্নীতি দমনই হলো প্রধানতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট’- এই ধরনের প্রচলিত ধারণা বর্তমান সমাজে কার্যকর নয়। কারণ, অভাবী বা দরিদ্র শ্রেণীর দুর্নীতি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না; কিন্তু মধ্যবিত্ত বা বিত্তশালী বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের পক্ষে দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়া এবং এর বিস্তৃতি ঘটানো খুবই সহজ। উদাহরণ স্বরূপ, ১৯৮৫ সালের ২৫ জুন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ঘধঃরড়হধষ ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ চঁনষরপ ঋরহধহপব ধহফ চড়ষরপু কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় যে, ১৯৮৩-৮৪ সালে কালো টাকার পরিমাণ ছিল ৩১,৫৮৪ কোটি থেকে ৩৭,৭৮৬ কোটি টাকা অর্থাৎ তা মূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (এউচ) প্রায় ১৮ থেকে ২১ শতাংশ। রিপোর্ট অনুসারে ১৯৭৫-৭৬ সালে কর আদায়ের আওতার বাইরে ছিল প্রায় ৭০ থেকে ৭৪ শতাংশ। বাংলাদেশে দুর্নীতির চিত্র ছিল খুবই প্রকট। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০২ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে ৪ বছর দেশ বিশে^র দুর্নীতির শীর্ষ অবস্থানে ছিল। দুর্নীতি দমন না করে, দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে অবৈধ সামরিক শক্তি সমর্থিত এবং কথিত গণতান্ত্রিক জামায়াত-বিএনপি সরকার দুর্নীতিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যে কারণে বিশ্বে বাংলাদেশ দুর্নীতির শীর্ষ দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল প্রায় পাঁচবার। কিন্তু অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক চিত্র হচ্ছে ২০০৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দক্ষ সরকার পরিচালনায় দুর্নীতিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং সব ক্ষেত্রে সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছিলেন বলেই ২০১৭ সালে নবেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের ১৭৩টি দেশের সরকার প্রধানদের মধ্যে সততার জন্য বিশ্বে শীর্ষ পাঁচটি আসনের মধ্যে নিজেকে তৃতীয় স্থানে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। উল্লিখিত বিষয় সম্পর্কে ১১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠে ‘সততার রেনেসাঁ : জয়তু শেখ হাসিনা’ শিরোনামে প্রকাশিত আমার লেখায় বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছি। ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর দেশের সকল দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন এবং সরকার পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে দুর্নীতি, জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস ও মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যেই তার যথার্থ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দুর্নীতি দমনে সরকারের সৎ সাহস ও সদিচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেসব সরকার দুর্নীতি বিরোধী অভিযান বাস্তবায়ন করতে না পারে গবেষকগণ সেসব সরকারগুলোকে ‘Soft Government’ বলে থাকেন। এই প্রসঙ্গে Peter H. Odegard- যথার্থই বলেছেন, In last analysis venality can be eliminated only where power to do so is linked with the desire to do so.’ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে জাতিকে আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে নতুন অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন প্রক্রিয়ার সূচনা করেন। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের আহার, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা দেন; যার লক্ষ্য ছিল দুর্নীতি দমন; ক্ষেতে খামারে ও কল-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি; জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত করার মানসে ১৯৭৫ সালের ৬ জুন বঙ্গবন্ধু সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী মহলকে ঐক্যবদ্ধ করে এক মঞ্চ তৈরি করেন, যার নাম দেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু এই দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে Blue Collar Corruption তথা দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত দুর্নীতির চেয়ে White Collar Corruption অর্থাৎ মধ্য ও উচ্চবিত্ত বা সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্রকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। ব্যাংক, বীমা, শেয়ারবাজার, সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের নানাবিধ টেন্ডার ও নিয়োগ বাণিজ্য, ঘুষ ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে যে প্রভাব বিস্তার করছে না তা কী নিঃসংশয়ে বলা যায়? দুদক এবং আদালত যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির নানা জনশ্রুতি রয়েছে। ‘শর্ষের মধ্যে ভূত’ থাকলে দুর্নীতি থেকে পরিপূর্ণ পরিত্রাণ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না। দুর্নীতির প্রধান উৎসগুলো সম্পর্কে সবারই কম-বেশি জানা আছে কিন্তু এসব নষ্ট চরিত্রের বিকৃত মানসিকতাপূর্ণ চরিত্রগুলোকে পচা শামুকের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সমুদ্রে পচা শামুক যেমন শক্ত দেয়াল তৈরি করে যা ঢেউয়ের আঘাতেও ভাঙ্গার উপায় থাকে না। এ রকম অর্থলোভী, বিত্ত ও ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির মাধ্যমে দেয়াল তৈরি করে ইতোমধ্যেই যেভাবে দেশের অর্থনীতি ও সামগ্রিক উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জ করছে তাদের কঠোরহস্তে আইনের আওতায় এনে দমন করা না গেলে এই অবস্থা আরও ভয়াবহ ধারণ করবে। দুর্নীতি দমনের নামে নিরীহ জনগণের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, বেনামে বা ছদ্মনামে কথিত অভিযোগকারীর অভিযোগ আমলে নিয়ে অনৈতিক আর্থিক যোগসাজশ বা অবৈধ সুযোগ লাভে প্রভাব বা চাপ সৃষ্টির বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা ব্যক্তিস্বার্থে নিরীহ ও সৎ ব্যক্তিদের হয়রানি করার অপচেষ্টা কি-না তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। অভিযোগকারীর যথার্থ নাম, ঠিকানা, পরিচয় ইত্যাদি নিশ্চিত হয়ে যে, কোন তদন্ত কার্যক্রম অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। এই শর্ত অবশ্যই যুক্ত করতে হবে যে- অভিযোগকারীর অভিযোগ যদি বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ, পবিত্র দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের যাচাই-বাছাই করে তদন্তে মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে অভিযোগকারীকেও কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। অন্যথায় যদি বিনা কারণে বা প্রভাবিত তদন্তের মাধ্যমে নির্দোষ, নির্লোভ, নির্মোহ ব্যক্তিকে শাস্তি পেতে হয় তা দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভয়াবহ নৈরাজ্যের সৃষ্টি করবে। ফলে আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের অসহায়ত্ব এবং হতাশা আত্মহননের পথে ধাবিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সঠিক পন্থায় শুধু একটি সংস্থা নয়, একাধিক সংস্থার মেধাবী ও নির্লোভ ব্যক্তিদের সমন্বিত উদ্যোগে যথার্থ দুর্নীতি নির্মূলে সুফল বয়ে আনবে নিঃসন্দেহে তা বলা যায়। সঠিক পথে যথার্থ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করতেই হবে; না হলে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে জাতির ইতিহাসের অধ্যায়ে আমরা দায়বদ্ধ হয়ে থাকব। গত ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআই-বিশে^র ১৮০টি দেশের ২০১৮ সনের দুর্নীতির সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ বিগত সালে পেয়েছিল ২৮ আর এবার পেয়েছে ২৬। তুলনামূলক বিবেচনায় উপরের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯তম যা বিগত সালে ছিল ১৪৩তম এবং নিচের দিক থেকে গত বছরের অবস্থান ছিল বাংলাদেশের ১৭তম যা এবার হয়েছে ১৩তম। বাংলাদেশের সমান অবস্থানে আছে আফ্রিকার দেশ উগান্ডা ও মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র। বাংলাদেশ এবার দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং এশিয়ায় চতুর্থ সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। এবারের পরিসংখ্যানে ৮৮ নম্বর পেয়ে তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ডেনমার্ক অর্থাৎ পৃথিবীতে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ডেনমার্ক। ৮৫ নম্বর পেয়ে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ৪টি দেশ যথাক্রমে সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন। ৮৭ নম্বর পেয়ে নিউজিল্যান্ড রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে রয়েছে ভুটান। এবারের সূচকে উর্ধক্রম অনুসারে ২৫তম অবস্থানে আছে ৬৮ নম্বর পেয়ে ভুটান। বিশে^ ৪১ নম্বর পেয়ে ৭৮তম অবস্থানে এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারত। যদিও কোন দেশই শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত নয়; তারপরও দুর্নীতির একটা সহনীয় মাত্রা থাকা প্রয়োজন; যা পুরো জাতি যেন বিপদগ্রস্ত করতে না পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথাসময়ে যথার্থ অর্থে যে দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান সুস্পষ্ট করেছেন তা দেশ-জাতিকে অনেক বেশি উজ্জীবিত এবং আশান্বিত করেছে। ইতোমধ্যে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া জনগণ তার ওপর অধিকতর আস্থাবান হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এর যথাযথ তত্ত্বাবধান, পুনর্যাচাই ও মূল্যায়নের জন্য নৈতিকতার মাপকাঠিতে অনন্য উচ্চতায় দেশে যারা রয়েছেন তাদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। দুর্নীতি নির্মূলে অঙ্গীকার এবং সত্যিকার অর্থে দৃশ্যমান বাস্তবায়ন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে- এটিই সবার প্রত্যাশা। লেখক : শিক্ষাবিদ, উপাচার্য, চট্টগ্রাম, বিশ্ববিদ্যালয়
×